জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকতেই অন্তত চারবার বড় ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি।
জাতীয় পার্টিতে ‘গড়ার’ পালায় ফের ভাঙনের খেলা

- আপডেট সময় ১২:২৭:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫
- / ৪২ বার পড়া হয়েছে

আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির সম্মেলন হলেও সেখানে ছিলেন না দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের অনুসারীরা।
ভাঙা-গড়ার মধ্যেই এবার জাতীয় পার্টির দুটি অংশের নেতারা মিলিত হয়েছেন এক বিন্দুতে।
তবে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটিতে উত্তরসূরি তার ভাই জি এম কাদের ও তার অনুসারীরা বলছেন, তারাই ‘মূল’ দল।
‘ঐক্য সম্মেলন’ বলা হলেও আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি অন্য খণ্ডগুলো।
অর্থাৎ জাতীয় পার্টিতে ‘আনিসুল-রওশনপন্থি’ হিসেবে আরেক অংশের আবির্ভাব ঘটল। প্রথমবারের মতো ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে ষষ্ঠবারের মতো ভাঙন দেখল জাতীয় পার্টি।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ অভিযোগ করে বলেছেন, “২৮ জুন আপনি (জিএম কাদের) বলেছিলেন, আপনি কাউন্সিল করবেন। কাউন্সিল যদি করার ইচ্ছা থাকত, আজকে যেভাবে করা হয়েছে, এভাবেও তো কাউন্সিল করা যেত। কিন্তু তিনি যখন বুঝেছেন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। তিনি আর কাউন্সিল করেননি।”

আনিসুল-রওশনপন্থিদের ঐক্যের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে এক অনুষ্ঠানে জি এম কাদেরপন্থি জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “ইতিহাস বলে, মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে যারা জাতীয় পার্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছেন, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়েছেন।
“জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেবে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জিএম কাদেরের অনুসারীরা।”
আনিসুল-রওশপন্থিদের ঐক্য সম্মেলন
২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির সবশেষ সম্মেলন হয়েছিল। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে ২০২৪ সালের মার্চে এরশাদের সহধর্মিণী জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সম্মেলন করে আলাদা কমিটি করা হয়। সে সম্মেলনকে দশম সম্মেলন হিসেবে ঘোষণা করেন রওশনপন্থিরা। সেসময়ও জি এম কাদের দাবি করেন, তারাই মূল দল।

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টি কোণাঠাসা হয়ে পড়ে। দলের ভেতরে দেখা দেয় অস্থিরতা।
এর জেরে ছয় বছর পর শনিবার রাজধানীর ইমানুয়েল কনভেনশন সেন্টারে সম্মেলন করেছেন আগে জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং রওশনের সঙ্গে থাকা কাজী ফিরোজ রশিদ চৌধুরী ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।
তারা এ সম্মেলনকে দশম জাতীয় সম্মেলন বলেছেন। এখানে জি এম কাদের ও তার অনুসারীরা ছিলেন না।
সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দলের চেয়ারম্যান ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন।
তারা দুজনেই সবশেষ ছিলেন জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের অংশে। আনিসুল মাহমুদ ছিলেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও রুহুল আমিন ছিলেন কো-চেয়ারম্যান।
রাজধানীর ইমানুয়েল কনভেনশন সেন্টারে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে আয়োজিত হয় জাতীয় পার্টির সম্মেলন।
এদিন কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের আহ্বায়ক মো. জহিরুল ইসলাম জাতীয় পার্টির নতুন নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের নাম ঘোষণা করেন।
তিন সদস্যের ওই নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সদস্য হলেন- মোস্তফা আল মাহমুদ ও আরিফুর রহমান খান।
কাউন্সিলে সারাদেশ থেকে আসা প্রায় তিন হাজার কাউন্সিলরদের কণ্ঠভোটে নতুন সভাপতি-মহাসচিব পদে নির্বাচিত হন আনিসুল ইসলাম-রুহুল আমিন।
আর রওশন এরশাদপন্থি অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদকে করা হয়েছে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এবং কাদেরের অংশে মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে আনিসুল-রওশনপন্থিরা একীভূত হল।
যেভাবে নতুন করে অস্থিরতা শুরু
গত ৭ জুলাই সে সময়ের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ দলের ১০ নেতাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
পরে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা আদালতের দ্বারস্থ হলে ৩১ জুলাই জি এম কাদের এবং যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত।

পরে জি এম কাদেরের অব্যাহতি দেওয়া দপ্তর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দলের কো চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার কথা বলা হয়।
এর তিন দিন পর গুলশান অ্যাভেনিউয়ের হাওলাদার টাওয়ারের হলরুমে সাংবাদিকদের সামনে এক মঞ্চে এসে জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা দেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নু।
সেখানে বলা হয়, তারা আদালতের নির্দেশে দলের পদে বহাল হয়েছেন এবং তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া জি এম কাদের দলীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন।
চুন্নু সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বলেছিলেন, দলকে সাংগঠনিক স্থবিরতা থেকে ‘মুক্ত করতে’ প্রেসিডিয়াম সভায় অতি দ্রুত এই জাতীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যে জাতীয় পার্টি নিয়ে সম্প্রতি ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি হয়েছিল, সেই দল সম্মেলনের মাধ্যমে ‘দায়িত্বশীলতা, শৃঙ্খলা ও ঐক্যের’ বার্তা নিয়ে দেশবাসীর সামনে ‘নতুন করে আত্মপ্রকাশ করছে’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
যেভাবে নেতৃত্বে আনিসুল-রুহুল
সাবেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর থেকেই বেকায়দায় আছে।
জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে সম্প্রতি জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিলে জাতীয় পার্টি ফের ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে।
২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলন দিন ঠিক করেছিলেন জি এম কাদের নেতৃত্বাধীন দলটি। কিন্তু শেষমেষ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই তারিখে প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকায় অনুমতি দেওয়া যাবে না। এরপর জি এম কাদের সম্মেলন স্থগিত করে দেন।

এর আগেই আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। চুন্নুও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তারা। সেজন্য এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশের নেতাদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করেন।
বিরোধীদের সম্মেলনের পাল্টায় নিজের শক্তির জানান দিতে ২৮ জুন দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে বসেন জি এম কাদের।
তবে শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষই পিছু হটে, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্মেলন বা মহাসমাবেশ কোনোটিই হয়নি। এরপরই আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু ও রুহুল আমিন হাওলাদারসহ ১০ নেতাকে অব্যাহতি এবং তাদের আদালতে দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটে।
পার্টির কর্মীদের একটি অংশের মধ্যে একটি চালু ধারণা হল, বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জি এম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যেহেতু নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেজন্য পার্টির ভেতরে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য পুরোনো ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের যুক্ত করতে হবে।
মূলত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদাররা।
শনিবারের সম্মেলনে তাই দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন আনিসুল-চুন্নু।
আনিসুল ইসলাম আগেই স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জি এম কাদের ‘একাই সবকিছু’ করতে চান। এর পরিবর্তন চান তারা।
“মেইন জিনিস হচ্ছে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই। পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই।”
জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির নতুন নেতৃত্ব গঠনের একটি প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন।
গত ২০ জুন বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় পার্টিকে বাদ দিতে পারছে না। কাজেই জি এম কাদের মাইনাস হয়ে জাতীয় পার্টি–সেটা হল সরকারের পলিসি টু কাম কামিং ইলেকশন।
“বিএনপি-জামায়াত ওরা আওয়ামী লীগকে থাকতে দেবে না। আর জাতীয় পার্টিকেও বাদ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু পারছে না, সেহেতু জি এম কাদের মাইনাস, সেটা তারা চায়। কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে লাঙ্গলও পাবে, এটা তারা বলে বেড়াচ্ছে।”
জাতীয় পার্টিতে যত ভাঙন
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো শামসুল হুদা চৌধুরী ও এম এ মতিনের নেতৃত্বে ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। আলাদা হয়ে যাওয়া অংশটি এখন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন) নামে সক্রিয়।
১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা ভাঙন হয়। তাদের নেতৃত্বাধীন দলটির নাম জাতীয় পার্টি (জেপি)।
২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে তৃতীয় দফা ভাঙন, তখন মতিন তার সঙ্গে যোগ দেন। তবে পরে মতিন আলাদা হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন) নামে সক্রিয় হন।
অন্যদিকে নাজির রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে আছে তার ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে জাপায় চতুর্থবারের মত ভাঙে জাতীয় পার্টি।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সবশেষ জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।
এরপর শনিবারের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে নতুন করে এক হলেন রওশন আর আনিসুলপন্থি নেতারা।
সম্মেলনে জাতীয় পার্টির এই দুই অংশ ছাড়াও সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টি-জেপি সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য দিদারুল আলম দিদার, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয়।
মইদুল হাসান – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম