“তিনি কেন কমিউনিস্ট হলেন না? আমার মনে হয়, ‘বাস্তববাদিতার’ কারণে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন,” বলেন এ বামপন্থি বুদ্ধিজীবী।
তাজউদ্দীন ‘প্রত্যক্ষ’ হতে চাননি, সামনে রেখেছেন মুজিবকে: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

- আপডেট সময় ১২:০০:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
- / ৩০ বার পড়া হয়েছে
‘বাস্তববাদিতার’ কারণে তাজউদ্দীন আহমদ কমিউনিস্ট পার্টিতে না গিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন বলে ‘মনে করেন’ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
বুধবার ঢাকায় তাজউদ্দীনকে নিয়ে করা এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “তিনি কখনো নেতা হতে চাননি; তিনি জনতার সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছেন। তাজউদ্দীন কখনো প্রত্যক্ষ হতে চাননি, এটা বাস্তববাদিতা। তিনি শেখ মুজিবকেই সামনে রেখেছেন। অন্যরা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলতেন। তাজউদ্দীন বলতেন ‘মুজিব ভাই’।
“তাজউদ্দীনের বন্ধুরা প্রায় সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। তাহলে তাজউদ্দীন কেন আওয়ামী লীগে গেলেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে গেলেন না? তাজউদ্দীন কেন কমিউনিস্ট হলেন না? আমার মনে হয়, ‘বাস্তববাদিতার’ কারণে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন।“
তিনি বলেন, “তাজউদ্দীন স্থানীয় মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন, তা তার ডায়েরি পড়লেই বোঝা যায়।”
তাজউদ্দীনের চেতনার মধ্যেই সমাজতন্ত্র ছিল মন্তব্য করে সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, তা আসলে সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা থেকে গড়ে উঠেছিল।
“সব নাগরিকের মধ্যে সাম্য ও সমতার সুযোগ থাকতে হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এই যে গণতন্ত্র, সেটাই আসলে সমাজতন্ত্র। তাজউদ্দীন, তা বাস্তবাবাদিতা থেকে বুঝেছিলেন।”
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে ‘ব্যক্তি মালিকানা’, তার দিন শেষ হয়ে আসছে এবং আগামীর পৃথিবীতে ‘সামাজিক মালিকানা’র দিকে যেতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এ অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “আজ গোটা পৃথিবী বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদীরাই এখন পৃথিবী নিয়ে শঙ্কিত। তবে পুঁজিবাদই তো শেষ কথা নয়। তাহলে কোন ব্যবস্থায় মানুষের মুক্তি আসবে? সেটা হলো সামাজিক মালিকানা।
“আজ ব্যক্তি মালিকানা এমন পর্যায়ে গেছে, যে ট্রাম্পের মত ‘ক্রিমিনালের’ হাতে ক্ষমতা চলে গেছে। ফিলিস্তিনে হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ট্রাম্প সেই হত্যাকে সহযোগিতা করছে।”
বাংলা মোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান হয়। আলোচনায় আরও অংশ নেন মোরশেদ শফিউল হাসান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, কাজল রশীদ শাহীন, আলমগীর খান, আরিফ খান, শুভ কিবরিয়া ও আলমগীর কবির।
অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গওহর নঈম ওয়ারা, শহীদুল্লাহ ফরায়জীও। সঞ্চালনা করেন ইমরান মাহফুজ।
অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয় ‘অনিবার্য তাজউদ্দীন আহমদ’ স্মরণিকা সংকলন। এটি সম্পাদনা করেছেন ইমরাজ মাহফুজ।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, “পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে ব্যক্তি মালিকানার দিন শেষ হয়ে আসবে, সামাজিক মালিকানার দিকে যেতে হবে, তাজউদ্দীন সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।
“তাজউদ্দীন সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, সেটা স্বপ্ন ছিল। মানুষ তো কেবল ভাত খেয়ে বাঁচেন না। মানুষ স্বপ্নকে নিয়েই বাঁচেন। তাজউদ্দীনও সেই স্বপ্ন দেখতেন।”
তাজউদ্দীনের স্বপ্নের উপরই ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ’ নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ১০০তম জন্মদিন ছিল বুধবার। ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুরের কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বুধবার বিকাল ৫টায় সাহিত্যকাগজ ‘কালের ধ্বনি’ আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য সারথী ; শতবর্ষে তাজউদ্দীন আহমদ শীর্ষক অনুষ্ঠান।
কেন তাজউদ্দীন আহমদ হারিয়ে গেলেন, অনুষ্ঠানে সেই প্রশ্নও তোলেন এই চিন্তক।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “মওলানা ভাসানীও হারিয়ে গেছেন। কেন হারিয়ে গেলেন? আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সভাপতি? তার কথা কোথাও এখন বলা হয় না। তাজউদ্দীন ও মওলানা দুজনই একই ধারার ছিলেন।
“দুজনকে একই ধারায় মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কেন তারা হারিয়ে গেলেন, তখন বুঝতে হবে যে সামাজিক বিপ্লব হয়নি। সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি বলেই তাজউদ্দীনকে আমরা স্মরণ করতে পারছি না।”
ইমরান মাহফুজ বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও তাজউদ্দিন আহমদের সমাজ ভাবনাকে অনুসরণ করার মত। সমাজ, রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধ- এমন নানা বিষয়ে নিয়েই সংকলনটি প্রকাশ করা হয়েছে।”
তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে এদেশে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে, তার প্রতিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে বন্দি থাকাকালীন নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সফল ভূমিকা পালন করেন তিনি।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাজউদ্দীন আহমদকেও গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় জাতীয় আরও তিন নেতা এএইচএম কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করা হয়।
বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম