“নারী প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে,” বলেন আলী রীয়াজ।
তিন বাহিনীর প্রধানের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির হাতে চায় ঐকমত্য কমিশন

- আপডেট সময় ১১:৪৩:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
- / ৩৪ বার পড়া হয়েছে
তিন বাহিনীর প্রধানের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে আরও কিছু নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বাধীন ক্ষমতা থাকা উচিত মনে করে কমিশন।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে একটি ধারণাপত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েছি।
“বর্তমানে সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে কেবল দুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন-প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ।
“তবে আমরা প্রস্তাব করেছি, আরো কিছু নিয়োগে রাষ্ট্রপতির স্বাধীন ক্ষমতা থাকা উচিত।”
এদিন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২২ দিনের বৈঠক ছিল, সেখানে সাতটি বিষয়ে আলোচনার জন্য নির্ধারিত ছিল।
এ বিষয়গুলো হল- সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব; রাষ্ট্রের মূলনীতি।
বৈঠক শেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “এসব প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়েছে। যদি এ বিষয়ে ঐক্যমত হয়, তাহলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তা কার্যকর করতে হবে।”
কমিশন প্রস্তাবিত নিয়োগের মধ্যে রয়েছে-অ্যাটর্নি জেনারেল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, টেলিকম নিয়ন্ত্রক কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধান, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “নারী প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনো কিছু বিষয়ে আলোচনা বাকি রয়েছে, যেগুলো ৩১ জুলাই চূড়ান্ত করা হবে বলে আশা করি।
“আলোচনায় জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। প্রায় সব দল একমত হয়েছে যে জাতীয় সংসদে নারী আসনের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১০০-তে উন্নীত করা হবে। যদিও কয়েকটি দল ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, তবুও অধিকাংশ দলের মধ্যে এ বিষয়ে একটি কার্যকর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
নারী প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে-
>> বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রেখে সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।
>> জুলাই সনদ স্বাক্ষর পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
>> পরবর্তী (চতুর্দশ) সাধারণ নির্বাচনে দলগুলো ন্যূনতম ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, এই প্রত্যাশা সংবিধানে যুক্ত হবে।
>> ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থিতার লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি নির্বাচনে নারী প্রার্থীর হার ৫ শতাংশ করে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলগুলো।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য, ৩১ জুলাই জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোতে পূর্ণাঙ্গ ঐকমত্য অর্জন। ইতোমধ্যে ১৪টি বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেছি, যার মধ্যে নারী আসন বিষয়ে সিদ্ধান্ত অন্যতম।”
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোকে আমরা লিখিত সংশোধনী ও সংযোজনীর তালিকা দিতে বলেছিলাম, অনেকেই ইতোমধ্যে তা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার কমিশন তা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সংশোধনী গৃহণ করবে।
“তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও উচ্চপদে নিয়োগ সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনকেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা সে বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাব।”
সংলাপের একপর্যায়ে কমিশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয় এবং আলোচনার অগ্রগতি ও মতভেদগুলো তাকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান আলী রীয়াজ।
এর আগে যে ১২ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে––
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন
২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব
৩. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান
৫. উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ
৬. পর্যায়ক্রমে উপজেলায় পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর
৭. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা
৮. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
৯. নির্বাচন কমিশন গঠন পদ্ধতি
১০. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার
১১. প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়
১২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন
রাষ্ট্রের মূলনীতি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
ঐকমত্যের যাত্রা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রোববারের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, বাসদ মার্কসবাদীসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।
গত অক্টোবরে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে। এসব প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। দলগুলোর মধ্যে ৩৩টি তাদের মতামত দিয়েছে।
এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ করে ঐকমত্য কমিশন।
কোরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়। এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করে কমিশন, যা এখনো চলছে।
এই আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা যুক্ত করে জাতীয় সনদ তৈরি হবে, রাজনৈতিক দলগেুলো তাতে স্বাক্ষর করবে।
এর অর্থ হল, জাতীয় সনদে যেসব সংস্কারের কথা লেখা থাকবে, সেসব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, সনদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা সেভাবে সংস্কার এগিয়ে নেবে।
বিশেষ প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম