“কত মানুষ এসে হামলা করল, কিন্তু দেখুন একজন নারী আমাকে বাঁচাতে এল। এটাই শিক্ষা, এটা আমি ভুলব না,” বলেন দরবার শরিফের একজন ভক্ত।
দাবি মেনে ‘নুরাল পাগলার’ কবর নিচু করা হয়েছিল, তবু হামলা

- আপডেট সময় ১১:৫৭:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৫ বার পড়া হয়েছে
দাবি মেনে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলার’ কবর কিছুটা নিচু করা হয়েছিল, পুলিশ ও অভিযোগকারীদের লোকজন দরবার শরিফ পরিদর্শন করে ‘সন্তোষও’ প্রকাশ করেছিলেন। এরপরও সেখানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে ‘তৌহিদী জনতার’ নামে একদল লোক। পরে তারা কবর থেকে লাশ তুলে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি করা এ ঘটনার পরদিন শনিবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কবর নিচু করা নিয়ে দাবি তোলার পর বিক্ষোভের মধ্যেই তা নিচু করা হয়েছিল। শুক্রবারের হামলার ঘটনার আগে সংবাদ সম্মেলন করে দরবার শরিফের পক্ষ থেকে তা জানানো হয়েছিল।
ওই দিনই পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের তরফে দরবার শরিফ পরিদর্শন করা হয়। সেখানে বিক্ষোভকারীদের তরফে একজন নেতা কবর নিচু করার সত্যতা দেখতে পান। তিনি উপস্থিত লোকজনকে সেকথাও বলেন। তবে লোকজন চলে আসায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের কথা তখন বলেছিলেন তিনি।
হামলায় আহত দরবার শরিফের একজন ভক্তেরও দাবি, বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে শুক্রবার হামলার আগেই কবর নিচু করা হয়েছিল। পুলিশ প্রথম দফায় বিক্ষোভকারীদের আটকেও দিয়েছিল। তবে পরের দফায় আর পারেনি।
হামলার আগে শুক্রবার দরবার শরিফ পরির্দশনের বিষয়ে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম বলেন, “আমরাও জানতাম শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে চলে যাবেন তারা। এটাই ছিল তাদের বক্তব্য। সেই অনুযায়ী আমরা প্রোগ্রাম সাজিয়ে ছিলাম।
“কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের মধ্যে থেকে একটি অংশ বিনা উসকানিতে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পরে দরবার শরিফে ভাঙচুর করে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রতিটি ঘটনায় মামলা হবে। একটি মামলা হয়েছে, একটি প্রক্রিয়াধীন। প্রতিটি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
‘নুরাল পাগলার’ উঁচু কবরস্থান, সেখানে কাবা শরিফের আদল, নিজেকে ইমাম মাহাদি দাবি করা এসব বিষয় নিয়ে গত বেশ কয়েকদিন ধরে টানা উত্তেজনা ও বিরোধ চলছিল। পাশাপাশি প্রশাসনের উদ্যোগে দুপক্ষকে নিয়ে সমঝোতার পদক্ষেপও সক্রিয় ছিল।
এর মধ্যেই শুক্রবার জুমার পর হাজারো মানুষ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়ায় এলাকার এ দরবার শরিফে হামলা চালায়। এতে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এ ঘটনায় পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে শুক্রবার গভীর রাতে সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে মামলাও হয়।
হামলায় অর্ধশতাধিক ভক্ত-অনুসারী আহত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হামলার পর থেকেই এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। শনিবার সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেছে।
স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও দরবার শরিফের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশির দশক থেকেই এখানে নুরুল হকের ভক্ত-অনুসারীদের উপস্থিতি রয়েছে। ক্রমে ক্রমে তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি তার কর্মকাণ্ড নিয়ে স্থানীয় ও আশপাশের মানুষদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও ভিন্নমতও ছিল।
বিষয়টি বড় আকার ধারণ করে ২৩ অগাস্ট নুরুল হকের মৃত্যুর পর। তার ইচ্ছা অনুযায়ী, তাকে মাটি থেকে কিছুটা উপরে কবর দেওয়া হয়। কাবা শরিফের আদলে তৈরি করা হয় কবর। এরপর থেকেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ‘তৌহিদী জনতার’ নামে বিক্ষোভ শুরু হয়।
এলাকায় আতঙ্ক
শুক্রবারের হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পর দরবার শরিফ এলাকা ধ্বংসস্তূপের মত অবস্থায় পরিণত হয়েছে। নুরুল হকের পরিবারের লোকজন কেউ সেখানে নেই। দরবার শরিফের খাদেম, ভক্ত-অনুসারীদেরও সেখানে দেখা যায়নি। তবে স্থানীয় উৎসুক লোকজন আসছেন। তারা দরবার শরিফের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন আবার চলে যাচ্ছেন।
দরবার শরিফের একজন ভক্ত বলছিলেন, “এখন আমরা খুব ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে আছি। দেখুন, একটা লাশ কবর থেকে তুলে আরেকটা কবরে রাখতে পারত। সেটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা এটা করেছে, তারা আর কী করতে না পারে। ফলে আমরা ভীত।”
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দরবার শরিফে সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে নুরাল পাগলের দরবার শরিফ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হননি।
অভিযোগ ও উদ্যোগ
কবরে দেওয়ার পর বিক্ষোভ শুরু হলে ২৫ অগাস্ট জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার ‘তৌহিদী জনতা’ ও নুরাল পাগলের পরিবারের সদস্য-ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিক্ষোভকারীরা কিছু দাবি দিলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
ওই দিনই দুপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদুর রহমান। দাবির বিষয়ে ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নেয় নুরুল হকের পরিবার।
২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে নুরুল হকের আস্তানায় অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ করে উপজেলা ‘ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। কয়েক ফুট উঁচুতে কবর ‘শরিয়ত পরিপন্থি’ দাবি করে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভের ঘোষণা দেন সংগঠনটির নেতারা। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির সভাপতি মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক।
পরদিন বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) একই দাবিতে রাজবাড়ী প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন জেলা ‘ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলা ইমাম কমিটির সভাপতি ইলিয়াস মোল্লা।
তিনি বলেন, “প্রশাসনের আশ্বাসে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নেয় ওই কবর ১২ ফুট থেকে নামিয়ে স্বাভাবিক কবরের মত করার। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।”
কবর স্বাভাবিক না হলে শুক্রবার থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এরপর শুক্রবার কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলায় বিক্ষোভ হবে। এরপর ঢাকা থেকে দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি নেওয়া হবে।
সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী রাজবাড়ী জেলা কমিটির আমির মো. নুরুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর রাজবাড়ী শাখার সেক্রেটারি আরিফুল ইসলাম।
এর দুদিন পর শুক্রবার বেলা ১১টায় ‘তৌহিদী জনতার’ অভিযোগের জবাব এবং নিজেদের উদ্যোগের বিষয় তুলে ধরতে গোয়ালন্দ প্রেস ক্লাবে দরবার শরিফের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ভক্ত মেহেদি আল আমিন বলেন, “আলেম-ওলামাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় নুরাল পাগলের কবর উঁচু থেকে নিচু করা হয়েছে, কবরের দেয়ালের রঙ পরিবর্তন ও ইমাম মেহেদি দরবার শরিফ লেখা সাইনবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দরবার শরিফে মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়া এখানে খ্রিষ্টান ধর্মের কেউ আসেন না।
প্রশাসনের দরবার শরিফ পরিদর্শন
সংবাদ সম্মেলনের পর ওইদিন শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে গোয়ালন্দ পাক দরবার শরিফ পরিদর্শন করেন পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং জেলা জামায়াতের আমির আইনজীবী নুরুল ইসলাম।
পরিদর্শন শেষে জেলা জামায়াতের আমির উপস্থিত লোকজনকে বলেন, “দাবির মধ্যে কবর নিচু করা হয়েছে। তবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজকের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে। কারণ, মাইকে ঘোষণার পর লোকজন চলে আসছে। তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করবেন।“
একই সঙ্গে মূল দাবি মেনে নেওয়ায় শুক্রবারের ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দসহ’ অন্যান্য কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন জামায়াতের এই নেতা।
তখন দরবার শরিফ ও এলাকা ঘিরে ব্যাপক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়।
এ বিষয়ে শনিবার বিকালে জামায়াতের জেলা আমির নুরুলকে মোবাইলে ফোনে কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় হামলা
নুরুল হকের অনুসারী-ভক্ত রাজবাড়ী সদরের গোলাম আলী। তিনি রাজবাড়ী শহরে চিত্রশিল্পী ও চিত্রাঙ্কনের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। কিশোর বয়স থেকেই তিনি এই দরবার শরিফে যাতায়াত করেন। শুক্রবার ঘটনার দিনও তিনি সেখানে ছিলেন।
ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলছিলেন, “সেদিন তো আমাদের নবীজির জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। প্রতিবছরই এ দিনে অনুষ্ঠান হয়। আমরাও সেখানে গিয়েছিলাম শ্রদ্ধা জানাতে। হামলার আধা ঘণ্টা আগেই দোয়া মাহফিলসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের কাজ শেষ হয়ে যায়। আমি চলে আসতে চাইছিলাম। পরে বলা হল, একটু কিছু খেয়ে যেতে, তখন অপেক্ষা করি।
“কবর ও দরবার শরিফ নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, সেটা ঠিক। কিন্তু প্রশাসনের লোকজন বারবার এসে দেখেছে, কবর নামানো হয়েছে। তাদের নির্দেশমত কাজ হয়েছে। ফলে হামলার বিষয় তো ছিল না।
“সেখানে থাকতেই শুনতে পাই, তারা (হামলাকারীরা) মিছিল নিয়ে আসছে। সেখানে পুলিশ ছিল। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়েছে। পুলিশ তাদের দরবার শরিফের দিকে আসতে দেয়নি। পরে হামলা হলে পুলিশ সরে যায়। তখন হাজারো মানুষ এসে এই হামলা চালায়। আমার উপরও হামলা হয়। আমি রক্তাক্ত হই। মানিব্যাগ নিয়ে যায়।”
গোলাম আলী বলেন, “তখন স্থানীয় একজন নারী আমাকে রক্ষা করেন। তিনি আমাকে বের করে নিয়ে যান। তখন আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। সেই নারী আমাকে ১০০ টাকা দেন। তিনি নিজে রিকশা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন হাসপাতালে আহত আরও অনেকে এসেছেন। কত মানুষ এসে হামলা করল, কিন্তু দেখুন একজন নারী আমাকে বাঁচাতে এল। এটেই শিক্ষা, এটা আমি ভুলব না।”
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই মানুষ এই দরবারে আসা-যাওয়া করে। হিন্দু-মুসলমান সবাই আসেন। উনার (নুরুল হক) ভক্তরা ঈদের নামাজ পড়তে এখানে আসেন। কিছু মানুষ তো সব জায়গায় বিরোধিতা করেন। এখানেও তাই হয়েছে। কারা করেছে, এটা আপনারা জানেন।
“আমরা কী করব? তারা তো অনেক শক্তিশালী, তাদের সব আছে। আমরা শুধু নিরবে শ্রদ্ধা জানাতে পারি, মানুষের মঙ্গল কামনা করতে পারি আর চুপচাপ থাকতে পারি।”
রাজবাড়ী প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম