০৮:১৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ‘লোক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।

জনশক্তি রপ্তানি: মালয়েশিয়া ‘চক্রের হোতা’ স্বপনের ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ

মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান - বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০৫:৫৮:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩০ বার পড়া হয়েছে

রুহুল আমিন স্বপন। ফাইল ছবি

 

আলোচিত জনশক্তি রপ্তানিকারক রুহুল আমিন স্বপনের ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করার কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

বুধবার এ তথ্য জানিয়ে সিআইডির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বপন মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে জনশক্তি রপ্তানিকারক ‘চক্র বা সিন্ডিকেটের প্রধান’।

বিদেশি শ্রমিক পাঠানোর এজেন্সিগুলোর (জনশক্তি রপ্তানিকারক) সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস-বায়রা এর সাবেক এই মহাসচিব ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯৭ সাল থেকে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করে আসছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ‘লোক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। এই পরিচয়ের বদৌলতে মালয়েশিয়াগামী একেকজন শ্রমিকের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিতে তাদের সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

সিআইডির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সিন্ডিকেটের প্রধান রুহুল আমিন স্বপন ও তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক করেছে সিআইডি।”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মালয়েশিয়ায় জনশক্তি প্রেরণের উদ্দেশ্যে সিন্ডিকেট করে ৮ হাজার কোটি টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন স্বপন। এই টাকায় বাড়ি ও জমিসহ অঢেল সম্পদের মালিক হন তিনি। তিনি এভাবে সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে মানিলন্ডারিং এর অপরাধ করেছে।”

সিআইডি বলেছে, স্বপনের জনশক্তি রপ্তানির প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের নামে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বনানী ও উত্তরা এলাকায় সাতটি দলিলে থাকা সর্বমোট ২৩১ কাঠা জমি ক্রোক করা হয়েছে, যার দলিল মূল্য ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

ওই জমিগুলোর ওপরে থাকা ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন অবকাঠামোসহ সর্বমোট ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার কথা বলেছে সিআইডি।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছিল।

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল-সিআইসি জানায়, বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপন জনশক্তি রপ্তানির আড়ালে অবৈধ উপায়ে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়েছেন। অনুসন্ধানে নেমে তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিময়-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইসির তখনকার মহাপরিচালক খাইরুল ইসলাম বলেছিলেন, আগের সরকারের আমলে স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হলেও বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

ক্ষমতার পালাবদলে সুবাদে সেই অসম্পূর্ণ অনুসন্ধান আবার শুরু হয় এবং এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে বলে তথ্য দেন খাইরুল ইসলাম।

অর্থপাচার, অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় ও মানবপাচারের অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে স্বপনসহ দুই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে গত ২৪ অক্টোবর চিঠি দেয় বাংলাদেশ পুলিশ।

অপর ব্যবসায়ী হলেন-বেস্টিনেট এসডিএন বিএইচডির প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর, যিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মালয়েশিয় নাগরিক।

তবে সিআইসির তদন্তে উঠে আসা সব অভিযোগের সঙ্গে একমত নন ক্যাথারসিসের বিজনেস ডেভলপমেন্ট ব্যবস্থাপক শাহ আজম। এসব অভিযোগের সমাধান হয়ে গেছে বলে দাবি করে তিনি বলছেন, সব কিছুর তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাদের কাছে।

 

যেভাবে হাজার কোটি টাকা লোপাট

স্বপনের এই চক্রের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকার জায়গায় গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেওয়ার তথ্য উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক প্রতিষ্ঠানের জরিপে।

প্রতি কর্মীর কাছ থেকে নিবন্ধন ফি ১০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ২ হাজার ৭০০ টাকা) নেওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হত প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার টাকা।

বিমানের টিকেটের ক্ষেত্রে চক্র বানিয়ে বাড়তি ভাড়া নেওয়া, ই-ভিসা বাবদ ৭ হাজার টাকা, বিএমইটি (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা বাড়তি নিয়েছে আমিন-স্বপন সিন্ডিকেট।

এনবিআর’র সিআইসি মূলত এই সিন্ডিকেটের খবর পেয়েই স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল।

সিআইসির গোয়েন্দারা বলেছেন, এই কাজে মালয়েশিয়ায় তার বড় সহযোগী আমিন নূর, যিনি মালয়েশিয়ায় দাতো শ্রী আমিন নামে পরিচিত।

আমিন নূরের সঙ্গে ‘সিন্ডিকেট’ করে সরকারি খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়তি টাকা নেওয়া, সঠিক কাজ না দেওয়াসহ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়ে অর্থপাচারের নানা অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছেন এই স্বপন।

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে আমিন নূরের সঙ্গে কারসাজি করে ১০০টি এজেন্সির একটি চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

গোয়েন্দারা বলেছেন, শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের জাল-জালিয়াতি, সঠিক কাজ না দেওয়া, নিবন্ধন ও মেডিকেলের নামে বাড়তি অর্থ নেওয়া এবং অর্থপাচারের মত অভিযোগের কারণে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের দরজা বারবার বন্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ হয় তাদের জন্য।

স্বপনের অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে সম্পদ গড়ার তথ্য এলেও সেসবের পুরোপুরি খবর এখনও দেশের গোয়েন্দা সংস্থারও জানার বাইরে। তবে দেশেও গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়, যার পদে পদে রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অসুদপায় অবলম্বন করেছেন তিনি।

 

আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও রুহুল আমিন স্বপনআমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও রুহুল আমিন স্বপন

 

ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের বাইরে স্বপনের মালিকানায় রয়েছে ক্যাথারসিস মেডিক্যাল সেন্টার, ক্যাথারসিস ট্রেইনিং সেন্টার, ক্যাথারসিস ট্রাভেলস, মীম মেডিকেল সেন্টার এবং ক্যাথারসিস ডেভলপমেন্ট লিমিটেড।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্নেহাভাজন হিসেবে পরিচয় তৈরি করেছিলেন স্বপন। সেই প্রভাব খাটিয়ে সিআইসির অনুসন্ধান বন্ধ করতে বারবার চেষ্টাও করেছিলেন ক্যাথারসিসের মালিক।

সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক খাইরুল ইসলাম বলেছিলেন, “আগের সরকারের আমলেই আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। কিন্তু বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়।

“তদন্তের সময় একবার আমাকে সাবেক অর্থমন্ত্রী তার অফিসে ডাকলেন। আমি গিয়ে দেখি, অর্থমন্ত্রীর পাশেই বসে আছেন রুহুল আমিন স্বপন। খুব বিব্রত বোধ করেছিলাম তখন।”

স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান তখন আর এগোতে না পারলেও ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে এসে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার নির্দেশনা দেন সিআইসির মহাপরিচালক।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মূলত মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কোন কোন প্রতিষ্ঠান শ্রমিক পাঠাতে পারবে, তা নিয়েই সিন্ডিকেট করতেন আমিন ও স্বপন।

 

 

মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান – বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ‘লোক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।

জনশক্তি রপ্তানি: মালয়েশিয়া ‘চক্রের হোতা’ স্বপনের ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ

আপডেট সময় ০৫:৫৮:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫

 

আলোচিত জনশক্তি রপ্তানিকারক রুহুল আমিন স্বপনের ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করার কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

বুধবার এ তথ্য জানিয়ে সিআইডির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বপন মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে জনশক্তি রপ্তানিকারক ‘চক্র বা সিন্ডিকেটের প্রধান’।

বিদেশি শ্রমিক পাঠানোর এজেন্সিগুলোর (জনশক্তি রপ্তানিকারক) সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস-বায়রা এর সাবেক এই মহাসচিব ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯৭ সাল থেকে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করে আসছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ‘লোক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। এই পরিচয়ের বদৌলতে মালয়েশিয়াগামী একেকজন শ্রমিকের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিতে তাদের সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

সিআইডির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সিন্ডিকেটের প্রধান রুহুল আমিন স্বপন ও তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক করেছে সিআইডি।”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মালয়েশিয়ায় জনশক্তি প্রেরণের উদ্দেশ্যে সিন্ডিকেট করে ৮ হাজার কোটি টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন স্বপন। এই টাকায় বাড়ি ও জমিসহ অঢেল সম্পদের মালিক হন তিনি। তিনি এভাবে সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে মানিলন্ডারিং এর অপরাধ করেছে।”

সিআইডি বলেছে, স্বপনের জনশক্তি রপ্তানির প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের নামে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বনানী ও উত্তরা এলাকায় সাতটি দলিলে থাকা সর্বমোট ২৩১ কাঠা জমি ক্রোক করা হয়েছে, যার দলিল মূল্য ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

ওই জমিগুলোর ওপরে থাকা ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন অবকাঠামোসহ সর্বমোট ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার কথা বলেছে সিআইডি।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছিল।

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল-সিআইসি জানায়, বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপন জনশক্তি রপ্তানির আড়ালে অবৈধ উপায়ে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়েছেন। অনুসন্ধানে নেমে তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিময়-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইসির তখনকার মহাপরিচালক খাইরুল ইসলাম বলেছিলেন, আগের সরকারের আমলে স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হলেও বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

ক্ষমতার পালাবদলে সুবাদে সেই অসম্পূর্ণ অনুসন্ধান আবার শুরু হয় এবং এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে বলে তথ্য দেন খাইরুল ইসলাম।

অর্থপাচার, অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় ও মানবপাচারের অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে স্বপনসহ দুই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে গত ২৪ অক্টোবর চিঠি দেয় বাংলাদেশ পুলিশ।

অপর ব্যবসায়ী হলেন-বেস্টিনেট এসডিএন বিএইচডির প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর, যিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মালয়েশিয় নাগরিক।

তবে সিআইসির তদন্তে উঠে আসা সব অভিযোগের সঙ্গে একমত নন ক্যাথারসিসের বিজনেস ডেভলপমেন্ট ব্যবস্থাপক শাহ আজম। এসব অভিযোগের সমাধান হয়ে গেছে বলে দাবি করে তিনি বলছেন, সব কিছুর তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাদের কাছে।

 

যেভাবে হাজার কোটি টাকা লোপাট

স্বপনের এই চক্রের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকার জায়গায় গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেওয়ার তথ্য উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক প্রতিষ্ঠানের জরিপে।

প্রতি কর্মীর কাছ থেকে নিবন্ধন ফি ১০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ২ হাজার ৭০০ টাকা) নেওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হত প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার টাকা।

বিমানের টিকেটের ক্ষেত্রে চক্র বানিয়ে বাড়তি ভাড়া নেওয়া, ই-ভিসা বাবদ ৭ হাজার টাকা, বিএমইটি (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা বাড়তি নিয়েছে আমিন-স্বপন সিন্ডিকেট।

এনবিআর’র সিআইসি মূলত এই সিন্ডিকেটের খবর পেয়েই স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল।

সিআইসির গোয়েন্দারা বলেছেন, এই কাজে মালয়েশিয়ায় তার বড় সহযোগী আমিন নূর, যিনি মালয়েশিয়ায় দাতো শ্রী আমিন নামে পরিচিত।

আমিন নূরের সঙ্গে ‘সিন্ডিকেট’ করে সরকারি খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়তি টাকা নেওয়া, সঠিক কাজ না দেওয়াসহ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়ে অর্থপাচারের নানা অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছেন এই স্বপন।

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে আমিন নূরের সঙ্গে কারসাজি করে ১০০টি এজেন্সির একটি চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

গোয়েন্দারা বলেছেন, শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের জাল-জালিয়াতি, সঠিক কাজ না দেওয়া, নিবন্ধন ও মেডিকেলের নামে বাড়তি অর্থ নেওয়া এবং অর্থপাচারের মত অভিযোগের কারণে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের দরজা বারবার বন্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ হয় তাদের জন্য।

স্বপনের অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে সম্পদ গড়ার তথ্য এলেও সেসবের পুরোপুরি খবর এখনও দেশের গোয়েন্দা সংস্থারও জানার বাইরে। তবে দেশেও গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়, যার পদে পদে রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অসুদপায় অবলম্বন করেছেন তিনি।

 

আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও রুহুল আমিন স্বপনআমিনুল ইসলাম বিন আমিন নূর ও রুহুল আমিন স্বপন

 

ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের বাইরে স্বপনের মালিকানায় রয়েছে ক্যাথারসিস মেডিক্যাল সেন্টার, ক্যাথারসিস ট্রেইনিং সেন্টার, ক্যাথারসিস ট্রাভেলস, মীম মেডিকেল সেন্টার এবং ক্যাথারসিস ডেভলপমেন্ট লিমিটেড।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্নেহাভাজন হিসেবে পরিচয় তৈরি করেছিলেন স্বপন। সেই প্রভাব খাটিয়ে সিআইসির অনুসন্ধান বন্ধ করতে বারবার চেষ্টাও করেছিলেন ক্যাথারসিসের মালিক।

সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক খাইরুল ইসলাম বলেছিলেন, “আগের সরকারের আমলেই আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। কিন্তু বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়।

“তদন্তের সময় একবার আমাকে সাবেক অর্থমন্ত্রী তার অফিসে ডাকলেন। আমি গিয়ে দেখি, অর্থমন্ত্রীর পাশেই বসে আছেন রুহুল আমিন স্বপন। খুব বিব্রত বোধ করেছিলাম তখন।”

স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান তখন আর এগোতে না পারলেও ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে এসে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার নির্দেশনা দেন সিআইসির মহাপরিচালক।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মূলত মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কোন কোন প্রতিষ্ঠান শ্রমিক পাঠাতে পারবে, তা নিয়েই সিন্ডিকেট করতেন আমিন ও স্বপন।

 

 

মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান – বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম