ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন: ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে ব্যবহার হবে
- আপডেট সময় ১১:২৯:৪৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৩
- / ১০৭ বার পড়া হয়েছে
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এ নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সমালোচনা ও বহু বিতর্কের পর আইনটি পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি আইন (প্রস্তাবিত) হয়েছে। ইতোমধ্যেই এটি অনুমোদন হয়েছে মন্ত্রিসভার বৈঠকে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়নি। লোক দেখাতে শুধু কয়েকটি ধারা, সাজার পরিমাণ কমানো এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে আশঙ্কাগুলো এখনো আছে। অর্থাৎ বলা যায়, ডিজিটাল থেকে সাইবার সিকিউরিটি আইনটি শুধু মোড়ক পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা যেভাবে আগের আইনটি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, একই উদ্দেশ্যে নতুন আইনটি করা হয়েছে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের বিশিষ্টজনরা এ আশঙ্কার কথা বলেন। তবে তাদের মতে আইনটি এখনো পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। ফলে সরকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
যারা মতামত দিয়েছেন এরমধ্যে রয়েছেন-ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক। অন্যদিকে বুধবার এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, মন্ত্রিপরিষদে পাশ হলেও এখন অংশীজনের মতামতের সুযোগ রয়েছে। আইন এখন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে। তারা সবার মতামত নেবেন।
‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এর খসড়া সোমবার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেগুলো প্রস্তাবিত আইনেও একইভাবে রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ১৪টি। নতুন ৪টি ধারা জামিন অযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে দণ্ড কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। কিন্তু আইন তৈরির ক্ষেত্রে তাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে বিষয়টি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মঙ্গলবার বলেন, তড়িঘড়ি করে আইনটি অনুমাদনের বিষয়টি একেবারেই হতাশাজনক। এর আগে ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ওই আইন তৈরির প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সবকিছুই ব্যাপক বির্তকিত ছিল। তার স্বীকৃতি হিসাবে সরকার নিজেই ওই আইনটি বাতিল করে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন তৈরির ক্ষেত্রে কোনো অংশীজনকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এক্ষেত্রে মতামত চেয়ে সময় দেওয়া হলো মাত্র দুই সপ্তাহ। এরপর মন্ত্রিপরিষদ সভায় পাশ করা হলো। এটি অভূতপূর্র্ব দৃষ্টান্ত। কারণ বর্তমান সরকারের আমলে প্রায় সব আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অংশীজনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ফলে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে এবার প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো মূল উপাদান। অর্থাৎ যে আইন বাতিল করে নতুন আইন করা হলো, সেটি একেবারেই আগের প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ একই জিনিস, শুধু খোলস বা মোড়ক পরিবর্তন করা হয়েছে। লোক দেখাতে শুধু কয়েকটি ধারা, সাজার পরিমাণ কমানো এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত বিষয়গুলো এখনো আছে। ফলে মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে আশঙ্কাগুলো থেকেই গেল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আমরা জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস হিসাবে দেখছি। আমি মনে করি অংশীজনের মতামতের আলোকে আইনটিকে ঢেলে সাজানো উচিত।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে কোনো আইনের উদ্দেশ্য জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু এর আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছিল। এটি সুরক্ষা তো দূরে থাক মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আইনটি ব্যবহার করেছে। সমালোচনার মুখে আইনটি পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউিরিটি আইন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগের আইনের নিবর্তনমূলক যে বৈশিষ্ট্য, তার কোনো রকম পরিবর্তন নেই। শুধু কয়েকটি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন বোতলে পুরোনো পানীয়। তিনি বলেন অতীতে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে তাদের স্বার্থে আইনটিকে ব্যবহার করেছে, একই উদ্দেশ্যে নতুন আইনটি করা হয়েছে। ফলে এটি জনগণের কল্যাণের পরির্বতে অকল্যাণই বয়ে আনবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক বলেন, আইন মানুষের কল্যাণের জন্য। ফলে যে কোনো আইন সবার সঙ্গে কথা বলে করা উচিত। এক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে এটি সবার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, এর আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। এবার হয়েছে ব্যতিক্রম। তার মতে, এই আইনের অন্যতম অংশীজন সাংবাদিকরা। কারণ তাদের মামলা, হয়রানি, নির্যাতন এবং ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটি আমরা সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠিয়ে দেব। সেখানে এসব বিষয় অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা হবে। ফলে এখনো আলোচনার সুযোগ আছে কিনা সরকার বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারে। কারণ কেউ মতামত দিলে তা গ্রহণ করার ক্ষমতা সরকারের কাছেই রয়েছে। ফলে অন্তত সাংবাদিকদের মতামত নেওয়া উচিত ছিল।’ তিনি বলেন, এখানে দ্বিতীয় বিষয় হলো আইনে পরিবর্তন। নতুন আইনে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, সেখানে কিছু কিছু ভালো দিক আছে। যেমন আগে পুরো আইনটিই ছিল জামিন অযোগ্য। কিন্তু নতুন করে কিছু অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও একটি বিষয় থেকে যায়। সেটি সিআরপিসির (কোড অব ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর) ৫৪ ধারার মতো। ৫৪ ধারায় পুলিশ যে কাউকে অ্যারেস্ট করতে পারে। সাইবার সিকিউরিটি আইনেও কিছু কিছু ধারায় পুলিশ অ্যারেস্ট করতে পারে। কিন্তু পুলিশের এই ক্ষমতা আমাদের দেশে কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সেটি ভাববার বিষয়। ফলে সবকিছু মিলে সরকার অনুরোধ করব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে আইনটিকে নিয়ে আরেকটু চিন্তাভাবনা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সাইবার জগত বড় হয়েছে। ফলে এ খাতের নিরাপত্তায় সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট আমরা চাই। কিন্তু এটি হতে হবে সবার কল্যাণের জন্য।
সূত্র: যুগান্তর।