একের পর এক প্রকল্পের নামে আসছে উন্নয়নের ঢেউ, আর এই ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। তাদের অনুমতি না নিয়ে বন উজাড়, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, জমি দখল করা এখন যেন রুটিন প্রশাসনিক কাজ।
আদিবাসীদের প্রতি জাতিগত নিগ্রহ: এক অদেখা বেদনার গল্প

- আপডেট সময় ০২:৩৩:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
- / ৭১ বার পড়া হয়েছে

বান্দরবানের লামা উপজেলায় ম্রো জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ঘরবাড়ি ‘ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের’ এই ছবিটি ২০২২ সালের। এই ধরণের নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতল অঞ্চলের আদিবাসীরা এই দেশের প্রাচীনতম বাসিন্দা, মাটির প্রাণ। কিন্তু আজও তারা সমাজের এক প্রান্তিক অবস্থানে আটকে আছেন, যেখানে তাদের কষ্ট আর অবিচারের গল্প তীব্র যন্ত্রণায় হৃদয় ভেঙে দেয়। তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, নারীদের অপহরণ করা হয়, শিশুদের নিরাপত্তাহীনতায় ফেলা হয়, এমনকি তাদের পোষা হাঁস-মুরগি, কুকুরদেরও জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়—এই নির্মমতার চিত্র আমাদের চোখে কয়েক যুগ ধরে যেন অতি পরিচিত!
কেন এমনটা করা হয়? এই অগাস্টে রাজশাহীর পবা উপজেলায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উদাহরণ দিই। পবার বাগসারা গ্রামের সাঁওতালপাড়া নামে পরিচিত পাড়াটিতে সাতটি সাঁওতাল, চারটি ওরাঁও ও একটি রবিদাস সম্প্রদায়ের পরিবারের বাস ছিল। বাঁধের ওপরে তাদের বাড়ি। ৫ অগাস্ট ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সাঁওতাল পাড়াটির পরেই রয়েছে মো. বাবলু নামের এক বিএনপি কর্মীর জমি। তার জমির সামনের দিকে অন্ত্যজ শ্রেণির পরিবারগুলোর বাড়ি করা নিয়ে আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন বাবলু। এখন সুযোগ এসেছে তার। যদিও জায়গাটা পাউবোর। তবু জাত্যাভিমানী বাবলু ও তার সহযোগীরা একই দিন দুপুরে এবং সন্ধ্যায় দুই দফা হামলা চালায় ওই পাড়ায়। হামলার পরে আদিবাসীদের সবাই বাড়ি ছেড়ে গেছে।
হয়তো উচ্ছেদের শিকার এই আদিবাসী পরিবারগুলো দেশের অন্য কোথাও গিয়ে বসতি গড়বে, কোথাও জায়গা না পেলে দেশান্তরী হবে। অথচ এই আদিবাসীরাই এই মাটির প্রাণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার ভেতরে যে সকল জনগোষ্ঠী আজ নিজেদের আদিবাসী নামে পরিচিতি পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে—যেমন সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা প্রভৃতি—তারা এ অঞ্চলে বসবাস করছে আর্যদের আগমনেরও বহু আগ থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় আর্যরা আসে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে। এর আগে, এই অঞ্চলে ছিল দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি। সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর বাসভূমি ছিল বাংলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, যা আজকের রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, রংপুর অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত।
আর্যরা আসার পর যে আদিবাসীদের বাসভূমি দখল হতে থাকে, তারই ধারাবাহিকতা চলছে এখনও। বাংলার প্রাচীন সাহিত্যেও আদিবাসীদের ‘অসভ্য’, ‘বনবাসী’ ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে, আমরা ভারতচন্দ্রের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু ও ফুল্লরার গল্প মনে করে দেখতে পারি।
বর্তমানে বাংলাদেশের অবিচ্ছিন্ন অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিচিত হতো, যে এলাকাগুলো একসময় গভীর জঙ্গল ও দুর্গম অঞ্চল ছিল, সেই এলাকাগুলোকে মানুষের বসবাস ও চাষাবাদের উপযোগী করে তুলেছিল সেখানকার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোই, বিশেষ করে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, লুসাই, খুমিরা। তারা জুমচাষ, বাঁশনির্ভর কুটিরশিল্প, জৈব খাদ্যচক্র ইত্যাদির মাধ্যমে পাহাড়ের সঙ্গে একটি টেকসই সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সামাজিক কৃষ্টি আজও আদিবাসীদের নেতৃত্বেই টিকে আছে। বসবাসযোগ্যতার মানদণ্ডে তারাই প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপন গড়ে তুলেছে—যা বহিরাগতদের তুলনায় অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী।
১৯৭১ সালেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল আদিবাসী, বাঙালি ছিল মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তী চার দশকে অনুপাত নাটকীয়ভাবে বদলে যায়—২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাঙালি ৪৭শতাংশ এবং আদিবাসী ৫৩শতাংশ; ২০২২ সালের শুমারিতে প্রায় সমান। জনসংখ্যার এই পরিবর্তন পাহাড়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল পাল্টে দিয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটি স্বাভাবিক নিয়মে হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিকল্পিতভাবে সেটলার বাঙালিদের নিয়ে সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
আদিবাসীদের ‘মাটির প্রাণ’ বলাটা কেবল আবেগের প্রকাশ নয়, এর আছে বাস্তব ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। আদিবাসীরা শুধুমাত্র জমির মালিক নয়—তারা জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, মাটি, বনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকা জীবনচর্চার ধারক। শত পরিবর্তনের পরও ভূমি-সম্পর্কিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মালিকানাভিত্তিক ধারণার চেয়ে ভিন্ন রয়ে গেছে—তারা এখনও মনে করে ভূমি কারও একার নয়; এটি সকলের।
অথচ এই আদিবাসীরা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে এখন, হচ্ছে গভীর আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আর রাজনৈতিক অবহেলার শিকার। আমাদের সমাজে ‘উপজাতি’ বা ‘আদিবাসী’ শব্দগুলোই যেন তাদের প্রতি অবজ্ঞার পরিচায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের গণমাধ্যমে এবং সরকারি নীতিতে যেন অধরা থেকে যাচ্ছে। বিগত দেড় দশকের আওয়ামী লীগ সরকার রীতিমতন গণমাধ্যমের প্রতি নির্দেশনা জারি করে বলেছে, আদিবাসীদের, আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বলতে হবে। প্রকৃতপক্ষে একদিকে রাষ্ট্র উন্নয়নের কথা বলছে, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে তাদের ভূমি, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। এই বঞ্চনার পেছনে রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও অকার্যকর বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক।
১৯৯৬ সালে রাঙামাটির লাইল্যাঘোনা গ্রামে কল্পনা চাকমা নামে এক ছাত্রনেতা ও অধিকারকর্মী অপহৃত হন। কল্পনার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, কল্পনাকে লেফটেন্যান্ট পদধারী একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সারা দেশব্যাপী ওই ঘটনা তুমুল আলোড়ন তৈরি করেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কল্পনার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার নিখোঁজ হওয়া শুধু একটি ঘটনা নয়, এটি এক দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত নিপীড়নের প্রতীক। কল্পনা চাকমা ছিলেন পাহাড়িদের কণ্ঠস্বর, যার জন্যই তাকে গুম করা হয়। তিনি ছিলেন আদিবাসী নারীদের অধিকার রক্ষায় অগ্রদূত। এই অপহরণ কাণ্ড আমাদের দেশের আদিবাসীদের ওপর এক বীভৎস নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরে।
২০০২ সালের ১৮ অগাস্ট নওগাঁর ভীমপুরে ভূমি দখলের লোভে এক সন্ত্রাসী দল আদিবাসী পল্লীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শিশুদের পুকুরে ছুড়ে মারা হয়, নারীরা নির্যাতিত হয় এবং এই নির্মম ঘটনায় প্রাণ হারান আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন। নিজের প্রাণের বিনিময়ে তিনি লড়ে গেছেন জনজাতির মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায়। কিন্তু আজও তার হত্যাকারীদের বিচার হয়নি। জামিনে বেরিয়ে ঘোরাফেরা করা ওই দুষ্কৃতকারীরা আদিবাসী পরিবারগুলোকে হুমকির মধ্যে রেখেছে। তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব কোথায়? তার সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশগাছের পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে, আর বিচারের বাণী নীরবে কাঁদছে।
২০২৪ ও ২০২৫ সালের আদিবাসী নির্যাতনের তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ‘উন্নয়ন’ শব্দটি আজ যেন আদিবাসীদের জন্য আতঙ্কের আরেক নাম। রাষ্ট্র যেখানে উন্নয়নের দাওয়াই দেয়, সেখানে আদিবাসীরা শুনছে উচ্ছেদের যন্ত্রণা। তাদের ভূমি, সংস্কৃতি, পানির উৎস, খাল-বিল, বনভূমি—সব যেন ‘জাতীয় স্বার্থের’ কাঁটাতারে বন্দি। গারো পাহাড়ে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য স্থানীয় গারোদের শত বছরের পুরোনো বসতভিটা, খাসজমি, কৃষিজমি ও বনজ সম্পদ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্প থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ মূলস্রোতের জনগোষ্ঠীর জন্য, স্থানীয়দের জন্য নয়।
একের পর এক প্রকল্পের নামে আসছে উন্নয়নের ঢেউ, আর এই ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। তাদের অনুমতি না নিয়ে বন উজাড়, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, জমি দখল করা এখন যেন প্রশাসনের রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। এই কাজের পেছনে লুকিয়ে আছে উন্নয়ন নামের হিংস্রতা এবং রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদপুষ্ট অমানবিকতা।
এই প্রেক্ষাপটে ১০ জুলাই রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে চেংগী নদীর পাড়ে আয়োজিত এক গণসমাবেশে ৫১টি আদিবাসী সংগঠনের নেতৃত্বে ২১টি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা একত্র হন। সেখানে তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, উন্নয়ন নয়, আদিবাসীদের প্রয়োজন সাংবিধানিক স্বীকৃতি, জমির মালিকানা, সংরক্ষিত আসন এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। আদিবাসীদের এই ন্যায্য দাবিগুলো শুধু শুনে যাওয়ার নয়, গ্রহণ করার সময় এখনই।
অথচ রাষ্ট্র এর উল্টো পথেই হাঁটছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নতুন ক্যাম্প হচ্ছে। এই জাতিগত নিগ্রহ আসলে কাঠামোগত দুর্নীতির ফলাফল। এখানে রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ববোধ থাকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি এখনো পূর্ণ হয়নি। ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ নামে তাদের অবহেলা করা হয়। তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় ‘উন্নয়নের’ নামে।
আমরা যদি তাদের কষ্ট বুঝতে না পারি, তাদের মানুষ হিসেবে স্বীকার না করি, তাহলে কল্পনা চাকমা ও আলফ্রেড সরেনদের মতো অসংখ্য আদিবাসী আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না। তাদের আত্মা বারবার আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করবে, তোমরা কোথায় ছিলে, যখন আমরা নিপীড়িত হচ্ছিলাম?” এখন সময় এসেছে আমাদের জাতিগত আত্মশুদ্ধির। আমাদের দরকার মানবিক রাষ্ট্রচিন্তা। যেখানে মানুষকে বিচার করা হবে না তার পরিচয়ে, বরং তার মানবিকতা দিয়ে। সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটাই হবে ন্যায়ের পথে প্রথম ধাপ। স্কুলের পাঠ্যক্রমে আদিবাসীদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেন নতুন প্রজন্ম তাদের প্রতি সম্মান ও দায়বদ্ধতা নিয়ে বড় হয়।
আজ বাদে কাল ৯ অগাস্ট, আবারও উদযাপিত হবে বিশ্ব আদিবাসী দিবস। মূলধারার বাঙালিদের খুব কম সংখ্যক দিবসটিকে অন্তর থেকে স্মরণ করে। বেশিরভাগই গৎবাঁধা বুলি আউড়ে যায়, একদিন কল্পনা চাকমা নামের এক মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল, একদিন আলফ্রেড সরেন নামের এক আদিবাসী নেতা জীবন দিয়েছিল। ব্যস, এতটুকুই! কিন্তু বাকি ৩৬৪ দিন নিগৃহীত আদিবাসীদের কথা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ।
শোয়েব সাম্য সিদ্দিক -লেখক , গবেষক।