বুধবার ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ১ কোটি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এবার যে কারণে দর বাড়িয়ে ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক

- আপডেট সময় ০৯:২৭:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
- / ৩১ বার পড়া হয়েছে
চলতি জুলাই মাসেই তৃতীয় দফা নিলামে আরও এক কোটি ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের দুই বারের চেয়ে এ দফায় ৪৫ পয়সা বেশি দর দেওয়া হয়েছে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিলামে ডলার কিনেছে। আগের দুই দফায় কেনা হয়েছে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে।
ডলার দর স্থিতিশীল রাখতেই নিলামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
তিনি বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডলারের দর কমছিল, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মান স্থির রাখার জন্যই নিলামে ডলার কিনেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১০ জুলাই ব্যাংকগুলো ১২১ টাকা ৮৫ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে। আট দিন আগে ২ জুলাই এ দর ছিল ১২২ টাকা ৮৫ পয়সা। মূলত ওই দিনের পর থেকে ডলারের দর একটু একটু করে কমতে থাকে এবং ১০ জুলাই তা ১২২ টাকার নিচে নামে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের অর্থ পেতে ১৪ মে ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়ার পরও তা না বেড়ে দেড় মাস পর উল্টো কমছে।
এর আগেও বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নির্ধারিত মূল্যে ডলার কিনলেও চলতি মাসেই প্রথম নিলামে তা সংগ্রহ করা হল।
১৩ জুলাই প্রথমবার ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আর ১৫ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে তারা কেনে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
প্রথম দফা নিলামের পর পরদিন থেকে ব্যাংকের পাশাপাশি খোলা বাজারে ডলারের দর বাড়ার তথ্য আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৪ জুলাই বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ১২০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২০ টাকা ৮০ পয়সা দরে রেমিটেন্সের ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। আগের দিন এ দর নেমেছিল ১১৯ টাকায়।
আগের দুইবারের তুলনায় বুধবার তৃতীয় দফায় কম ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিন কোনো কোনো ব্যাংক ১২২ টাকার বেশি দর দিয়েছিল। আবার কোনো কোনো এর নিচেও দর দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলছেন, বিভিন্ন ব্যাংকের দর দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দর বেঁধে দিয়ে ১ কোটি ডলার কিনেছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে, যে ডলার রয়েছে সামনে সেটা দিয়েই দায় পরিশোধ করবে। তাছাড়া চলতি মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে তেমন আগ্রহী ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মারুফ বলেন, “বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যা উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে। এটা দিয়ে বোঝায় যে ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গেছে এবং যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে, আসলে এত দরকার নেই।”
তার মতে, এবার দর বাড়ার কারণে একটা বিষয় ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশ ব্যাংক চায় ডলার দর এর মধ্যেই থাকুক।
“এভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক এ বাজারকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। ডলার দর এখন স্থিতিশীল।”
একটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার যে কিনেছে তা দিয়ে বাজারকে একটি বার্তা দিল যে দর এর নিচে নামবে না। এটার কারণে রেমিটেন্সের দরও বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটাই চেয়েছিল যে রেমিটেন্সের দর যেন ১২২ টাকা বা ১২১ টাকা ৫০ পয়সার নিচে না নামে। তাই ডলার বাজার ও দরকে স্থিতিশীল বলাই যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২৩ জুলাই আন্তঃব্যাংক ডলার বিক্রির সর্বোচ্চ দর ১২২ টাকা ০২ পয়সা। সর্বনিম্ন দর ছিল ১২১ টাকা ৬০ পয়সা।
এ মাসেই ডলার দর কমছিল। তখন আন্তঃব্যাংকে ১২১ টাকায় নেমেছিল বৈদেশিক মুদ্রাটি।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা শুরু করে।
ডলার দর কমছিল কেন?
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তরা বলছেন, মাঝে কয়েক মাস রেমিটেন্সে উল্লম্ফনের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ের প্রবাহ বাড়ার কারণে ডলার বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। এর সঙ্গে জুনে আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে অর্থ ছাড় হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বড় অঙ্কের ডলার আসে।
এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খানও ডলারের সরবরাহ বাড়ার ইতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ডলারের জন্য বেশ কিছুদিন হাহাকার ছিল। এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খেত। এখন ব্যাংকে ডলারের যোগান ভালোই রয়েছে। ব্যাংকগুলোরও এলসি খুলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না।
সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রতি মাসে ২ বিলিয়নের ওপর রেমিটেন্স আসছে। মাঝে এক মাসে তিন বিলিয়নের ওপরও রেমিটেন্স এসেছে।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও ডলারের দর কমার একই কারণ তুলে ধরেন।
তার মতে, রেমিটেন্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বাড়ায় এবং বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে ঋণ আসার কারণে ব্যাংকগুলোর নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নতি হয়েছে। যে কারণে ডলারের দর আগের চেয়ে কমেছে।
জুনের শেষে আইএমএফ থেকে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, এডিবি থেকে দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) থেকে দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ও এআইআইবি থেকে দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ ছাড় হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দুই ঈদে অনেক ভালো রেমিটেন্সের প্রবাহের বিপরীতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে অনেক কমেছে। যোগান ও চাহিদার এ সূত্রেই দাম কমেছে ডলারের।
আরও কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারাও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার তথ্য দেন।
একজন ট্রেজারি প্রধান বলেন, “বিনিয়োগ যে হচ্ছে না তার প্রধান সূচক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া। সরকার পতনের পর থেকেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে।”
এমন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসায় ভাটা পড়াই মূলত ডলার দর কমে যাওয়ার কারণ। নতুন ব্যবসা না থাকার কারণে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে অনেক কমেছে।
টানা সাত মাস ধরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে। মে মাসে এ খাতে ঋণ ছাড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে যা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
তবে আরেকটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডলারের দর ক্রমাগত কমতে থাকলে সেটিও অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এতে প্রবাসী ও রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তখন ডলারে আয় আসা কমবে।
নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম