তামিম ইকবালের অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত
কেন এই অভিমান? অবেলায় কেন বিদায়?
- আপডেট সময় ০৭:৫৮:০৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ জুলাই ২০২৩
- / ৩২৫ বার পড়া হয়েছে
হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন তামিম ইকবাল। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গুঞ্জন, গুজব ভেসে বেড়াতে থাকে বাতাসে। কী ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন খান সাহেব? নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন? ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবেন? বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রামের জুবলি রোডে ‘হোটেল টাওয়ার ইন’-এ ১৫ মিনিটের জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বোমাটা ফাটালেন তামিম।
‘হোটেল টাওয়ার ইন’-এ বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি ‘টাওয়ার’ ধসে পড়ল। ‘কাল (বুধবার) আফগানিস্তানের বিপক্ষে নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছি,’ তামিমের এমন অপ্রত্যাশিত উচ্চারণে অবিশ্বাসের ঢেউ ওঠে। কার ওপর রাগ করে, কোন অভিমানে এই হৃদয় বিদীর্ণ করা সিদ্ধান্ত? এই অনুচ্চারিত প্রশ্নের অসমর্থিত উত্তর দেশের ক্রিকেটের জন্য এক মস্ত আঘাত। বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র তিন মাস আগে কোন ক্ষোভের আগুনে পুড়ে তামিম নিজের ১৬ বছরের বর্ণিল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন আকস্মিক? সংবাদ সম্মেলনে এর কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
কেননা, প্রশ্ন করার কোনো সুযোগই দেননি ৩৪ বছর বয়সি এই বাঁ-হাতি ড্যাশিং ওপেনার। বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র তামিম ইকবাল যখন বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন, তার দুচোখে সাঁতার কাটছে আটকে থাকা অশ্রু। বারবার আবেগের প্লাবনে মৌন হয়েছেন। টিসু দিয়ে অশ্রু মুছেছেন। সংবাদকর্মীদের দুচোখে তখন অবিশ্বাস ও শোকের বর্ষণ। আগেরদিন বৃষ্টিভেজা ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছে আফগানিস্তানের কাছে। চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই অশ্রুভেজা তামিমের হঠাৎ বিদায়ের ঘোষণা জুবলি রোড থেকে কাজীর দেউড়ি হয়ে সারা দেশে টাইগার ভক্তদের স্তব্ধ করে দেয়।
‘এটাই আমার শেষ। নিজের সেরাটা দিয়েছি। সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই মুহূর্তে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি,’ তামিমের কথাগুলো স্বগতোক্তির মতো শোনায়। গায়ে চিমটি কেটে জানতে ইচ্ছে করে, খান সাহেব যা বলছেন, তা কি সত্যি নাকি নিছকই ভ্রম। কেন এভাবে চলে যাওয়া। পথের শেষ হতে এখনো বাকি ছিল অনেক। অবেলায় কেন বেলাশেষের গান। তামিম এসব প্রশ্নের একটা উত্তর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। ‘হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত আমি নিইনি। একাধিক কারণে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবছিলাম। এখানে আমি সেটা উল্লেখ করতে চাই না। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর এটাই সঠিক সময়,’ বললেন তামিম।
একাধিক কারণের একটি হতে পারে বোর্ডের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে যাওয়া এবং একজন বড় কর্তার অগ্রহণযোগ্য ‘পরামর্শ’। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংসেরও এখানে পার্শ্বচরিত্রে থাকাটা অসম্ভব নয়। মোটা দাগে, দেশের ক্রিকেটের পতাকা যারা শৃঙ্গে নিয়ে গেছেন, তাদের অবমূল্যায়িত করার অপসংস্কৃতির দায় বিসিবি এড়াতে পারে না, এই অভিমত ক্রিকেটবোদ্ধাদের। বিশিষ্ট ক্রিকেট বিশ্লেষক ও অভিজ্ঞ কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম যেমন বলেছেন, সাকিব আল হাসানকেও তামিমের পথ অনুসরণ করতে হতে পারে। আঁচটা যে বিসিবির গায়ে লেগেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় তামিম ইস্যুতে জরুরি সভা ডাকে বিসিবি।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঝলমলে পৃথিবীতে তার প্রবেশ। তিন সংস্করণে সব মিলিয়ে ৩৮৯ ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি রান (১৫,২০৫), সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (২৫টি) ও ৯৪টি ফিফটি এবং ১০৬ ক্যাচের মহামূল্যবান মণিরত্ন খেলোয়াড়ি জীবনের লকআপে গচ্ছিত রেখে গন্তব্যে পৌঁছার আগেই থেমে যাওয়ার পর তামিম বলেন, ‘এই অভিযাত্রায় কয়েকজনকে আমার ধন্যবাদ জানানো উচিত, যা তাদের প্রাপ্য। (বাকরুদ্ধ এবং দীর্ঘশ্বাস নিয়ে) আমি সবসময় বলে থাকি যে, বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য ক্রিকেট খেলি (একথা বলার সময় আবারও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন)। জানি না, ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বাবাকে গর্বিত করতে পেরেছি কি না।’
‘আরও অনেকে আছেন, ধন্যবাদ যাদের প্রাপ্য। আমার ছোট চাচা আকরাম খান। তার হাত ধরে আমি জীবনের প্রথম ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলতে যাই। তাকে এবং তার পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই। আমার প্রথম কোচ এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের তপন দা’কেও ধন্যবাদ জানাই (এসময় আবারও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন)। তিনি আমার শৈশবের কোচ। ধন্যবাদ জানাই সব খেলোয়াড়কে, যাদের সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৩, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯, ‘এ’ দল, প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও জাতীয় দলে খেলেছি। বিশেষ করে জাতীয় দলে আমার সহখেলোয়াড়দের ধন্যবাদ জানাই। ক্রিকেট বোর্ড আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি তাদের সবাইকেও ধন্যবাদ জানাই,’ একটানা বলে যান দেশের হয়ে ৭০ টেস্ট, ২৪১ ওডিআই ও ৭৮ টি ২০ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা তামিম।
তার সংযোজন, ‘আমার বেশি কিছু বলার নেই। তবে একটা কথা অবশ্যই বলব, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি (কান্না)। সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। হয়তো সেটি যথেষ্ট হয়নি কিংবা হয়েছে। জানি না। তবে যখনই মাঠে নেমেছি, নিজের শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ পরক্ষণে তিনি বলেন, ‘বলতে চাই এমন আরও কিছু বিষয় রয়েছে। কিন্তু আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, কথা আটকে যাচ্ছে। আশা করি, পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন আপনারা। এই অবস্থায় কথা বলাটা সহজ নয়। সহজ নয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া। আশা করি, আপনারা তা উপলব্ধি করতে পারছেন। তাড়াহুড়া করে আপনাদের ডাকার জন্য দুঃখিত। মিডিয়ার সবাইকে ধন্যবাদ।’
ভক্তদের ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠা তামিম। বললেন, ‘ভক্তদেরও ধন্যবাদ। আপনাদের ভালোবাসা ও আস্থা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে বাংলাদেশের হয়ে সেরাটা দিতে। আমার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য আপনাদের প্রার্থনায় থাকতে চাই। কাউকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গেলে দুঃখ প্রকাশ করছি। যারা আমাকে একজন ক্রিকেটার এবং মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন, তাদের সবাইকে হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ। আমার মা, ভাই, আমার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে ধন্যবাদ। আমার এই অভিযাত্রায় ওরা যেমন যন্ত্রণা ভোগ করেছে, তেমনি আনন্দও পেয়েছে। ওদের সবাইকেও ধন্যবাদ। আমার আর কিছু বলার নেই।’
তামিম উপসংহার টানেন এই বলে যে, ‘আমার টপিকটা এখানেই শেষ করে দেন, প্লিজ। এখানেই সমাপ্তি। অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কেন, কারণটা কী, কী হতে পারত, এসব বলে কী হবে। আমি সবসময় বলেছি, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। টিমের ওপর ফোকাস করুন। সিরিজে দুটি ম্যাচ এখনো বাকি। আমার মনে হয়, আমরা সিরিজ জিতব।’
সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তামিম যখন নিজের কালো গাড়িতে ওঠেন, তখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে টাইগারভক্ত শোয়েব পিচঢালা পথে মাথা ঠুকে বিলাপ করছে বিদায়ি নায়কের জন্য। বাংলাদেশের প্রত্যেক ক্রিকেটভক্ত শোয়েব হয়ে গেছে!