০১:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ভিন্নমত ছাড়া ১১টি এবং ভিন্নমতসহ ৯টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।

আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আবারও বসছে ঐকমত্য কমিশন

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০১:৩২:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৪৪ বার পড়া হয়েছে

 

সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ এবং জুলাই সনদ মানার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

শুক্রবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে কমিশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, “ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত এবং প্রত্যাশিত স্বাক্ষরিত সনদের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার। সেই লক্ষ্যে কমিশন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে আলোচনা করবে।”

জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসের আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি হল, তা জানাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে এ সংবাদ সম্মেলন করল ঐকমত্য কমিশন।

আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত দুই পর্বের আলোচনায় কাঙ্ক্ষিত জাতীয় সনদ প্রনয়নের লক্ষ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক সুপারিশ বা সংস্কার ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব হয়েছে।

“আশা করা যায়, এই প্রক্রিয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি উপযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।”

প্রথম ধাপের ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গেল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সভাপতি হিসেবে আছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, আর সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন আলী রীয়াজ।

প্রাথমিক কাজ গুছিয়ে দলগুলোর সঙ্গে মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দুই ধাপের সংলাপ করে কমিশন।

দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে সেদিন আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও দলগুলোর মতামততের ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে।

সবশেষ ৩ অগাস্ট সংসদ ভবনের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সভা হয়। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য হওয়া নানা বিষয় পর্যালোচনা করেন কমিশনের সদস্যরা।

ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশগুলোর বিষয়ে কমিশন পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এবং সেই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে বসবে।

কমিশন বলছে, প্রথম পর্বের সংলাপে ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। যার কিছু কিছু সরকার এরইমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে (অধ্যাদেশ, নীতি ও নির্বাহী সিদ্ধান্তে মাধ্যমে)।

দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ১১টি বিষয়ে সবদলের সমর্থনে জাতীয় ঐকমত্য এবং বাকি ৯টি বিষয়ে অধিকাংশ দলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে, তাতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত উল্লেখ থাকবে।

প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ‘বিরূপ মনোভাবের কারণে’ ২৫টি বিষয়ে আলোচনা হয়নি বলে আলী রীয়াজের ভাষ্য।

 

ঐকমত্য কমিশনের সাড়ে পাঁচ মাস

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়।

এরপর ৫ মার্চ পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়।

এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি।

সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

প্রথম পর্বে ঐকমত্যে ৬২ বিষয়, দ্বিতীয় পর্বে ২০

মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেয়।

মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক হয়। কিছু দলের সঙ্গে হয় একাধিক বৈঠক।

প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়।

কোরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সংসদ ভবনের এলডি হলে শেষ হয়। এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা উদ্বোধন করে কমিশন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হয়।

আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিন চলে এ আলোচনা।

 

ঐকমত্য যেসব বিষয়ে

১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন

২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব নির্ধারণ

৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ

৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান

৫. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ- (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ

৬. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা

৭. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ

৮. সংবিধান সংশোধন

৯. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার

১০. ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা ‘এনসিসি’ [যা পরে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাছাই কমিটি নামে উপস্থাপিত এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠন

১১. সরকারি কর্ম কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত আলাদা প্রস্তাব

১২. প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়

১৩. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন

১৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি)

১৫. সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার

১৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি

১৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার

১৮. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব

১৯. রাষ্ট্রের মূলনীতি

২০. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]

নোট অব ডিসেন্ট যেসব বিষয়ে

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, অধিকাংশ দলের সমর্থনে গৃহীত হলেও নয়টি প্রস্তাবে কোনো কোনো দল ’ভিন্ন মত’ (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।

১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন

২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান

৩. সরকারি কর্ম কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত [ইতোপূর্বে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাছাই কমিটি নামে প্রস্তাবিত ছিল (যা পূর্বে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা ‘এনসিসি’ নামে প্রস্তাবিত ছিল)]

৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি)

৫. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি)

৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি

৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার

৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি

৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]

 

 

বাকি ৫ কমিশনেরও আহ্বান

দুই পর্যায়ে ঐকমত্য কশিনের সংলাপে মতৈক্য হওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়ে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

গত নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে গঠিত শ্রম, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার, নারী ও স্বাস্থ্য খাতসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে সংলাপে আলোচনা হয়নি।

এসব কমিশনের সুপারিশ জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে মুহাম্মদ ইউনূসকে আহ্বান জানিয়েছেন কমিশনগুলোর প্রধানরা।

গণঅভ্যুত্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক, নারী ও সাংবাদিক প্রাণ দেওয়ার কথা তুলে ধরে পাঁচ কমিশনের প্রধানরা বলেছেন, তাদের আত্মত্যাগ থেকে যে আশা ও স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে, তা উপেক্ষিত হলে, ব্যাপক ‘হতাশা ও ক্ষোভের’ জন্ম দিতে পারে।

তাদের সুপারিশের আলোকে ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কারসমূহকে বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

৫ কমিশন প্রধানরা হলেন- শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান শিরীন পারভিন হক, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ।

তারা বলেছেন, জাতীয় সনদে গণমাধ্যম, নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার বিষয়ক সংস্কারসমূহ অন্তর্ভুক্ত না হলে রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতে তা ‘বাতিল বা উপেক্ষা’ করার সুযোগ পাবে।

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ভিন্নমত ছাড়া ১১টি এবং ভিন্নমতসহ ৯টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।

আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আবারও বসছে ঐকমত্য কমিশন

আপডেট সময় ০১:৩২:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

 

সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ এবং জুলাই সনদ মানার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

শুক্রবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে কমিশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, “ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত এবং প্রত্যাশিত স্বাক্ষরিত সনদের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার। সেই লক্ষ্যে কমিশন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে আলোচনা করবে।”

জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসের আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি হল, তা জানাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে এ সংবাদ সম্মেলন করল ঐকমত্য কমিশন।

আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত দুই পর্বের আলোচনায় কাঙ্ক্ষিত জাতীয় সনদ প্রনয়নের লক্ষ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক সুপারিশ বা সংস্কার ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব হয়েছে।

“আশা করা যায়, এই প্রক্রিয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি উপযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।”

প্রথম ধাপের ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গেল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সভাপতি হিসেবে আছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, আর সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন আলী রীয়াজ।

প্রাথমিক কাজ গুছিয়ে দলগুলোর সঙ্গে মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দুই ধাপের সংলাপ করে কমিশন।

দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে সেদিন আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও দলগুলোর মতামততের ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে।

সবশেষ ৩ অগাস্ট সংসদ ভবনের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সভা হয়। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য হওয়া নানা বিষয় পর্যালোচনা করেন কমিশনের সদস্যরা।

ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশগুলোর বিষয়ে কমিশন পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এবং সেই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে বসবে।

কমিশন বলছে, প্রথম পর্বের সংলাপে ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। যার কিছু কিছু সরকার এরইমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে (অধ্যাদেশ, নীতি ও নির্বাহী সিদ্ধান্তে মাধ্যমে)।

দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ১১টি বিষয়ে সবদলের সমর্থনে জাতীয় ঐকমত্য এবং বাকি ৯টি বিষয়ে অধিকাংশ দলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে, তাতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত উল্লেখ থাকবে।

প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ‘বিরূপ মনোভাবের কারণে’ ২৫টি বিষয়ে আলোচনা হয়নি বলে আলী রীয়াজের ভাষ্য।

 

ঐকমত্য কমিশনের সাড়ে পাঁচ মাস

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়।

এরপর ৫ মার্চ পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়।

এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি।

সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

প্রথম পর্বে ঐকমত্যে ৬২ বিষয়, দ্বিতীয় পর্বে ২০

মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেয়।

মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক হয়। কিছু দলের সঙ্গে হয় একাধিক বৈঠক।

প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়।

কোরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সংসদ ভবনের এলডি হলে শেষ হয়। এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা উদ্বোধন করে কমিশন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হয়।

আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিন চলে এ আলোচনা।

 

ঐকমত্য যেসব বিষয়ে

১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন

২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব নির্ধারণ

৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ

৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান

৫. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ- (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ

৬. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা

৭. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ

৮. সংবিধান সংশোধন

৯. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার

১০. ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা ‘এনসিসি’ [যা পরে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাছাই কমিটি নামে উপস্থাপিত এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠন

১১. সরকারি কর্ম কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত আলাদা প্রস্তাব

১২. প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়

১৩. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন

১৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি)

১৫. সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার

১৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি

১৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার

১৮. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব

১৯. রাষ্ট্রের মূলনীতি

২০. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]

নোট অব ডিসেন্ট যেসব বিষয়ে

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, অধিকাংশ দলের সমর্থনে গৃহীত হলেও নয়টি প্রস্তাবে কোনো কোনো দল ’ভিন্ন মত’ (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।

১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন

২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান

৩. সরকারি কর্ম কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত [ইতোপূর্বে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাছাই কমিটি নামে প্রস্তাবিত ছিল (যা পূর্বে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা ‘এনসিসি’ নামে প্রস্তাবিত ছিল)]

৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি)

৫. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি)

৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি

৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার

৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি

৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]

 

 

বাকি ৫ কমিশনেরও আহ্বান

দুই পর্যায়ে ঐকমত্য কশিনের সংলাপে মতৈক্য হওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়ে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

গত নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে গঠিত শ্রম, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার, নারী ও স্বাস্থ্য খাতসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে সংলাপে আলোচনা হয়নি।

এসব কমিশনের সুপারিশ জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে মুহাম্মদ ইউনূসকে আহ্বান জানিয়েছেন কমিশনগুলোর প্রধানরা।

গণঅভ্যুত্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক, নারী ও সাংবাদিক প্রাণ দেওয়ার কথা তুলে ধরে পাঁচ কমিশনের প্রধানরা বলেছেন, তাদের আত্মত্যাগ থেকে যে আশা ও স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে, তা উপেক্ষিত হলে, ব্যাপক ‘হতাশা ও ক্ষোভের’ জন্ম দিতে পারে।

তাদের সুপারিশের আলোকে ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কারসমূহকে বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

৫ কমিশন প্রধানরা হলেন- শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান শিরীন পারভিন হক, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ।

তারা বলেছেন, জাতীয় সনদে গণমাধ্যম, নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার বিষয়ক সংস্কারসমূহ অন্তর্ভুক্ত না হলে রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতে তা ‘বাতিল বা উপেক্ষা’ করার সুযোগ পাবে।

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম