০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
যেখানে ইতিহাসের ভুল স্বীকার ও ক্ষমা সম্ভাবনার সিঁড়ি হয়ে ওঠে—সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ কি সম্ভব?

কেমন হতো যদি রাত পোহালে দেশটা এমন হতো…

ড. নাদিম মাহমুদ , গবেষক , ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
  • আপডেট সময় ১১:৪৪:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৮ বার পড়া হয়েছে

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আক্রমণ চালানো হয়। পরবর্তীতে, শেখ হাসিনার পতনের ছয় মাস পূর্তির দিনে দ্বিতীয় দফা আক্রমণে ওই বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

 

আজ ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যে মহান নেতাকে ঘাতকের বুলেটে হারিয়েছি, সেই শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরও তাকে আরও কয়েকবার হত্যা করা হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে তাকে ঘিরে রাজনীতি চলে এসেছে—সেটা করছে তার রেখে যাওয়া দল কিংবা তার মৃত্যুর পর জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো।

স্বাধীনতা যুদ্ধের এই অবিসংবাদী নেতাকে নতুন করে পরিচয় করানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা তার অবদানকে ‘সর্বজনীন’ভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় যেমন তার দল আওয়ামী লীগের, তেমনি আমাদের সংকীর্ণ মনোভাবেরও। মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর বা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৫০ বছর পরও রাজনীতির অঙ্গনে তর্ক-বিতর্ক চলছেই, যা আমাদের জাতিকে ঐক্যহীনতার পথে ঠেলে দিয়েছে।

দেশ যে মানুষকেই চালাতে হয়, এই চিন্তা আমাদের মাথায় থাকেই না। ফলে আমরা কুৎসা রটনায় ব্যস্ত থাকি। অথচ আমরা চাইলে একটা সুন্দর ও পৃথিবীর সেরা দেশ তৈরি করতে পারতাম। যারা এই দেশে রাজনীতি করে, তারা তো সবাই দেশের উন্নয়নের জন্য করে নাকি? যদি সেটাই হয়, তাহলে এমন কিছু এলোমেলো ভাবনা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালে কেমন হতো, বলুন তো?

এই যে আজকের এই ১৫ অগাস্টে রাত পোহালে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস অন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে চলে যান, কেমন হয়?

সেখানে গিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের ডেকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই যে বাড়িটি দেখেছেন, এই বাড়িতে আমাদের ‘স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ’ অঙ্কুরিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি আমাদের অমূল্য সম্পদ। তার নেতৃত্বে বাঙালিরা যদি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়ত, তাহলে আজও আমরা পরাধীনতার শিকলে বন্দি থাকতাম’। আমি এই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। একই সাথে এই বাড়িটি রক্ষা করতে না পারায় আমি জাতির কাছে ‘ক্ষমা’ প্রার্থনা করছি। আসুন আমরা সবাই ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জাতির এই স্থপতিকে শ্রদ্ধা জানাই।”

প্রধান উপদেষ্টার পর সেখানে শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন অন্য উপদেষ্টারা। এরপর একে একে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারাও এলেন শ্রদ্ধা জানাতে।

আর যদি এমন হতো যে, কোন একদিন দুপুর বেলা সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সাংগঠনিকভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের পূর্বসূরিদের কাপুরুষোচিত ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইলেন। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহত ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন বীরাঙ্গনাদের কাছে, শহীদদের পরিবারের কাছে। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হওয়ায় জাতির কাছে দলগতভাবে তাদের কিছুটা হলেও কলঙ্কমোচন হয়েছে বলে দাবি করলেন। এখনও দলের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদেরকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিচারের আওতায় আনতে বললেন। এমন যদি হতো, তারা বলছেন, আমাদের দল যে ভুল করেছে, তার খেসারত আমরা স্বাধীনতার পর থেকে দিয়ে আসছি, আর কোনো ভুল নয়। এখন দেশটা গড়ার পালা। তাদের এমন আত্মোপলব্ধি হলে কাউকে আর রাজাকারের তকমা দেওয়ার সুযোগ থাকত কী?

আবার যদি চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশান্তরী হওয়া শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতা-কর্মীরা দেশে ফিরে আসেন। চব্বিশের আন্দোলন দমনে নিজেদের শাসন চর্চায় মারাত্মক ভুল ছিল স্বীকার করে সকল শহীদ পরিবারের কাছে ক্ষমা চান, জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। একই সাথে এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায় মেনে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে আমাদের রাগ-ক্ষোভে কি কিছুটা শীতলতা আসত না?

যদি গত পনের বছর ধরে যেসব লুটতরাজকারী দেশের সম্পদ লুটপাটে জড়িত, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করে এবং একই সাথে যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছিল, তাদের সেই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়, দেশের মোট রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। জিডিপি বেড়ে হয় ৭.৫। তাহলে দেশটার চেহারা কেমন হতো?

এরপর যদি দেখেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও তার উপদেষ্টা পরিষদ জিয়ার মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করছেন। সেখানে বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত থেকে জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করেন। ১৫ অগাস্ট জন্মদিন পালন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে যে বিতর্ক তৈরি করেছেন, সেটি থেকে সরে এসে ঘোষণা করেন, “পনেরোই অগাস্ট জাতির বিয়োগান্তক সময়। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই জাতিটাকে এগিয়ে নেওয়ার সংকল্প করি।”

অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে জনগণের ভোটে একটি দল সরকার গঠন করল। সেই সরকারে সব দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এসেছেন।

অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন শেষে দেশের গরীব ও অসহায় মানুষদের জন্য তার উপার্জিত অর্থের দুই তৃতীয়াংশ দান করে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছেন, যার অর্থ থেকে একটি বিশ্বমানের গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে।

এখন কেউ আর রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাজনৈতিক পথসভা করেন না। সংবাদ সম্মেলন কিংবা বক্তৃতায় কেউ বিদ্বেষ ছড়ানো কথা বলেন না। সবাই দেশের মানুষের উন্নয়ন কীভাবে করা সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা করে। সকল শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা কৃষক, শ্রমিক, তাঁতিসহ সেবা গ্রহীতাদের সবাইকে স্যার বলে ডাকছেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফেলে আর মিছিলে যান না, স্নাতক পরীক্ষা শেষ করার আগেই তাদের চাকরি হয়ে যায়।

আমি জানি এই এলোমেলো ভাবনাগুলো কাল্পনিক কিছুটা অবাস্তবও বটে। তবে এমন কাল্পনিক ভাবনাগুলো যদি সত্যি সত্যি আমাদের দেশে ঘটত, বিশ্বাস করেন, এই দেশ পৃথিবীর সেরা দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। হানাহানি আর বিদ্বেষের রাজনীতি ফেলে সবাই মানুষের জন্য রাজনীতি করত। জনগণের কোনটি ভালো হবে, কোনটি মন্দ হবে তা নিয়ে টেলিভিশনগুলোতে তথ্যভিত্তিক আলোচনা হতো। দুর্নীতিবাজ ও শোষকরা এই ভালোবাসায় হারিয়ে যেত, আমরা পেতাম একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি।

কিন্তু আদৌ কী এই স্বপ্নগুলো পূরণ হবে? যারা মীমাংসিত বিষয়গুলোর ওপর ভর করে রাজনীতি করতে চায়, তাদের মস্তিষ্কে বাজ পড়ত। নতুন করে কীভাবে রাজনীতি করতে হবে তার জন্য মস্তিষ্ককে শাণিত করার জন্য বই-পুস্তক চর্চায় নিমগ্ন থাকত। চাটুকার রাজনীতিবিদদের চিরবিদায় ঘটত।

আমরা পেতাম একটি স্বপ্নের দেশ, যে দেশটিতে বসবাস করার জন্য, ঘুরে দেখার জন্য নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত। এমন দেশটি কেউ কি চায়? রাজনীতির ঘেরাটোপের বাইরে থাকা আপনি-আমি যা চাই, তা কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন?

 

 

ড. নাদিম মাহমুদ , গবেষক , ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

যেখানে ইতিহাসের ভুল স্বীকার ও ক্ষমা সম্ভাবনার সিঁড়ি হয়ে ওঠে—সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ কি সম্ভব?

কেমন হতো যদি রাত পোহালে দেশটা এমন হতো…

আপডেট সময় ১১:৪৪:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫

 

আজ ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যে মহান নেতাকে ঘাতকের বুলেটে হারিয়েছি, সেই শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরও তাকে আরও কয়েকবার হত্যা করা হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে তাকে ঘিরে রাজনীতি চলে এসেছে—সেটা করছে তার রেখে যাওয়া দল কিংবা তার মৃত্যুর পর জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো।

স্বাধীনতা যুদ্ধের এই অবিসংবাদী নেতাকে নতুন করে পরিচয় করানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা তার অবদানকে ‘সর্বজনীন’ভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় যেমন তার দল আওয়ামী লীগের, তেমনি আমাদের সংকীর্ণ মনোভাবেরও। মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর বা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৫০ বছর পরও রাজনীতির অঙ্গনে তর্ক-বিতর্ক চলছেই, যা আমাদের জাতিকে ঐক্যহীনতার পথে ঠেলে দিয়েছে।

দেশ যে মানুষকেই চালাতে হয়, এই চিন্তা আমাদের মাথায় থাকেই না। ফলে আমরা কুৎসা রটনায় ব্যস্ত থাকি। অথচ আমরা চাইলে একটা সুন্দর ও পৃথিবীর সেরা দেশ তৈরি করতে পারতাম। যারা এই দেশে রাজনীতি করে, তারা তো সবাই দেশের উন্নয়নের জন্য করে নাকি? যদি সেটাই হয়, তাহলে এমন কিছু এলোমেলো ভাবনা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালে কেমন হতো, বলুন তো?

এই যে আজকের এই ১৫ অগাস্টে রাত পোহালে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস অন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে চলে যান, কেমন হয়?

সেখানে গিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের ডেকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই যে বাড়িটি দেখেছেন, এই বাড়িতে আমাদের ‘স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ’ অঙ্কুরিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি আমাদের অমূল্য সম্পদ। তার নেতৃত্বে বাঙালিরা যদি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়ত, তাহলে আজও আমরা পরাধীনতার শিকলে বন্দি থাকতাম’। আমি এই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। একই সাথে এই বাড়িটি রক্ষা করতে না পারায় আমি জাতির কাছে ‘ক্ষমা’ প্রার্থনা করছি। আসুন আমরা সবাই ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জাতির এই স্থপতিকে শ্রদ্ধা জানাই।”

প্রধান উপদেষ্টার পর সেখানে শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন অন্য উপদেষ্টারা। এরপর একে একে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারাও এলেন শ্রদ্ধা জানাতে।

আর যদি এমন হতো যে, কোন একদিন দুপুর বেলা সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সাংগঠনিকভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের পূর্বসূরিদের কাপুরুষোচিত ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইলেন। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহত ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন বীরাঙ্গনাদের কাছে, শহীদদের পরিবারের কাছে। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হওয়ায় জাতির কাছে দলগতভাবে তাদের কিছুটা হলেও কলঙ্কমোচন হয়েছে বলে দাবি করলেন। এখনও দলের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদেরকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিচারের আওতায় আনতে বললেন। এমন যদি হতো, তারা বলছেন, আমাদের দল যে ভুল করেছে, তার খেসারত আমরা স্বাধীনতার পর থেকে দিয়ে আসছি, আর কোনো ভুল নয়। এখন দেশটা গড়ার পালা। তাদের এমন আত্মোপলব্ধি হলে কাউকে আর রাজাকারের তকমা দেওয়ার সুযোগ থাকত কী?

আবার যদি চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশান্তরী হওয়া শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতা-কর্মীরা দেশে ফিরে আসেন। চব্বিশের আন্দোলন দমনে নিজেদের শাসন চর্চায় মারাত্মক ভুল ছিল স্বীকার করে সকল শহীদ পরিবারের কাছে ক্ষমা চান, জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। একই সাথে এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায় মেনে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে আমাদের রাগ-ক্ষোভে কি কিছুটা শীতলতা আসত না?

যদি গত পনের বছর ধরে যেসব লুটতরাজকারী দেশের সম্পদ লুটপাটে জড়িত, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করে এবং একই সাথে যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছিল, তাদের সেই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়, দেশের মোট রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। জিডিপি বেড়ে হয় ৭.৫। তাহলে দেশটার চেহারা কেমন হতো?

এরপর যদি দেখেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও তার উপদেষ্টা পরিষদ জিয়ার মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করছেন। সেখানে বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত থেকে জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করেন। ১৫ অগাস্ট জন্মদিন পালন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে যে বিতর্ক তৈরি করেছেন, সেটি থেকে সরে এসে ঘোষণা করেন, “পনেরোই অগাস্ট জাতির বিয়োগান্তক সময়। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই জাতিটাকে এগিয়ে নেওয়ার সংকল্প করি।”

অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে জনগণের ভোটে একটি দল সরকার গঠন করল। সেই সরকারে সব দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এসেছেন।

অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন শেষে দেশের গরীব ও অসহায় মানুষদের জন্য তার উপার্জিত অর্থের দুই তৃতীয়াংশ দান করে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছেন, যার অর্থ থেকে একটি বিশ্বমানের গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে।

এখন কেউ আর রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাজনৈতিক পথসভা করেন না। সংবাদ সম্মেলন কিংবা বক্তৃতায় কেউ বিদ্বেষ ছড়ানো কথা বলেন না। সবাই দেশের মানুষের উন্নয়ন কীভাবে করা সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা করে। সকল শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা কৃষক, শ্রমিক, তাঁতিসহ সেবা গ্রহীতাদের সবাইকে স্যার বলে ডাকছেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফেলে আর মিছিলে যান না, স্নাতক পরীক্ষা শেষ করার আগেই তাদের চাকরি হয়ে যায়।

আমি জানি এই এলোমেলো ভাবনাগুলো কাল্পনিক কিছুটা অবাস্তবও বটে। তবে এমন কাল্পনিক ভাবনাগুলো যদি সত্যি সত্যি আমাদের দেশে ঘটত, বিশ্বাস করেন, এই দেশ পৃথিবীর সেরা দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। হানাহানি আর বিদ্বেষের রাজনীতি ফেলে সবাই মানুষের জন্য রাজনীতি করত। জনগণের কোনটি ভালো হবে, কোনটি মন্দ হবে তা নিয়ে টেলিভিশনগুলোতে তথ্যভিত্তিক আলোচনা হতো। দুর্নীতিবাজ ও শোষকরা এই ভালোবাসায় হারিয়ে যেত, আমরা পেতাম একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি।

কিন্তু আদৌ কী এই স্বপ্নগুলো পূরণ হবে? যারা মীমাংসিত বিষয়গুলোর ওপর ভর করে রাজনীতি করতে চায়, তাদের মস্তিষ্কে বাজ পড়ত। নতুন করে কীভাবে রাজনীতি করতে হবে তার জন্য মস্তিষ্ককে শাণিত করার জন্য বই-পুস্তক চর্চায় নিমগ্ন থাকত। চাটুকার রাজনীতিবিদদের চিরবিদায় ঘটত।

আমরা পেতাম একটি স্বপ্নের দেশ, যে দেশটিতে বসবাস করার জন্য, ঘুরে দেখার জন্য নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত। এমন দেশটি কেউ কি চায়? রাজনীতির ঘেরাটোপের বাইরে থাকা আপনি-আমি যা চাই, তা কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন?

 

 

ড. নাদিম মাহমুদ , গবেষক , ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।