০২:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কমছে উদ্বেগজনক হারে

নিজস্ব সংবাদ দাতা
  • আপডেট সময় ০৯:০১:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ জুলাই ২০২৩
  • / ১৩২ বার পড়া হয়েছে

জনমনে ভোটের প্রতি আগ্রহ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ভোটের মাঠে বড় দুই দলের অংশগ্রহণ না থাকাসহ নানা কারণে ভোটারদের অনেকে এখন ভোট দিতে যান না। বরং কীভাবে ভোট হচ্ছে সেটিই পর্যবেক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ বেশি।

এ কারণে বিগত কয়েক বছর থেকে কয়েকটি উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বেশ কিছু নির্বাচনে ভোট পড়ার হার উদ্বেগজনক হারে কমতে শুরু করেছে।

সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার নেমে আসে ১১.৫১ শতাংশে। এর আগে চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়ার হার ছিল ১৪.৫৫%।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শনিবার বলেন, ‘নির্বাচন তো গেছে নির্বাসনে। নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি ভোটারদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে সংশয় আছে তারা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কি না বা ভোট দিলে ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটবে কি না। এছাড়া অতীতে মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মূলত এ ধরনের সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস থেকে ভোটাররা এখন আর ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না।’

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ মোটেই কমেনি। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে এবং রাজনীতির মাঠে প্রবল শক্তিধর দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ভোটের মাঠের এমন দৈন্যদশা আর থাকবে না।

তারা বলেন, জনগণের কাছে ভোট একটা বড় উৎসবের মতো। ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট ভর করেছে সেটিকে আগে দূর করতে হবে।

গত ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। মোহাম্মদ এ আরাফাত নৌকা প্রতীকে ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, যা এ আসনের মোট ভোটারের ৮.৮৬ শতাংশ।

এ নির্বাচনে তিন লাখ ২৫ হাজার ২০৫ ভোটারের মধ্যে ভোট পড়ে ৩৭৪২০টি। ঢাকার বাইরে গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়ে ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ ভোটারের এ আসনে ৬৭ হাজার ২০৫ ভোট পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ। তিনি মোট ভোটারের ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

এর আগে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া ৪ ও ৬ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। ওই ছয়টির মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে। ভোটের হার ছিল ১৬.১০ শতাংশ। বগুড়া-৬ আসনে উপনির্বাচনে ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বগুড়া-৪ আসনে ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।

ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ৪৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে ২৯ দশমিক ০৮ শতাংশ ভোট পড়ে। গত ৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৩৮.২৩ শতাংশ।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোট পড়ার হার কমেছে। এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪৮.৭৫ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালে এই সিটিতে ভোট পড়েছিল ৫৭ দশমিক ০২ শতাংশ।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৪৭.৮৫ শতাংশ। আগেরবার ভোট পড়েছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। বরিশাল সিটি করপোরেশনে এবারে ভোট পড়েছে ৫১.৪৬ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭৫ শতাংশ।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭৮.৮৬ শতাংশ। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, স্থান, পাত্র, কালভেদে ভোটার উপস্থিতি কম-বেশি হচ্ছে। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ১১.৫১ শতাংশ ভোট পড়লেও একই দিন অনুষ্ঠিত পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া ও কুমিল্লার দেবিদ্বার পৌরসভায় ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। তবে কেন ভোটার উপস্থিতি কম হচ্ছে তা গবেষণা ছাড়া বলা যাবে না।

তিনি বলেন, ইসির কাজ হচ্ছে নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা, বিপরীতে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার দায়-দায়িত্ব প্রার্থীদের। নির্বাচন কমিশন সব ভোটই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে।

জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে সেগুলোর অবস্থা দেখে মানুষের ভোটের ওপর আস্থা কমে গেছে। মানুষ মনে করে, ফলাফলে তাদের ভোটের প্রতিফলন ঘটছে না।

এছাড়া নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলে এবং বড় দলগুলো অংশ না নিলেও সেখানে ভোটারদের আগ্রহ কম থাকে। যেসব নির্বাচনে মানুষ ভোটের আগেই কে জিতবেন তা বুঝতে পারেন, সেই নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া গণতন্ত্রের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে মন্তব্য করে আব্দুল আলিম বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম হলে আইন অনুযায়ী তা অবৈধ হবে না। তবে তা লেজিমেটেড হয় না।’

ঘুরেফিরে একই দল : পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে ঘুরেফিরে ১০-১২টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে।

দলগুলোর মধ্যে রয়েছে-আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও বিকল্পধারা বাংলাদেশ। কিন্তু বিএনপিসহ রাজপথে সক্রিয় থাকা অন্যান্য পরিচিত দল নির্বাচন বর্জন করে আসছে।

বিএনপির বর্জন : নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য বিএনপির ভোট বর্জনকেও অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ইশরাক হোসেন ও উত্তরে তাবিথ আউয়াল বিএনপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ব্যাপক কারচুপি, প্রভাব বিস্তার ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এরপর থেকে বিএনপির নেতারা নির্বাচনে অংশ নিলে তাদেরকে বহিষ্কার করে আসছে দলটি।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির যেসব নেতা নির্বাচনে অংশ নেন তাদেরও দল থেকে বহিষ্কার করে। নির্বাচন কমিশনারগণ বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে বিএনপির অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কথাও জানান।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দুই দফায় বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানালেও সাড়া দেয়নি দলটি। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে আসছে দলটি। এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি।

আ.লীগ নেতাকর্মীরাও যাচ্ছেন না ভোটকেন্দ্রে : ঢাকা-১৭ আসনের ১১৪ নম্বর শহিদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল কেন্দ্রে ১১ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত।

১০৪ নম্বর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ (মহিলা) কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন মাত্র ১২ ভোট। ১০৯ নম্বর বিএফ শাহীন কলেজ কেন্দ্রে পেয়েছেন ২৯ ভোট। এভাবে অন্তত ২৭টি কেন্দ্রে একশর কম ভোট পেয়েছেন সরকারি দলের এ প্রার্থী। ওইসব কেন্দ্রের প্রতিটিতে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার ভোটার ছিলেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই ভোট কেন্দ্রে যাননি। তারা জানান, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগি নেতা রয়েছে। তাদের অনেকেই এ আসনে প্রার্থী হতে চেয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে তাদের কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে মোহাম্মদ এ আরাফাতকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সে কারণেও এ নির্বাচনে তাদের তৎপরতা কম ছিল।

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান।

একাদশ সংসদের ঢাকা-৫, ঢাকা-১০, ঢাকা-১৮ আসনের ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সেই তুলনায় ঢাকা-১৭ আসনে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে প্রায় ১২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল। আমেরিকা-ব্রিটেনে এই নির্বাচন হলে দুই শতাংশ ভোটও পড়ত না।

তিনি বলেন, উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হয়। এসব উপনির্বাচনে বড় বিরোধী দল অংশ নিলে ভোটার উপস্থিতি বাড়ত। আরেকটি কারণ হচ্ছে, সরকারদলীয় প্রার্থী জিতে যাবেন-এমন ধারণা থেকেও অনেকেই ভোট দিতে যাননি। এ নির্বাচনে সরকার বদল হবে না-এই কারণেও ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।

ট্যাগস

নিউজটি শেয়ার করুন

নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কমছে উদ্বেগজনক হারে

আপডেট সময় ০৯:০১:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ জুলাই ২০২৩

জনমনে ভোটের প্রতি আগ্রহ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ভোটের মাঠে বড় দুই দলের অংশগ্রহণ না থাকাসহ নানা কারণে ভোটারদের অনেকে এখন ভোট দিতে যান না। বরং কীভাবে ভোট হচ্ছে সেটিই পর্যবেক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ বেশি।

এ কারণে বিগত কয়েক বছর থেকে কয়েকটি উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বেশ কিছু নির্বাচনে ভোট পড়ার হার উদ্বেগজনক হারে কমতে শুরু করেছে।

সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার নেমে আসে ১১.৫১ শতাংশে। এর আগে চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়ার হার ছিল ১৪.৫৫%।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শনিবার বলেন, ‘নির্বাচন তো গেছে নির্বাসনে। নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি ভোটারদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে সংশয় আছে তারা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কি না বা ভোট দিলে ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটবে কি না। এছাড়া অতীতে মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মূলত এ ধরনের সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস থেকে ভোটাররা এখন আর ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না।’

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ মোটেই কমেনি। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে এবং রাজনীতির মাঠে প্রবল শক্তিধর দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ভোটের মাঠের এমন দৈন্যদশা আর থাকবে না।

তারা বলেন, জনগণের কাছে ভোট একটা বড় উৎসবের মতো। ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট ভর করেছে সেটিকে আগে দূর করতে হবে।

গত ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। মোহাম্মদ এ আরাফাত নৌকা প্রতীকে ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, যা এ আসনের মোট ভোটারের ৮.৮৬ শতাংশ।

এ নির্বাচনে তিন লাখ ২৫ হাজার ২০৫ ভোটারের মধ্যে ভোট পড়ে ৩৭৪২০টি। ঢাকার বাইরে গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়ে ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ ভোটারের এ আসনে ৬৭ হাজার ২০৫ ভোট পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ। তিনি মোট ভোটারের ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

এর আগে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া ৪ ও ৬ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। ওই ছয়টির মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে। ভোটের হার ছিল ১৬.১০ শতাংশ। বগুড়া-৬ আসনে উপনির্বাচনে ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বগুড়া-৪ আসনে ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।

ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ৪৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে ২৯ দশমিক ০৮ শতাংশ ভোট পড়ে। গত ৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৩৮.২৩ শতাংশ।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোট পড়ার হার কমেছে। এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪৮.৭৫ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালে এই সিটিতে ভোট পড়েছিল ৫৭ দশমিক ০২ শতাংশ।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৪৭.৮৫ শতাংশ। আগেরবার ভোট পড়েছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। বরিশাল সিটি করপোরেশনে এবারে ভোট পড়েছে ৫১.৪৬ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭৫ শতাংশ।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭৮.৮৬ শতাংশ। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, স্থান, পাত্র, কালভেদে ভোটার উপস্থিতি কম-বেশি হচ্ছে। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ১১.৫১ শতাংশ ভোট পড়লেও একই দিন অনুষ্ঠিত পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া ও কুমিল্লার দেবিদ্বার পৌরসভায় ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। তবে কেন ভোটার উপস্থিতি কম হচ্ছে তা গবেষণা ছাড়া বলা যাবে না।

তিনি বলেন, ইসির কাজ হচ্ছে নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা, বিপরীতে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার দায়-দায়িত্ব প্রার্থীদের। নির্বাচন কমিশন সব ভোটই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে।

জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে সেগুলোর অবস্থা দেখে মানুষের ভোটের ওপর আস্থা কমে গেছে। মানুষ মনে করে, ফলাফলে তাদের ভোটের প্রতিফলন ঘটছে না।

এছাড়া নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলে এবং বড় দলগুলো অংশ না নিলেও সেখানে ভোটারদের আগ্রহ কম থাকে। যেসব নির্বাচনে মানুষ ভোটের আগেই কে জিতবেন তা বুঝতে পারেন, সেই নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া গণতন্ত্রের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে মন্তব্য করে আব্দুল আলিম বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম হলে আইন অনুযায়ী তা অবৈধ হবে না। তবে তা লেজিমেটেড হয় না।’

ঘুরেফিরে একই দল : পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে ঘুরেফিরে ১০-১২টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে।

দলগুলোর মধ্যে রয়েছে-আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও বিকল্পধারা বাংলাদেশ। কিন্তু বিএনপিসহ রাজপথে সক্রিয় থাকা অন্যান্য পরিচিত দল নির্বাচন বর্জন করে আসছে।

বিএনপির বর্জন : নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য বিএনপির ভোট বর্জনকেও অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ইশরাক হোসেন ও উত্তরে তাবিথ আউয়াল বিএনপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ব্যাপক কারচুপি, প্রভাব বিস্তার ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এরপর থেকে বিএনপির নেতারা নির্বাচনে অংশ নিলে তাদেরকে বহিষ্কার করে আসছে দলটি।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির যেসব নেতা নির্বাচনে অংশ নেন তাদেরও দল থেকে বহিষ্কার করে। নির্বাচন কমিশনারগণ বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে বিএনপির অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কথাও জানান।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দুই দফায় বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানালেও সাড়া দেয়নি দলটি। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে আসছে দলটি। এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি।

আ.লীগ নেতাকর্মীরাও যাচ্ছেন না ভোটকেন্দ্রে : ঢাকা-১৭ আসনের ১১৪ নম্বর শহিদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল কেন্দ্রে ১১ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত।

১০৪ নম্বর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ (মহিলা) কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন মাত্র ১২ ভোট। ১০৯ নম্বর বিএফ শাহীন কলেজ কেন্দ্রে পেয়েছেন ২৯ ভোট। এভাবে অন্তত ২৭টি কেন্দ্রে একশর কম ভোট পেয়েছেন সরকারি দলের এ প্রার্থী। ওইসব কেন্দ্রের প্রতিটিতে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার ভোটার ছিলেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই ভোট কেন্দ্রে যাননি। তারা জানান, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগি নেতা রয়েছে। তাদের অনেকেই এ আসনে প্রার্থী হতে চেয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে তাদের কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে মোহাম্মদ এ আরাফাতকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সে কারণেও এ নির্বাচনে তাদের তৎপরতা কম ছিল।

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান।

একাদশ সংসদের ঢাকা-৫, ঢাকা-১০, ঢাকা-১৮ আসনের ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সেই তুলনায় ঢাকা-১৭ আসনে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে প্রায় ১২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল। আমেরিকা-ব্রিটেনে এই নির্বাচন হলে দুই শতাংশ ভোটও পড়ত না।

তিনি বলেন, উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হয়। এসব উপনির্বাচনে বড় বিরোধী দল অংশ নিলে ভোটার উপস্থিতি বাড়ত। আরেকটি কারণ হচ্ছে, সরকারদলীয় প্রার্থী জিতে যাবেন-এমন ধারণা থেকেও অনেকেই ভোট দিতে যাননি। এ নির্বাচনে সরকার বদল হবে না-এই কারণেও ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।