০১:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫
এক ছুটির দিনে 'অচিন পাখি সংগীত একাডেমিতে' গ্লিটজ টিমের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় ফরিদা পারভীনের।

‘গান গাইতে না পেরে হারাম হয়েছিল ঘুম, সেদিনই বুঝেছিলাম লালনই আমার পথ’

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০২:৪৭:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৪৭ বার পড়া হয়েছে

 

নজরুল সংগীত আর আধুনিক গানে নিজেকে তৈরি করা এক তরুণী কেবল তার গুরুর অনুরোধে, অনেকটা ‘তাচ্ছিল্যের’ মনোভাব নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন লালন ফকিরের গান গাইতে। তিনি গেয়েছিলেন ‘সত্য বল সুপথে চল’ শিরোনামের গানটি।

ওই গানেই বাঁক বদলে যায়, তরুণী অনুভব করেন এক ‘ঐশ্বরিক অনুরণন’। তার উপলব্ধি হয়, থেমে গেল চলবে না, মিশে যেতে হবে সাঁইজির গানে।

সেই থেকে শুরু। সেই তরুণী এখন লালনের গানের কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীন।

সত্তর পেরিয়ে আসা ফরিদা কেবল লালনের গানকে কণ্ঠে ধারণ করেননি, সাঁইজির গানকে উত্তরসূরীদের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ দশক ধরে। তৈরি করেছেন লালনের গানের পাঠশালা ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমি’।

সংগীতের এই দীর্ঘ যাত্রায় একুশে পদক পাওয়া ফরিদা পারভীনের আক্ষেপ, নতুন প্রজন্ম ‘শুদ্ধভাবে লালন চর্চা করছে না’। লালনের গান উপস্থাপনার হালের প্রবণতাও ‘সঠিক নয়’ বলে তার ভাষ্য। তার মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালন চর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না।

রোগব্যধিতে ভুগতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাঝে টানা দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হয়ে গেল ২১ জুলাই বাসায় ফিরেছেন ফরিদা পারভীন। চিকিৎসকের বেঁধে নেওয়া নিয়মের বেড়াজালে দিন কাটছে তার।

এবারের অসুস্থতার আগে এক ছুটির দিনে ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমিতে’ গিয়ে ফরিদা পারভীনের সঙ্গে কথা হয় গ্লিটজের। গানের ধারা বদলে কীভাবে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন লালনের বাণীতে, সেই গল্প শুনিয়েছেন তিনি।

কথায় কথায় বলেছেন শারীরিক অসুস্থতা, লালনের মর্মবাণী ও নতুন প্রজন্মের লালনগীতি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা।

 

 

বাসায় সময় কীভাবে কাটে?

ফরিদা পারভীন: কেটে যায়, বাসায় মোবাইল আছে না! খবর শুনি, বাচ্চাদের সাথে এটা সেটা সেসব দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। কোথাও যাই না, বের হওয়া হয় না। মাঝে মধ্যে অচিন পাখিতে (ফরিদা পারভীনের সংগীত প্রতিষ্ঠান) যাই। বাচ্চারা খুব পছন্দ করে আমাকে, ভালোবাসে।

 

লালনের গানে শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?

ফরিদা পারভীন: ১৯৭২ কিংবা ৭৩ সালের দিকে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসব হচ্ছিল, আমার গুরু মোকছেদ সাঁই বললেন, “মা লালনের মহাউৎসব হবে, সেখানে তোকে একটা গান গাইতে হবে।”

আমি বললাম, ধূর এসব গান গায় নাকি মানুষ। না কাকা আমি এসব গান করব না। আমার ভালো লাগে না।

আমি তখন খুব ভালো নজরুলের গান করি, দেশের গান করি, ক্লাসিক্যাল চর্চা করি, আধুনিক গান করি। মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানোর গান করি। আমি মানা করে দিলাম এই গান করব না।

তারপরও গুরু খুব বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন, “দেখ মা এটা আমাদের এখানকার সংস্কৃতি, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন এখানে দোল পূর্ণিমা অনুষ্ঠান দেখতে। তুই একটা গান কর, সবাই পছন্দ করবে।”

তখন আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম ঠিক আছে আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেন ৷

 

কোন গান দিয়ে শুরু?

ফরিদা পারভীন: লালন সাঁইজির ‘সত্য বল সুপথে চল’ এই গান দিয়ে প্রথম আমার লালন গীতি শেখা। সেদিন যখন আমি স্টেজে গানটি করলাম, তখন সবাই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন আরেকটা গান গাও। আমি বললাম, ভাই আমি তো আর গান শিখিনি, আবার শিখে আসি, তখন আবার শোনাব।

সেদিন ফিরে এসে আমার আর ঘুম হচ্ছিল না। আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কি আজ গান ভালো হয়নি?” কারণ মা জানতেন গান ভালো না হলে আমার মনটা খারাপ থাকে। আমি বললাম গান তো গাইলাম, উনারা এত প্রশংসা করলেন আমি তো তাদের আর গান শোনাতে পারিনি।

তখন আমার প্রাণের মধ্যে মনের মধ্যে এক ধরনের অনুরণন ঘটেছিল, যেটা ঐশ্বরিক অনুরণন। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হল আমাকে এই গান আরও করতে হবে, এই গান শিখতে হবে।

গান গাইতে না পেরে ঘুম হারাম হয়েছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম লালনই আমার পথ। এরপর গুরু আমাকে একটা একটা করে গান শেখাতে লাগলেন। আর এভাবেই লালন গানের শুরু। এখন এই লালন ফকিরই আমাকে সবার প্রাণের মধ্যে উপস্থাপন করেছে। এই গান দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই সেদিন ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন।

 

আপনার বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়, তখন গানের পরিবেশ কেমন ছিল?

ফরিদা পারভীন: আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। পড়ালেখা আর গান এই দুই নিয়েই আমার জীবন। আমার বাবা প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন পেশায় সরকারি চিকিৎসক ছিলেন। একটা মেয়ে হলে যেটা হয়, মা বাবার কাছে যাই চাচ্ছি তাই দিচ্ছে, বিশেষ করে গানের ক্ষেত্রে।

বাবা অসম্ভব আমাকে সহযোগিতা করেছেন, মা সহযোগিতা করেছেন। তাই আশপাশের মানুষের কথা আমরা গায়ে লাগাতাম না। বাবা বলতেন আমার একটা মেয়ে, সে গান করুক। তাতে সমস্যা নেই। তবে আমি ছিলাম মারমুখো স্বভাবের মেয়ে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে বাজে মন্তব্য করত, তবে আমার সাথে পারত না। আমি গালাগাল দিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম।

 

আপনাকে লালন সংগীতের ‘রাণী বা সম্রাজ্ঞী’ বলা হয়, এই পরিচয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?

ফরিদা পারভীন: লালনের গানের সম্রাজ্ঞী হওয়া যায় না, অবগাহন করা যায়, আত্মস্থ করা যায়। এসব সম্রাজ্ঞী, রাণী, লালন কন্যা এসব উপাধি অযথা। এসব আমি একদমই পছন্দ করি না। কেউ যদি লালনের বাণীগুলো অন্তর থেকে আত্মস্থ করতে পারে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এসব নাম দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। আমি লালনের গান অন্তর আত্নার সাথে আত্মা মিলিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। তাই এসব নাম আমার ভালো লাগে না।

 

লালনের দর্শন ব্যক্তি জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?

ফরিদা পারভীন: ব্যক্তিগত জীবনে নানান ধরনের পরীক্ষা হয়, ওগুলো নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইনি। আর পেশাগত জীবনে আমি সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়েছি, লালনের গান গেয়ে দর্শক শ্রোতার আশ্বস্ততা অর্জন করেছি।

 

লালনের কোন গানটি আপনার সব থেকে পছন্দের?

ফরিদা পারভীন: প্রতিটা গানই আমার সন্তানতুল্য। ধরেন আমার পাঁচটা ছেলেপুলে আছে, আমি কী পাঁচজনকে একটু বেশি পছন্দ, কম পছন্দ করে ভাগ করতে পারি? পারি না তো। কারণ সব কয়টাই আমার ছেলেমেয়ে। সাঁইজির যত গুলো গান আমি গেয়েছি, আন্তরিকতার সঙ্গে গাওয়ার চেষ্টা করেছি। তাই সবই আমার পছন্দের গান।

 

লালনের গান এখন ব্যান্ড সংগীত বা আধুনিক ধারায় নিয়ে আসছেন অনেকে। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?

ফরিদা পারভীন: না, ওইভাবে লাফালাফি করে লালনের গান হয় না। আমার কাছে একটা কথাই বারবার ঘুরে ফিরে আসে, লালনের গানে অবগাহন কর। সুন্দর করে বুঝে মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। এটা লালনের বাণী, গান নয়। নাচবে গাইবে এভাবে সেভাবে গান করবে এসব আসলে হয় না। আধুনিকভাবে লালনের গান উপস্থাপন করার যে প্রবণতা সেটা সঠিক নয়। এই গানগুলো নিভৃতে বসে গাইতে হয়, গভীর উপলব্ধি থেকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়।

 

লালনের গান আজকের প্রজন্ম কীভাবে গ্রহণ করছে বলে মনে করেন?

ফরিদা পারভীন: আজকাল অনেকেই লালন ফকিরের গান গাইছেন। এটা আশার কথা হলেও দুঃখজনক এই যে, এদের অনেকেই গানের বাণী ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না। আবার, অনেকেরই তাল, লয় ঠিক নেই। আমরা গুরুর প্রতি ভালোবাসা থেকে গানটি গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করতাম। এখনকার অনেকের মধ্যে সেই আন্তরিকতা আর ভক্তি নেই। লালনের গানের চর্চাপ্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে আমি সংগীত একাডেমিও প্রতিষ্ঠা করেছি। আমার স্কুলের সন্তানদের শিখিয়েছি ভালোবাসা থেকে গানগুলো গ্রহণ করছে। সত্য কথা সত্যভাবে শিখানোর চেষ্টা করি। সংগীত নিয়ে কোনো প্রতারণা নেই। নতুনদের বলব যতক্ষণ গানটা সঠিক না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ভিতরে গান করার যন্ত্রণা থাকতে হবে, সঠিক ভাবে গাইতে হবে।

 

লালনের গান সংরক্ষণে ১০০ গান নিয়ে একটা বই তৈরির কথা ছিল, সেই উদ্যোগ কতদূর এগিয়েছে?

ফরিদা পারভীন: লালনের অনেক গান এদিকে সেদিক হয়ে গেছে। সেগুলো খুঁজে বের করতে হচ্ছে। অনেক গান মিলিয়ে ফেলেছে, অর্থাৎ এক গানের লাইন আরেক গানে নিয়ে গেছে। শারীরিক অসুস্থতা, বিভিন্ন কারণে সেটি করা শেষ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত আমার গাওয়া সাঁইজির ৭৫ টা গান লিপিবদ্ধ হয়েছে, আরও ২৫টা গান একসঙ্গে করা হবে। কাজ এগোচ্ছে।

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

এক ছুটির দিনে 'অচিন পাখি সংগীত একাডেমিতে' গ্লিটজ টিমের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় ফরিদা পারভীনের।

‘গান গাইতে না পেরে হারাম হয়েছিল ঘুম, সেদিনই বুঝেছিলাম লালনই আমার পথ’

আপডেট সময় ০২:৪৭:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

 

নজরুল সংগীত আর আধুনিক গানে নিজেকে তৈরি করা এক তরুণী কেবল তার গুরুর অনুরোধে, অনেকটা ‘তাচ্ছিল্যের’ মনোভাব নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন লালন ফকিরের গান গাইতে। তিনি গেয়েছিলেন ‘সত্য বল সুপথে চল’ শিরোনামের গানটি।

ওই গানেই বাঁক বদলে যায়, তরুণী অনুভব করেন এক ‘ঐশ্বরিক অনুরণন’। তার উপলব্ধি হয়, থেমে গেল চলবে না, মিশে যেতে হবে সাঁইজির গানে।

সেই থেকে শুরু। সেই তরুণী এখন লালনের গানের কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীন।

সত্তর পেরিয়ে আসা ফরিদা কেবল লালনের গানকে কণ্ঠে ধারণ করেননি, সাঁইজির গানকে উত্তরসূরীদের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ দশক ধরে। তৈরি করেছেন লালনের গানের পাঠশালা ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমি’।

সংগীতের এই দীর্ঘ যাত্রায় একুশে পদক পাওয়া ফরিদা পারভীনের আক্ষেপ, নতুন প্রজন্ম ‘শুদ্ধভাবে লালন চর্চা করছে না’। লালনের গান উপস্থাপনার হালের প্রবণতাও ‘সঠিক নয়’ বলে তার ভাষ্য। তার মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালন চর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না।

রোগব্যধিতে ভুগতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাঝে টানা দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হয়ে গেল ২১ জুলাই বাসায় ফিরেছেন ফরিদা পারভীন। চিকিৎসকের বেঁধে নেওয়া নিয়মের বেড়াজালে দিন কাটছে তার।

এবারের অসুস্থতার আগে এক ছুটির দিনে ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমিতে’ গিয়ে ফরিদা পারভীনের সঙ্গে কথা হয় গ্লিটজের। গানের ধারা বদলে কীভাবে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন লালনের বাণীতে, সেই গল্প শুনিয়েছেন তিনি।

কথায় কথায় বলেছেন শারীরিক অসুস্থতা, লালনের মর্মবাণী ও নতুন প্রজন্মের লালনগীতি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা।

 

 

বাসায় সময় কীভাবে কাটে?

ফরিদা পারভীন: কেটে যায়, বাসায় মোবাইল আছে না! খবর শুনি, বাচ্চাদের সাথে এটা সেটা সেসব দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। কোথাও যাই না, বের হওয়া হয় না। মাঝে মধ্যে অচিন পাখিতে (ফরিদা পারভীনের সংগীত প্রতিষ্ঠান) যাই। বাচ্চারা খুব পছন্দ করে আমাকে, ভালোবাসে।

 

লালনের গানে শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?

ফরিদা পারভীন: ১৯৭২ কিংবা ৭৩ সালের দিকে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসব হচ্ছিল, আমার গুরু মোকছেদ সাঁই বললেন, “মা লালনের মহাউৎসব হবে, সেখানে তোকে একটা গান গাইতে হবে।”

আমি বললাম, ধূর এসব গান গায় নাকি মানুষ। না কাকা আমি এসব গান করব না। আমার ভালো লাগে না।

আমি তখন খুব ভালো নজরুলের গান করি, দেশের গান করি, ক্লাসিক্যাল চর্চা করি, আধুনিক গান করি। মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানোর গান করি। আমি মানা করে দিলাম এই গান করব না।

তারপরও গুরু খুব বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন, “দেখ মা এটা আমাদের এখানকার সংস্কৃতি, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন এখানে দোল পূর্ণিমা অনুষ্ঠান দেখতে। তুই একটা গান কর, সবাই পছন্দ করবে।”

তখন আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম ঠিক আছে আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেন ৷

 

কোন গান দিয়ে শুরু?

ফরিদা পারভীন: লালন সাঁইজির ‘সত্য বল সুপথে চল’ এই গান দিয়ে প্রথম আমার লালন গীতি শেখা। সেদিন যখন আমি স্টেজে গানটি করলাম, তখন সবাই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন আরেকটা গান গাও। আমি বললাম, ভাই আমি তো আর গান শিখিনি, আবার শিখে আসি, তখন আবার শোনাব।

সেদিন ফিরে এসে আমার আর ঘুম হচ্ছিল না। আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কি আজ গান ভালো হয়নি?” কারণ মা জানতেন গান ভালো না হলে আমার মনটা খারাপ থাকে। আমি বললাম গান তো গাইলাম, উনারা এত প্রশংসা করলেন আমি তো তাদের আর গান শোনাতে পারিনি।

তখন আমার প্রাণের মধ্যে মনের মধ্যে এক ধরনের অনুরণন ঘটেছিল, যেটা ঐশ্বরিক অনুরণন। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হল আমাকে এই গান আরও করতে হবে, এই গান শিখতে হবে।

গান গাইতে না পেরে ঘুম হারাম হয়েছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম লালনই আমার পথ। এরপর গুরু আমাকে একটা একটা করে গান শেখাতে লাগলেন। আর এভাবেই লালন গানের শুরু। এখন এই লালন ফকিরই আমাকে সবার প্রাণের মধ্যে উপস্থাপন করেছে। এই গান দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই সেদিন ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন।

 

আপনার বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়, তখন গানের পরিবেশ কেমন ছিল?

ফরিদা পারভীন: আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। পড়ালেখা আর গান এই দুই নিয়েই আমার জীবন। আমার বাবা প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন পেশায় সরকারি চিকিৎসক ছিলেন। একটা মেয়ে হলে যেটা হয়, মা বাবার কাছে যাই চাচ্ছি তাই দিচ্ছে, বিশেষ করে গানের ক্ষেত্রে।

বাবা অসম্ভব আমাকে সহযোগিতা করেছেন, মা সহযোগিতা করেছেন। তাই আশপাশের মানুষের কথা আমরা গায়ে লাগাতাম না। বাবা বলতেন আমার একটা মেয়ে, সে গান করুক। তাতে সমস্যা নেই। তবে আমি ছিলাম মারমুখো স্বভাবের মেয়ে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে বাজে মন্তব্য করত, তবে আমার সাথে পারত না। আমি গালাগাল দিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম।

 

আপনাকে লালন সংগীতের ‘রাণী বা সম্রাজ্ঞী’ বলা হয়, এই পরিচয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?

ফরিদা পারভীন: লালনের গানের সম্রাজ্ঞী হওয়া যায় না, অবগাহন করা যায়, আত্মস্থ করা যায়। এসব সম্রাজ্ঞী, রাণী, লালন কন্যা এসব উপাধি অযথা। এসব আমি একদমই পছন্দ করি না। কেউ যদি লালনের বাণীগুলো অন্তর থেকে আত্মস্থ করতে পারে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এসব নাম দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। আমি লালনের গান অন্তর আত্নার সাথে আত্মা মিলিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। তাই এসব নাম আমার ভালো লাগে না।

 

লালনের দর্শন ব্যক্তি জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?

ফরিদা পারভীন: ব্যক্তিগত জীবনে নানান ধরনের পরীক্ষা হয়, ওগুলো নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইনি। আর পেশাগত জীবনে আমি সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়েছি, লালনের গান গেয়ে দর্শক শ্রোতার আশ্বস্ততা অর্জন করেছি।

 

লালনের কোন গানটি আপনার সব থেকে পছন্দের?

ফরিদা পারভীন: প্রতিটা গানই আমার সন্তানতুল্য। ধরেন আমার পাঁচটা ছেলেপুলে আছে, আমি কী পাঁচজনকে একটু বেশি পছন্দ, কম পছন্দ করে ভাগ করতে পারি? পারি না তো। কারণ সব কয়টাই আমার ছেলেমেয়ে। সাঁইজির যত গুলো গান আমি গেয়েছি, আন্তরিকতার সঙ্গে গাওয়ার চেষ্টা করেছি। তাই সবই আমার পছন্দের গান।

 

লালনের গান এখন ব্যান্ড সংগীত বা আধুনিক ধারায় নিয়ে আসছেন অনেকে। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?

ফরিদা পারভীন: না, ওইভাবে লাফালাফি করে লালনের গান হয় না। আমার কাছে একটা কথাই বারবার ঘুরে ফিরে আসে, লালনের গানে অবগাহন কর। সুন্দর করে বুঝে মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। এটা লালনের বাণী, গান নয়। নাচবে গাইবে এভাবে সেভাবে গান করবে এসব আসলে হয় না। আধুনিকভাবে লালনের গান উপস্থাপন করার যে প্রবণতা সেটা সঠিক নয়। এই গানগুলো নিভৃতে বসে গাইতে হয়, গভীর উপলব্ধি থেকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়।

 

লালনের গান আজকের প্রজন্ম কীভাবে গ্রহণ করছে বলে মনে করেন?

ফরিদা পারভীন: আজকাল অনেকেই লালন ফকিরের গান গাইছেন। এটা আশার কথা হলেও দুঃখজনক এই যে, এদের অনেকেই গানের বাণী ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না। আবার, অনেকেরই তাল, লয় ঠিক নেই। আমরা গুরুর প্রতি ভালোবাসা থেকে গানটি গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করতাম। এখনকার অনেকের মধ্যে সেই আন্তরিকতা আর ভক্তি নেই। লালনের গানের চর্চাপ্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে আমি সংগীত একাডেমিও প্রতিষ্ঠা করেছি। আমার স্কুলের সন্তানদের শিখিয়েছি ভালোবাসা থেকে গানগুলো গ্রহণ করছে। সত্য কথা সত্যভাবে শিখানোর চেষ্টা করি। সংগীত নিয়ে কোনো প্রতারণা নেই। নতুনদের বলব যতক্ষণ গানটা সঠিক না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ভিতরে গান করার যন্ত্রণা থাকতে হবে, সঠিক ভাবে গাইতে হবে।

 

লালনের গান সংরক্ষণে ১০০ গান নিয়ে একটা বই তৈরির কথা ছিল, সেই উদ্যোগ কতদূর এগিয়েছে?

ফরিদা পারভীন: লালনের অনেক গান এদিকে সেদিক হয়ে গেছে। সেগুলো খুঁজে বের করতে হচ্ছে। অনেক গান মিলিয়ে ফেলেছে, অর্থাৎ এক গানের লাইন আরেক গানে নিয়ে গেছে। শারীরিক অসুস্থতা, বিভিন্ন কারণে সেটি করা শেষ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত আমার গাওয়া সাঁইজির ৭৫ টা গান লিপিবদ্ধ হয়েছে, আরও ২৫টা গান একসঙ্গে করা হবে। কাজ এগোচ্ছে।

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম