“ফাউন্ডেশনকে দ্রুত দায়িত্বশীল ও দক্ষ ব্যক্তিদের হাতে হস্তান্তর করে আহত, শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দরকার,” বলেন উমামা ফাতেমা।
তহবিল সংকটে পড়া জুলাই ফাউন্ডেশন কতদূর যাবে?

- আপডেট সময় ১১:৫২:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
- / ৩৬ বার পড়া হয়েছে
ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটানো জুলাই আন্দোলনের হতাহতদের জন্য যে ফাউন্ডেশন গড়া হয়েছিল, পরের জুলাই মাসে আর্থিক সংকটে সেই সংস্থায় দেখা দিয়েছে ‘স্থবিরতা’।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন বলছে, গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের সহায়তার জন্য প্রাথমিকভাবে ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু চলতি জুলাই পর্যন্ত এসেছে ১১৯ কোটি ৪২ টাকার তহবিল। ফলে পরিকল্পনা মাফিক সহায়তার হাত বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
গত সেপ্টেম্বরে এ ফাউন্ডেশন যেসব কার্যক্রমের কথা বলে যাত্রা করে, তার মধ্যে রয়েছে- আহতদের জরুরি আর্থিক সহায়তা, শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন, মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেবা।
তবে সংস্থাটি এখনো সব কার্যক্রম নিয়ে ডানা মেলাতে পারেনি। আর্থিক সহায়তাও দিতে পারেনি সবাইকে; আর যারা পেয়েছেন, তারা বলছেন–সহায়তা পর্যাপ্ত নয়।
এর মধ্যে শাহবাগে ফাউন্ডেশন কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে একদল জুলাই যোদ্ধা। সময় মত সহায়তা না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে গত ৮ জুলাই এ হামলার ঘটনা ঘটে।
জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামাল আকবর বলেন, “ফাউন্ডেশন এখনও স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছেনি। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের একটা ডিজিটাল বাজেট কোড নম্বর থাকে, যার অনুকূলে বাজেট বরাদ্দ হয়। আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান না, তাই আমাদের কোনো কোড নম্বর নাই।
“এ কারণে তহবিল পেতে সমস্যা হচ্ছে। ফান্ড পেতে ঝামেলার মূল কারণ এটা। আমরা এখন সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু ফান্ড পাই।
“তবে আমরা আশা করি, আগামীতে অনুদান পাব। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ১২টি ব্যাংক আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল করেছেন। বেসরকারি কিছু ডোনেশনও আসবে। এছাড়া আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, সেখান থেকে সহায়তাও আসবে।”

২০২৪ সালের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্রদের আন্দোলন শেষমেশ সরকার উৎখাতের ইতিহাস গড়ে। সেই আন্দোলনে ৫ অগাস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন সাড়ে ১৫ বছর দেশ চালিয়ে আসা শেখ হাসিনা।
শুরুতে এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সরকারের তরফে জবাব ছিল- গুলি, টিয়ারশেল আর লাঠি; এককথায় কেবলই বলপ্রয়োগ।
প্রথমে ফেইসবুক, পরে ইন্টারনেট বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় সরকার। তাতে হিতে বিপরীত হয়। আন্দোলনে রক্তপাত শুরু হওয়ার ২০ দিনের মধ্যেই লাশ আর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে পতন হয় দেড় দশকের আওয়ামী লীগ সরকারের। পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের যে তালিকা সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে; সেখানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪ এবং আহতের সংখ্যা ১৩ হাজার ৮১১।
জুলাই ফাউন্ডেশনের যাত্রা
গণঅভ্যুত্থানে বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হওয়ায় সহায়তার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের সভাপতি হিসেবে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। প্রতিষ্ঠার সময় এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন শহীদ মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।
সারা বিশ্বে তহবিল সংগ্রহের মাধ্যম এ ফাউন্ডেশন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও আর্থিক সহায়তা, শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসা সহায়তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষমতায়নের লক্ষ্য ঠিক করে। সেই সঙ্গে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রতিটি শহীদের নামে স্মৃতিফলক স্থাপন, জাতীয় পর্যায়ে স্মরণ কর্মসূচি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির পরিকল্পনা করে।
ফাউন্ডেশন নগদ অর্থ সহায়তা ছাড়া চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সরাসরি কোনো অর্থ খরচ করে না। চিকিৎসার কাজটি করে থাকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পুনর্বাসনে এগিয়ে আসছে, তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি করে দেয় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন।
এই ফাউন্ডেশনের প্রধান লক্ষ্য শহীদ পরিবার এবং আহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া। এজন্য গেজেটভুক্ত শহীদদের পরিবারের কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পরিবারকে দেওয়া হয় সহায়তা।
আর আহত যোদ্ধাদের ক্ষেত্রে আর্থিক অনুদানের ফরমে আবেদন নেওয়া হয়। ওই ব্যক্তি প্রকৃত অর্থেই আহত কি না তা যাচাই-বাছাই শেষে বুঝিয়ে দেওয়া হয় আর্থিক সহায়তা।
জুলাই ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৮৩৪ শহীদের মধ্যে ৮০৬ জনের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর সরকারের তালিকাভুক্ত আহতদের মধ্যে ৬৬৯১ জন আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এ সহায়তার জন্য আবেদন করেন মোট ৮৭৬৮ জন।

সহায়তা নিয়ে অসন্তোষ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে— এ, বি ও সি; অর্থাৎ অতি গুরুতর আহত, গুরুতর আহত ও আহত।
এ শ্রেণির আহতদের প্রথম ধাপে এক লাখ এবং দ্বিতীয় ধাপে তিন লাখসহ মোট ৪ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। বি শ্রেণির প্রথম ধাপে এক লাখ এবং দ্বিতীয় ধাপে দুই লাখসহ মোট তিন লাখ টাকা পাওয়ার কথা। আর সি শ্রেণির আহতদের দুই ধাপে পাওয়ার কথা এক লাখ করে মোট দুই লাখ টাকা।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহতদের সবাইকে এখনও সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে আহত যোদ্ধাদের অসন্তোষ রয়েছে। তা নিয়ে প্রায়ই জুলাই ফাউন্ডেশনে আসছেন আহত; ঘটছে ছোটখাট অপ্রীতিকর ঘটনা।
আন্দোলনের মধ্যে গত বছরের ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ইসদাইর এলাকার মোহাম্মদ রুবেলের শরীরে লাগে ছররা গুলি। দ্বিতীয়বার ৪ অগাস্ট চোখে, মাথায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। রুবেল বাম চোখে আর দেখেন না; মস্তিষ্কে এখনও পিলেট রয়ে গেছে। তার চিকিৎসা হয়েছে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। এই অবস্থায় তিনি বাসায় আছেন, মাঝেমধ্যে ফলোআপে হাসপাতালে যান।
মোহাম্মদ রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বছরের ৯ অগাস্ট থেকে তিনি সরকারি তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর আগে তাকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। সেখানে প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তাকে চার লাখ টাকা দেওয়ার কথা, পেয়েছেন তিন লাখ।
“প্রথমবার এক লাখ টাকা দিয়েছে গত বছরের অক্টোবর মাসে, দুই লাখ এই বছরের মার্চ মাসে। আরও এক লাখ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু জুলাই ফাউন্ডেশন বলছে- তাদের ফান্ড নাই। এ কারণে আমি আর যাই নাই। এর মধ্যে আবার মারামারি হয়েছে, এ কারণে আরও যাই না। আমার পুনর্বাসনের বিষয়ে এখনও কিছু করে নাই।”
গত বছরের ৪ অগাস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় সিলেটের বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন মিজানুর রহমান নামে এক কলেজ ছাত্র। গুলি লেগে ডান চোখে আর একদমই দেখতে পান না। আর বাম চোখেও এখন কম দেখেন তিনি।

মিজানুর বলেন, এ পর্যন্ত জুলাই ফাউন্ডেশন দুই কিস্তিতে তিন লাখ টাকা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তার আরও দুই লাখ টাকা পেয়েছেন তিনি।
“সহায়তা পাওয়ার এই প্রক্রিয়াটি ধীর। তারা খুব স্লো কাজ করছে। একজনের একটা ফরম জমা দিয়েছে, তার দেড় মাস লেগেছে। আমার প্রথম চেক পেতে তিন মাস লেগেছিল প্রক্রিয়া হতে। কারও তো টাকা নাই, বেশিরভাগই গরিব মানুষ।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ অগাস্ট সাভারে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়ার।
তার বাবা আবুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার আমাদের জন্য যা করেছে, সেটা না করলেও কিছু করার ছিল না। আবার এখন যা করছে, সেটাও সন্তোষজনক বলা যাবে না।”
তিনি বলতে থাকেন, “সরকার আমাদের যে অনুদান দিয়েছে তা দিয়ে কী করতে পারব? এখানে ম্যাক্সিমাম ফ্যামিলির অবস্থা খুব খারাপ। কারও বাড়িঘর নাই, কারও জমিজমা নাই।
“আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছে, সেখান থেকে প্রতি মাসে ৯ হাজার ৩০০ টাকার মত পাই।”
‘রেশনিং করতে হচ্ছে’
জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল আকবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিহতদের পরিবার ও আহতদের সহায়তার জন্য প্রাথমিকভাবে ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও এসেছে ১১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে এসেছে ১০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ কোটি এবং বিভিন্ন উৎস থেকে আরও ১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে।
এ তহবিল থেকে জুলাইয়ে শহীদদের পরিবার এবং আহতদের নগদ অর্থ সহায়তা, চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও আইনগত সহায়তায় ব্যয় করছে জুলাই ফাউন্ডেশন।
কামাল আকবর বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তহবিল থেকে ১১১ কোটি টাকা সহায়তা হিসাবে দেওয়া হয়েছে। শহীদ পরিবারের যারা এখনও সহায়তা পায়নি, তাদের জন্য ৫ লাখ টাকা করে রেখে দেওয়া হয়েছে।
জুলাই ফাউন্ডেশন আহতদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সহায়তা দেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছে, তা বাস্তবায়ন করতেই ২৫০ কোটি টাকা লাগবে বলে জানান তিনি।
ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কামাল আকবর বলেন, এখন তহবিলে যে টাকা আছে তা আহতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
“পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকায় আমাদের এই রেশনিংটা করতে হচ্ছে। সেটা করতে গিয়ে যারা শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং আর্থিকভাবেও সঙ্গতি নেই- এমন লোকদের প্রাধান্য দিচ্ছি। এটা করতে গিয়েই আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছি।”
ক্ষোভ থেকে ভাঙচুর
গত ৮ জুলাই শাহবাগে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কামাল আকবর বলছেন, সহায়তার দ্বিতীয় ধাপের টাকা দিতে দেরি হওয়ায় আহত যোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়েছেন।
এ ফাউন্ডেশনের তহবিলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমাও।
ফাউন্ডেশনে হামলার ঘটনার রাতে তিনি ফেইসবুকে বলেন, শহীদ ও আহত পরিবারের সেবা দেওয়ার জন্য তৈরি হলেও দায়িত্ব পালনে ফাউন্ডেশন ‘পুরোপুরি ব্যর্থ’। ফাউন্ডেশনে কীভাবে টাকা এসেছে, কীভাবে বিতরণ হয়েছে, কতজন পেয়েছে আর কতজন পাওনা আছে- এসব কিছুই ‘স্পষ্ট নয়’।
“অর্ধেকের বেশি আহতরা ফাউন্ডেশনের প্রথম ধাপের টাকাই পায়নি। এসবের মধ্যে আজকে ফাউন্ডেশনের অফিসে ভাঙচুর হলো। অভ্যুত্থানের এক বছর পরও আহতদের তালিকা তারা করতে পারেনি, পুরো প্রক্রিয়াটার গোঁজামিল অবস্থা। ফাউন্ডেশনকে দ্রুত দায়িত্বশীল ও দক্ষ ব্যক্তিদের হাতে হস্তান্তর করে আহত, শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দরকার।”
প্রতারকরাও সক্রিয়
জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পেতে কাগজপত্র জাল করে জুলাই যোদ্ধা হওয়া, ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা জুলাই আহতদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে। জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে আহতদের তালিকায় ওঠানো কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া প্রতারণার অভিযোগে মামলাও করেছে জুলাই ফাউন্ডেশন।
গত এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে ফাউন্ডেশন জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত দাবি করে অনেকে আবেদন করেছে। সেসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে ১৯ জনকে চিহ্নিত করেছে ফাউন্ডেশন, যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়ার ভুয়া কাগজপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো জমা দিয়েছিলেন। প্রতারণায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে জুলাই ফাউন্ডেশন।
জুলাই আহতদের সহায়তার টাকা আত্মসাতের অন্তত একশ অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে ফাউন্ডেশন।

গত বছরের জুলাইয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে পুলিশের গুলিতে আহত আবদুস সালাম মুন্না বলেন, সহায়তা হিসেবে গত মার্চ মাসে ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকার চেক পেয়েছিলেন তিনি। তবে প্রতারণা করে সেই টাকার অর্ধেক নিয়ে গেছেন সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া এক নারী। ওই টাকা তিনি এখনও উদ্ধার করতে পারেননি। মুন্না ওই নারীর সহায়তায় ফাউন্ডেশনে কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন।
“কাগজ জমা দেওয়ার সময় এক হাজার টাকা উনি ভাড়া হিসেবে নেন। ফাউন্ডেশন আমারে এক লাখ টাকার চেক দেয়। কিন্তু আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর নাই। তিনি কইলেন, তার এক খালার অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে সেখান থেকে টাকা তুলে আমাকে দেবেন। তবে টাকা তোলার পর আমাকে ৫০ হাজার দিছেন, বাকি ৫০ হাজার পাই নাই। টাকা চাইলে বলে, সে আমাদের জন্য কাজ করেছে, এজন্য বাকি টাকা আর দেবে না।”
যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই দিলশাদ আফরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বিরুদ্ধে ৯০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে। পুরো কাজটাই করা হয়েছে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে।
“আত্মসাৎ করার করার ইচ্ছা থাকলে কোটি টাকা কামাইতাম। সমন্বয়কদের অনেকেই তা করছে। এই ফাউন্ডেশনের কোনো কর্মকর্তা ছিলাম না, তাহলে আমি জুলাই ফাউন্ডেশনের টাকা কীভাবে আত্মসাৎ করলাম? কারা করেছে তা জানি, কিন্তু এখন সেটা বলতে চাই না।”
পদ ছেড়েছে শুরুর নেতৃত্ব
শুরুতে জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক করা হয় আন্দোলনে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর জমজ ভাই স্নিগ্ধকে। পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা সারজিস আলমকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে স্নিগ্ধকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়েন সারজিস আলম। দায়িত্ব পালনে ‘প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’ জানিয়ে তিনি সরে দাঁড়ান।
মাস তিনেক পরে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব ছাড়েন মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। তার ভাষ্য, তিনি যখন দায়িত্ব নেন তখন, একটা ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ অবস্থা ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দায়িত্ব ছেড়েছেন।
“ফাউন্ডেশনটা দাঁড় করাতে আমাদের দায়িত্ব নেওয়া দরকার ছিল। অভ্যুত্থানের ৯ মাস পরে আমার মনে হয়েছে ফাউন্ডেশনটি একটা পর্যায়ে এসেছে, ফাউন্ডেশনকে একটা ট্রাকের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া গেছে। এখন শুধু সুন্দর মত চালানোটা বিষয়। এছাড়া আমাদের পার্সোনাল লাইফ, আমার মাস্টার্স বাকি আছে, পড়ালেখায় ফেরত যেতে হবে। যে কারণে ফাউন্ডেশন ছাড়ার সিদ্ধান্ত। কোনো দ্বন্দ্ব বা অন্য কিছু ছিল না।”
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশনে কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে প্রতারক চক্র আছে; বিভিন্নভাবে তালিকায় নাম ওঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আহতদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে, হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা দিতে অনীহার মতো কিছু সমস্যা আছে। এছাড়া তাদের পুনর্বাসন করতে গিয়েও নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয়।
তিনি বলেন, আহতদের সরকারি-বেসরকারি চাকরি দিয়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছেন তারা। তবে শহীদ পরিবার বা আহতদের বেশিরভাগেই প্রত্যাশা থাকে সরকারি চাকরির।
“আমরা অনেক বেসরকারি চাকরি ম্যানেজ করেছি, অনেককে দিয়েছি। আমরা ফরম ছেড়েছি, যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তাদের প্রথম প্রশ্ন থাকে- এটা সরকারি না বেসরকারি। বেসরকারি চাকরি হলে তারা আর কোনো যোগাযোগ করেন না,” বলছিলেন স্নিগ্ধ।

চিকিৎসা আর পুনর্বাসনই চ্যালেঞ্জ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কামাল আকবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফাউন্ডেশন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। এই মুহূর্তে ফাউন্ডেশনের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে- আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।
“আহতরা এমন একটা মনস্তাত্ত্বিক জায়গায় আছেন, সেটা তারা মেনে নিতে পারছেন না। এই মানসিক অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো বিরাট চ্যালেঞ্জ।”
তিনি বলেন, “এটা না হলে প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির জায়গায় বিরাট একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। যার একটা পা বা একটা হাত নেই, তিনি ফ্যামিলির কাছে বোঝা হয়ে আছেন। আহতদের অনেককে তাদের স্ত্রী ডিভোর্স দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
“প্রত্যেকের কাহিনীই খুবই দুঃখের, আমরা তো শুধু একটা পার্ট দেখছি। এই মানুষগুলোকে ঠিক রাখা, তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া- যদিও এই মুহূর্তে আমাদের কাছে ফান্ড নাই।”
কামাল আকবর বলেন, আহতদের পুনর্বাসনে সহায়তা করতে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। এসএমই ফাউন্ডেশন ও আইসিটি বিভাগের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে জুলাই ফাউন্ডেশন। আহতদের কয়েকজনের ট্রেনিংও শুরু হয়েছে।
“রোববার থেকে বিকেএসপিতে ১২ জনের একটা ট্রেনিং শুরু হয়েছে। ট্রেনিং শেষে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্যারা অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। মঙ্গলবার সকালে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং জুলাইয়ে আহতদের আরেকটা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হবে। এসএমই ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এতে ২০ জন নারী অংশ নেবেন। আর প্রশিক্ষণের জন্য এ পর্যন্ত ১৭০০ জনকে তালিকাভুক্ত করেছে আইসিটি বিভাগ; সেটাও শুরু হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কামাল আকবর বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশনের তহবিলের নিয়ে কোনো অস্বচ্ছতা নেই।
“তহবিলের অডিট হয়েছে। বাইরে অনেক কিছুই আলোচনা হয়; কিন্তু ভেতরে ঘটনা অনেক সময় এমন হয় না। আগের সিইও একটা যুদ্ধকালীন সময় পার করেছেন। সে সময় তাদের জন্য কাজটা কঠিন ছিল। টাকা কারও কাছে চলে গেছে, এমন না।”
সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম