স্ত্রীর আবদারে পশ্চিম মালিবাগের বাসায় বসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গান ও গিটারের সুরে বাচ্চু তৈরি করলেন 'সেই তুমি' অর্থাৎ ‘চলো বদলে’ যাই গানটি।
আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ যার জন্য, সৃষ্টি হল যেভাবে

- আপডেট সময় ০৪:৫৯:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
- / ২৪ বার পড়া হয়েছে
বিয়ের দেড় বছর পার হয়েছে, ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মনে হল স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনাকে পাওয়ার জন্য অতীতের সেই আকুলতা কেমন যেন মিইয়ে গেছে; তার স্ত্রীও সাংসারিক বিষয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে জীবনের জন্য একটা গান বড্ড প্রয়োজন বলে অনুভব করলেন বাচ্চু। স্ত্রীও আবদার করে বসেন তার জন্য একটি গান লিখতে।
স্ত্রীর সেই আবদারে ১৯৯৩ সালে ঢাকার পশ্চিম মালিবাগের বাসায় বসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গান ও গিটারের সুরে বাচ্চু তৈরি করেলেন ‘সেই তুমি’ অর্থাৎ ‘চলো বদলে’ যাই গানটি। দেশ-কাল ছাপিয়ে প্রেম-বিরহের তীক্ষ্ণ অনুভূতির যে গানটি হয়ে উঠল কালজয়ী।
৩২ বছর পরেও যে গানটি এখনো জনপ্রিয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের তরুণদের কাছে আইয়ুব বাচ্চু এবং ‘সেই তুমি’ সমান্তরাল বিষয়।

একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ‘আমার আমি’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে আইয়ুব বাচ্চুর কথনে উঠে আসে এই গান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট। শনিবার বাচ্চুর ৬৩তম জন্মবার্ষিকীতে সেই ঘটনাটি তুলে ধরছে বিনোদন ডেস্ক।
বাচ্চু বলেন ‘সেই তুমি’ তিনি লিখেছেন তার স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনার কথায় এবং তাকে ঘিরেই।
আইয়ুব বাচ্চু বলেন, “বিয়ের এক থেকে দেড় বছরের মাথায় আমার মনে হয়েছিল আমাদের জীবনে আরও একটা গান খুব ডিমান্ড করে। তারপরই লিখেছিলাম ‘চলো বদলে যাই’ গান। এই গানটা সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষ জানে, পছন্দ করে। এই গানটার ও কৃতিত্বের অধিকারিণী আমার স্ত্রী চন্দনা।”
কীভাবে গানটি লেখা হল সেই গল্পে বাচ্চু বলেন, “একদিন সকালে বাসায় বসে আমি চা খাচ্ছি। সে (স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা) এসে বললো ‘বসে আছো, একটা গান লিখতে পার না ? একটা সুর কর, গান আমার জন্য করো।”
চন্দনাকে আমি বললাম, ‘খারাপ আইডিয়া দাওনি’।
বাচ্চু বলেন,”আমার তখন মনে হল আরে আমরা তো সিরিয়াস প্রেম করতাম। দেড় বছরে আমাদের সেই প্রেম চলে গেল! এটা কেন হল। আমরা এমন প্রেম করতাম, রিকশা নিয়ে মালিবাগ থেকে বের হয়ে পুরো শহর ঘুরে সোবহানবাগ হয়ে অডিও ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে ফিরতাম।
“তখন রিকশায় চানাচুর খাওয়া, খুনসুটি করা, এই দিনগুলো কই চলে গেল। সেই কথাগুলো স্মরণ করেই লিখেছিলাম চলো বদলে যাই গানের কথাগুলো।”
সেই তুমি কেনো এত অচেনা হলে
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম
কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি
কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি
বুকেরই সব কষ্ট দু হাতে সরিয়ে
চলো বদলে যাই…।
‘সেই তুমি’ গানটির জনপ্রিয়তা বাচ্চু তার জীবদ্দশায় উপভোগ করে গেছেন। দেশে বা বিদেশের মাটিতে এমন কোনো কনসার্ট ছিল না যেখানে তাকে এই গানটি গাইতে হয়নি।
প্রায় প্রতিটি সংগীতবিষয়ক আয়োজনে বাচ্চুকে এই গান নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। দেশের সংগীতে সেরা ও জনপ্রিয় গানের তালিকায় ‘সেই তুমি’ স্থান করে নিয়েছে অনায়াসে।
বাচ্চু কীভাবে চন্দনার পড়েছিলেন সেই গল্পও করেছেন। এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ঘরে দেয়ালো ঝোলানো আয়নায় লাগানো এক তরুণীর ছবি দেখে বাচ্চুর মনে হয়েছিল, ওই মেয়েটি তার স্ত্রী হবেন।
বাচ্চু বলেন, “প্রথম যাকে পছন্দ করেছি, তাকেই বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রীকে আয়নার সাথে লাগানো তার একটি ছবি দেখে পছন্দ করেছিলাম। সরাসরি দেখিনি। আমার এক বন্ধুর বাসায় যাই, বন্ধুর স্ত্রীর খুব ক্লোজ বান্ধবী ছিল চন্দনা। ছবি দেখে আমার বন্ধুর স্ত্রীকে বললাম, ‘এটা তো আমার স্ত্রী’।
“বন্ধুর স্ত্রী সেই কথা শুনে খুব মাইন্ড করে আমাকে বললেন, এইসব কী বাজে কথা বলেন। আমি বললাম মাইন্ড করার কিছু নেই এটা আমার স্ত্রী। প্রমাণ পাবেন, দেইখেন।”
প্রথম দেখায় বাচ্চুকে চন্দনা বলেন, ‘আমি আপনাকে পছন্দ করি না’।
বাচ্চু বলেন,” ভালোবাসার এই মানুষটির মুখোমুখি হতে সময় লেগেছে এক মাস। আমি তাকে যখন বললাম ছবি দেখে তার বান্ধবীকে এই কথা বলেছি, তখন চন্দনা খুব হেসে বললো আমি তো আপনাকে পছন্দ করি না।”
এরপর তাদের প্রেম হয় এবং বিয়ের আগে কিছুটা কঠিন সময়ও পার করেছিলেন তারা। সেই কঠিন সময়ে বাচ্চু লিখেছিলেন কয়েকটি গান। সেগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তা পায় ‘ফেরারি মন ও ‘ভাঙা মন’।

‘ফেরারি মন’ গানের প্রেক্ষাপট জানিয়ে বাচ্চু বলেন, “আমার স্ত্রী জানে ফেরারি মন গানটি কেন লিখেছিলাম। তার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হচ্ছিল না। পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি কয়েদি, আর কখনো তাকে দেখতে পারব না। আমাদের কথা জানাজানি হওয়ার পর চন্দনাকে বাসায় আটকে রাখা হয়েছিল। ‘ভাঙা মন’ গানটাও তখন করা হয়েছিল।”
১৯৬২ সালের ১৬ অগাস্টে চট্টগ্রামে জন্মেছিলেন বাচ্চু। এই শিল্পী একাধারে ছিলেন গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। ভক্তদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘এবি’ নামে।
১৯৯১ সালে বাচ্চু তৈরি করেন তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ব্যান্ড এলআরবি। বাচ্চু পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর।
দীর্ঘ সংগীত জীবনে আইয়ুব বাচ্চুর ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘বারো মাস’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র মত বহু গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন।
একে একে তিনি বের করেছেন ‘ফেরারি মন’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘হকার’, ‘অচেনা জীবনে’, ‘মনে আছে নাকি নাই’, ‘স্বপ্ন’, ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘মন চাইলে মন পাবে’ এর মত জনপ্রিয় সব অ্যালবাম। তার শেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।
বিনোদন ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম