নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবকে খুশি করতেই ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) সংশোধন করা হচ্ছে। এর বিপরীতে রিহ্যাব বলছে, তাদের দাবি পুরোপুরি মানা হয়নি।
আবার সংশোধন হচ্ছে ড্যাপ, ‘বাড়ছে’ ফার

- আপডেট সময় ১২:৫৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫
- / ৫৩ বার পড়া হয়েছে
রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে আগের সরকারের আমলে নেওয়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) আবার সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে; যাতে কিছু এলাকায় ফার বাড়ানোসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবকে খুশি করতেই ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) সংশোধন করা হচ্ছে। এর বিপরীতে রিহ্যাব বলছে, তাদের দাবি পুরোপুরি মানা হয়নি।
রোববার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে এক সভায় বর্তমান ড্যাপে থাকা রাস্তার ভিত্তিতে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও), এলাকাভিত্তিক ফার, আবাসন ইউনিটের মত বিষয়গুলো সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিন মন্ত্রণালয়ে খসড়া ঢাকা ইমারত বিধিমালা-২০২৫ এবং ড্যাপের কিছু সংশোধনীর ওপর এ সভা হয় যাতে সভাপতিত্ব করেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
সভায় বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম, রাজউকের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থাপত্য অধিদপ্তর, রিহ্যাবের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় থাকা রাজউকের একজন কর্মকর্তা, রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুল লতিফ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহম্মদ খান ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্তের তথ্য বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিয়েছেন।
তারা বলেন, সভায় বিদ্যমান রাস্তার ভিত্তিতে ফার, এলাকাভিত্তিক ফার ও জনঘনত্বের বিষয়ে সংশোধন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের ওই কর্মকর্তা বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এলাকাভিত্তিক ফারের বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়েছে। তবে গ্রামীণ এলাকার (যেমন দাসেরকান্দি, কাচপুর, ময়নারটেক, আলীপুর, রুহিতপুর, বিরুলিয়া, বনগ্রাম ইত্যাদি) কম বেশি ১৬টি জনঘনত্ব ব্লকের ফার কিছুটা সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় বিবিএস-২০১১ এর হাউজহোল্ড সাইজ বিবেচনায় নিয়ে আবাসন ইউনিট নির্ধারণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) এর অধিকতর উন্নত করতে সব পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে একটি কারিগরি কমিটি গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ কমিটি ঢাকার বাসযোগ্যতা উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজউককে পরামর্শ দেবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহম্মদ খান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটা মোটাদাগে বললে, ফারের পরিমাণ বাড়বে। ফার বাড়লে বিভিন্ন এলাকায় ভবনের উচ্চতা বাড়বে, কংক্রিটের পরিমাণ বাড়বে, ভবনে আলো-বাতাসের পরিমাণ কমবে।
”আবাসন ইউনিট বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি এলাকায় জনঘনত্ব বাড়বে। জনঘনত্ব বাড়লে পরিষেবার ওপর চাপ বাড়বে। যেসব পরিবর্তন আসছে তা শহরের বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে।”
২০২২ সালের ২৪ অগাস্ট নতুন ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) কার্যকরের গেজেট প্রকাশ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গেজেট প্রকাশের পর থেকেই এটির কিছু বিষয় সংশোধন করার জন্য আবাসন কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল।
কোম্পানিগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ড্যাপ সংশোধন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সে সময়ও সরকারি-বেসরকারি আবাসন, অপরিকল্পিত এলাকা, ব্লক-ভিত্তিক আবাসন, একত্রীভূত প্লটে ফার সুবিধা বাড়ানো হয়।
সেবার ড্যাপ সংশোধনের ফলে ভবনের প্রশস্ততা ও উচ্চতা বাড়ানোরও সুযোগও বাড়ানো হয়। ছাড় দেওয়া হয় ভবন নির্মাণে সামনের সড়কের প্রশস্ততার ক্ষেত্রেও।
ড্যাপ বাতিল এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের দাবিতে চলতি বছরের ২০ মে রাজউক ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে একদল মানুষ।
আবাসন কোম্পানিগুলোর চাপে সংশোধন?
২০২২ সালে ড্যাপ চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে আবাসন কোম্পানিগুলোর মালিকদের সংগঠন রিহ্যাব। বিভিন্ন সভা-সেমিনার, রাজউক ঘেরাওয়ের মত কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
এমন কিছু কর্মসূচিতে রিহ্যাব সরাসরি জড়িত ছিল। কিছু কর্মসূচিতে না থাকলেও সেগুলো আয়োজনের পেছনে সংগঠনটি ছিল।
চলতি বছরের ১৮ মার্চ রিহ্যাব রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ড্যাপ বাতিল করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা তৈরির দাবিতে মানববন্ধন করে। ২২ এপ্রিল রিহ্যাব এবং আবাসন খাত সংলিষ্ট লিংকেজ শিল্প সংগঠনগুলোকে নিয়ে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। এতে ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের দাবি তোলা হয়।
এর আগে ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে ড্যাপকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে তা সংশোধনের দাবি জানায় ‘ড্যাপ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকা শহরের ভূমি মালিক’ নামে একটি সংগঠন।
এ বছরের ২৪ মার্চ ‘ঢাকা সিটি ভূমি মালিক সমিতি’র পক্ষ থেকে রাজউক চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি দেন সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক দেওয়ান এম. এ. সাজ্জাদ।
এরপর ২০ মে রাজউক ভবন ঘেরাও করতে যায় ঢাকা মহানগর বাড়ি মালিক সমিতি নামে একটি সংগঠন।
এ দিনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য রিহ্যাবের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ বাবু বিভিন্ন আবাসন কোম্পানিতে বার্তা পাঠান। এতে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১০ জন সদস্য নিয়ে সকাল সাড়ে ৮টায় রাজউকের ভবনের সামনে থাকতে বলা হয়।
ওই অনুষ্ঠানসহ বাকি দুটি অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় রিহ্যাবের জনসংযোগ শাখা থেকে।
সোমবার মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহম্মদ খান বলেন, ড্যাপের যেসব বিষয় সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে আবাসন ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র আবাসন কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য।
তার ভাষ্য, “পুরো উদ্যোগটাই (ড্যাপ সংশোধনের) নেগেটিভ। ড্যাপ পরিবর্তনের আগ্রহটা দেখানোই হয়েছে শুধুমাত্র রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোক খুশি করার জন্য। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ড্যাপ করা হয়েছিল সেখান থেকে সরে আসা হল।”
রিহ্যাবকে খুশি করতে ড্যাপ সংশোধন করা হচ্ছে এমন প্রশ্নে রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুল লতিফ বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের খুশি করার জন্য এই সংশোধন করা হয়নি। আমাদের দাবির কিছুই পূরণ করা হয়নি।”
বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, “এরিয়া ফার কিছুটা বেড়েছে কিন্তু রোড ফার কমিয়ে দিয়েছে। অপরিকল্পিত এলাকার জনগণ, যাদের জন্য আমরা আন্দোলন বা দেন-দরবার করছিলাম তাদের কোনো উপকার হল না। কারণ ডেনসিটি অলমোস্ট দুইয়ের নিচে, অর্থাৎ আপনি কাঠাপ্রতি দুইটার বেশি ফ্ল্যাট করতে পারবেন না। ৫ কাঠা জমিতে হলে আপনি সর্বোচ ১০টা ফ্ল্যাট বানাতে পারবেন।”
ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সচিব নজরুল ইসলাম এবং রাজউকের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলামকে একাধিকবার কল দিলেও তারা ধরেননি।
নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম