“বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা প্রায় নিশ্চিত করে দিয়েছে যে, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ইরান একটি পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে,” বলেছেন কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ত্রিতা পারসি।
এই হামলার যেভাবে জবাব দিতে পারে ইরান

- আপডেট সময় ০১:০৬:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
- / ২৮ বার পড়া হয়েছে
পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিক্রিয়ায় এরই মধ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, মার্কিন হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার অধিকার রাখেন তারা।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল আচমকা ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে বসার পরও ইরানের কর্তাব্যক্তিরা এমনটাই বলেছিলেন। এরপর সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে তেহরান ও তেল আবিব আকাশপথে একে অপরের বিভিন্ন স্থাপনায় লাগাতার হামলা পাল্টা হামলা চালিয়ে গেছে।
এখন আনুষ্ঠানিকভাবে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তারা ইসরায়েলের সঙ্গী হয়ে নাতাঞ্জ, ইস্ফাহান ও ফোরদোর পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে।
তিন স্থাপনায় মার্কিন হামলার কথা স্বীকার করেছে ইরানও। এর প্রতিক্রিয়ায় এখন তারা কী করবে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ও কৌতুহল প্রকট।
বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক ফ্রাঙ্ক গার্ডনার মনে করছেন, ইরানকে এখন তিন কৌশলের মধ্যে একটি বেছে নিতেই হবে।
এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, কিছুই না করা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে ইরান পাল্টা হামলা চালালে ‘আরও তীব্র ও শক্ত জবাবের’ হুমকি দিয়েছেন। তেহরান যদি এখন ওয়াশিংটনের হামলার জবাবে কিছুই না করে তাহলে ট্রাম্পের আরও হামলা থেকে মুক্তি পাবে। এবং এই সূত্রে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনাও জোরদার হতে পারে।
কিন্তু এমন ক্ষেত্রে ইরানের শাসনব্যবস্থাকে ভয়ানক দুর্বল দেখাবে। এতদিন ধরে তারা তাদের ওপর হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে জবাব দেওয়ার যেসব হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল, সেগুলোকে মনে হবে ‘অক্ষমের আস্ফালন’; মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য দেশে তাদের প্রভাবও ‘নাই’ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় যে বিকল্প এখন ইরানি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনির হাতে আছে, তা হল- দ্রুত ও কঠোর পাল্টা আঘাত।
ইসরায়েলের এত এত হামলার পরও ইরানের হাতে এখনও বিপুল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকার কথা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে থাকা ২০টির মতো মার্কিন ঘাঁটিকে নিশানা করতে পারে তারা। ড্রোন এবং দ্রুতগির টর্পেডো নৌযান দিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজে ‘ঝাঁক বেঁধে আক্রমণ’ চালাতে পারে তারা।
গার্ডনারের মতে, এখন শেষ যে বিকল্পের কথাও ইরান ভাবতে পারে, তা হল সময় নেওয়া। পাল্টা আঘাত তারা করবে নিজেদের বেছে নেওয়া সময়ে। তারা এখনকার উত্তেজনা থিতিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারে, এবং এমন এক সময়ে হামলা চলাতে পারে যখন মার্কিন ঘাঁটিগুলো সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার কথা ভাববে না।
ইরান এবং অঞ্চলজুড়ে এর মিত্র বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী গত কয়েকদিন ধরে বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে বলেছিল, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ওয়াশিংটন জড়ালে তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানবে।
তবে অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, মুখে ‘কড়া জবাবের’ অঙ্গীকার করলেও ইরান এবং তার তথাকথিত ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে এসেছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে ৯ দিনের যুদ্ধে ইরানের সামরিক সক্ষমতার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেই পশ্চিমা বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এদিকে ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ মধ্যে হামাস এবং হিজবুল্লাহর অবস্থাও অনেকটাই শোচনীয়। ইয়েমেনের হুতি আর ইরাকের গোষ্ঠীগুলোর সক্ষমতা হামাস বা হিজবুল্লাহর মতো নয়।
‘দীর্ঘ সংঘাতের সূচনা’
ক্লিনটন, বুশ ও ওবামা প্রশাসনে ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা ডেভিড ফিলিপস মনে করছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় ট্রাম্পের নির্দেশের ধারাবাহিকতায় ইরানও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি ও স্বার্থে পাল্টা আঘাত হানবে।
“ট্রাম্প কূটনীতিকে সুযোগ দিতে দুই সপ্তাহ সময় দেওয়ার কথা বলেছিলেন। মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র লাফ দিয়ে বন্দুক ধরে ট্রিগারে চাপ দেওয়ার এবং যে কোনো মূল্যে হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং মার্কিন বাহিনীর ওপর পাল্টা আঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে, কাছাকাছি এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ হাজারের মতো সেনা রয়েছে,” আল জাজিরাকে বলেছেন এখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভিজিটর ফিলিপস।
তার মতে, ‘পারসিয়ান গর্বের গুরুত্বকে’ খাটো করে দেখলে ভুল করবে যুক্তরাষ্ট্র।
“এখন ইরান আক্রান্ত হয়েছে, কেবল ইসরায়েলের হাতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাতেও। ইরান প্রতিশোধের পথ খুঁজবে, এবং তাদের মনোযোগ মূলত থাকবে মধ্যপ্রাচ্য, লোহিত সাগরে থাকা মার্কিন সেনা ও অন্যান্য আমেরিকান স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়।”
মার্কিন হামলা ‘দীর্ঘ সংঘাতের সূচনা’ করল বলেই আশঙ্কা তার।
“আমার মনে হয় না, এটা এখানেই শেষ হল,” বলেছেন ফিলিপস।
একই মত কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের উপপরিচালক অ্যাডাম উইনস্টেইনেরও।
তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন মধ্যপ্রাচ্যে সুদীর্ঘ এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ল।
ইরান আগেই ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে।
“তারা এখন এটা আরও গোপনে চালাবে। তারা হয়তো এনপিটি (পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি) থেকে বেরিয়ে যাবে, এবং এরপর তখন অবশ্যই ইসরায়েলিরা বলবে, এজন্যই আমাদের আরও হামলা চালাতে হবে। এর পাল্টায় ইরানও কিছু মাত্রার পাল্টা হামলা চালাবে, না হলে ইরানের শাসকদের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে।
“এভাবেই সংঘাতের চক্রের সূচনা হয়। এ কারণেই আমি সন্দিহান যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল এই একবারেই শেষ করতে পারবে। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পথে, যা ইচ্ছাকৃত এবং যার সূচনা সে নিজেই করেছে—এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক,” বলেছেন উইনস্টেইন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ইতি ঘটল?
ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহুর কণ্ঠে বিজয়ের সুর। তিন ইরানি স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ‘তেহরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা’ ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ইঙ্গিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের।
কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয় বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পর্যবেক্ষক আলি হার্ব।
তিনি বলেন, ইরানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা ফোরদোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় আদৌ কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ইরানি এক আইনপ্রণেতা বলেছেন, ফোরদোর স্থাপনাটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই সামান্য।
ইরান এবং উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, হামলার পর তেজস্ক্রিয় উপাদান ছড়িয়ে পড়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ইরানি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
আসলেই যদি এমনটা ঘটে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রভাব মোটেও বেশি নয়। তেহরান অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় সচল করতে পারবে; তাদের আরও গোপন স্থাপনাও থাকতে পারে, সেখানে তারা এই সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যেতে পারবে।
আবার ট্রাম্পের ‘অনন্য সামরিক সফলতাকে’ যদি সত্যি ধরে নিই, তাহলে তাহলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বড়জোর কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পেছাল, বলছেন আলি হার্ব।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটেন নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসির আশঙ্কা, এই হামলার কারণে ৫-১০ বছরের মধ্যেই ইরান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে।
তিনি বলেন, ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রমাণ নেই।
“না তার আছে কোনো অস্ত্র, না সে শিগগিরই কোনো অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছিল।
“আমাদের মনে রাখা দরকার যে, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ নিজেরা প্রথম হামলার শিকার না হয়েও একটি পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশে হামলা চালাল। ইসরায়েলে ইরান হামলা চালায়নি, তেল আবিব যুদ্ধ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইরান হামলা চালায়নি, এই মুহূর্তে মার্কিনিরা এই সংঘাতে যুক্ত হল,” বলেছেন পারসি।
তার মতে, ইরানের ওপর এ হামলা ‘বিশ্বকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি’ দেবে। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নিশানায় পড়তে পারে, তাদের কাছে পরমাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়া নিরাপত্তা বোধ করা কঠিন হয়ে যাবে।
“তাই আমার ভয় হচ্ছে, আমরা পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার দেখতে পাবো। একইসঙ্গে আমার ধারণা, এই পরিস্থিতি প্রায় নিশ্চিত করে দিয়েছে যে, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ইরান একটি পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে,” বলেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম