০৮:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা-প্রতিবাদের মধ্যে সায়েদাবাদ থেকে ফজর আলী এবং বিভিন্ন স্থান আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফজর দরজা ভেঙে ‘ধর্ষণ’ করে, পরে ভিডিও করে তার ভাই: ভুক্তভোগী নারী

কুমিল্লা প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০৫:০১:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
  • / ২৫ বার পড়া হয়েছে

ছবি : ফজর আলী

 

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় ‘ধর্ষণের শিকার’ ওই হিন্দু নারী অভিযোগ করেছেন, ফজর আলী রাতের বেলায় এসে দরজা ভেঙে তাকে ‘যৌন নির্যাতন’ করেছেন। এর কিছু পরেই তার ভাই এসে তাদের মারধর ও ভিডিও করেন।

‘ধর্ষণ’ ও ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া ও মারধরের ঘটনার বিচারও চেয়েছেন ওই নারী।

রোববার ২৯ জুন দুপুরে মুরাদনগরের বাড়িতে ওই নারী বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে খালি বাড়িতে ফজর আলী আমার ঘরের দরজা খোলার জন্য ডাক দেয়। আমি না খোলায় সে দরজাটা ভেঙে ফেলে। ভেতরে ঢুকে আমার উপর অত্যাচার করে।

“এর মধ্যেই সাত-আটজন লোক আমার ঘরে ঢুকে ফজর আলীকেও মারছে, আমাকেও মারছে। তার ছোট ভাই শাহ পরানই ইন্ধন দিয়েছে। পরদিন (শুক্রবার) আমি থানায় একটা মামলা করেছি।”

ওই নারী দিন ১৫ আগে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসেন, তার স্বামী প্রবাসী। সুদে টাকা ধার নেওয়ার সূত্রে ফজর আলীর সঙ্গে আগে থেকেই তার পরিবারের যোগাযোগ ছিল। সে কারণেই পরিচয়, এর বাইরে ‘আর কোনো সম্পর্ক’ নেই বলেও দাবি করেন ওই নারী।

এদিকে এদিন কুমিল্লা জেলা পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে মুরাদনগরের একটি গ্রামে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ফজর আলী নামে এক ব্যক্তি আটক ও পিটুনির শিকার হয়। পরে ফজর সেখান থেকে পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে কিছু ব্যক্তি ভুক্তভোগীর ভিডিও ধারণ করে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। পরে মুরাদনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ গ্রহণ করে।

 

কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু নামের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

 

মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফজর আলীকে আসামি করে শুক্রবার ২৮ জুন  মামলা করেছেন এক হিন্দু নারী। বাদীর মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে।

এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের মধ্যে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে শনিবার ভোরে ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এছাড়া কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু নামের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগের আলাদা মামলায় তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

 

‘মেয়েকে মারলো আবার ভিডিও করল কেন’

মুরাদনগরের এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। তারপরই তোলপাড় শুরু হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, বিবস্ত্র অবস্থায় ওই নারীকে বেশ কয়েকজন যুবক মারধর করছেন। নারীটি অনেক আকুতি-মিনতি কান্নাকাটি করলেও যুবকরা তাকে মারতে থাকে এবং ভিডিও ধারণ করতে থাকে।

রোববার ২৯ জুন সকালে ভুক্তভোগী ওই নারীর বাবার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, শুনশান নিরবতা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আশপাশের পাড়া-প্রতিবেশীরা আসেন। তারপর সেখানে সংবাদকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসেন।

ভুক্তভোগী নারীর সত্তোরোর্ধ্ব বাবা একজন জেলে। খালবিলে মাছ ধরে বিক্রি করেন। মেয়ের ঘটনায় তিনি অনেকটাই নির্বাক। ঘটনার রাতে তিনি ও তার স্ত্রী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাড়ির বাইরে ছিলেন। বাড়িতে মেয়ে একাই ছিলেন।

ওই নারীর বাবা বলছিলেন, “ওই রাতে আমরা একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। চিৎকার শুনে এসে দেখি, অনেক মানুষ উঠানে। ঘরে কেউ ফজর আলীকে মারছে, কেউ আমার মেয়ের ভিডিও করছে। পরে আশপাশের লোকজন চলে এলে যারা মারছিল তারা চলে যায়। কেউ ফজর আলীকেও নিয়ে যায়। এসব আসলেই বলার মত না।

“তারা মারলো আবার ভিডিও করল কেন? আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন সব জানলো। কিছু বলার মুখ নাই আমার।”

এ সময় ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, শাহ পরান (ফজরের ছোট ভাই) ভাবত ফজর আলীর (৩৮) সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। এ কারণে কয়েকদিন আগে শাহ পরান বাড়ি এসে তার মোবাইল ফোন দেখতে চায়। তখন দিতে অস্বীকার করলে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলে চলে যান। এ ঘটনা তিনি ফজর আলীকে জানিয়েছিলেন। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ‘দ্বন্দ্ব হতে পারে’ বলে ধারণা করেন ওই নারী।

তিনি বলেন, “ফজর আলীর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু যে দিন রাতে এসেছে খারাপ উদ্দেশ্যেই এসেছে। না হলেও তো দিনের বেলাতেই আসতো। সে আসার দুই-তিন মিনিট পরেই তারা কয়েকজন এসে মারধর শুরু করে। কিছু বলার আগেই ভিডিও করা শুরু করে। পরে আমি চিৎকার দিলে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন আসে।

“যারা ভিডিও করেছে তাদের চেহারা চিনি; কিন্তু পরিচয় জানি না। তাদের নামে থানায় মামলা করেছি। তারা অন্যায় করছে- আশা করছি বিচার পাব।”

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “বৃহস্পতিবার ২৬ জুন রাতে ওই বাড়িতে অনেক শব্দ হচ্ছিল। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু লোক ওই নারীকে মারধর ও ভিডিও করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন বুঝতে পারি, ওই নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তখন লোকজন ফজর আলীকে মারধর করেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

তবে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি (ইউপি চেয়ারম্যান) দাবি করেছেন, ফজর আলীর সঙ্গে ওই নারীর সম্পর্কের বিষয়টি তিনি জানতেন। তবে তিনি ‘ধর্ষণে’ জড়িত ফজর আলীর পাশাপাশি যারা এই ঘটনার ভিডিও করেছেন তারাও সমান অপরাধী, তাদের বিচারও দাবি করেন।

ওই জনপ্রতিনিধি একজন আওয়ামী লীগ নেতাও। বিএনপি দাবি করেছে, ফজর আলী তার ‘বডিগার্ড’ ছিলেন।

 

ফজর আলী ও সুমনের রাজনৈতিক পরিচয়

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফজর আলী নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের কাজ করেন। তবে তার মূল পেশা হচ্ছে সুদের ব্যবসা। এলাকায় তিনি আধিপত্য বিস্তার করেই চলেন। তিনি নানা অপকর্ম করেছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

কেউ কেউ তাকে ‘আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তবে তার পদ-পদবীর বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেননি। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের মিছিলে তিনি অংশ নিয়েছেন- এমন ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকার কথা বলেছেন। যদিও এসব স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা যায়নি।

তবে ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার সুমন ছাত্রলীগের একটি ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ছিলেন বলে স্থানীয়রা বলেছেন।

 

বিএনপির সংবাদ সম্মেলন

‘ধর্ষণ’ ও নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন।

রোববার ২৯ জুন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিকভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এক গভীর চক্রান্ত’ চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ওই এলাকার (মুরাদনগর) একজন উপদেষ্টা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুরাদনগরে ক্রমাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন।”

এদিকে বিকালে আওয়ামী লীগ নেতা ফজর আলীকে বিএনপির কর্মী বলে অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানিয়েছে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি।

কুমিল্লা নগরীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভুইয়া বলেন, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুরাদনগরের ধর্ষক ফজর আলীকে বিএনপির কর্মী হিসেবে প্রচার চালানো হচ্ছে, যা সত্য নয়। ফজর আলীর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত সে আওয়ামী লীগের ক্যাডার। গত ১৫ বছরে সে মুরাদনগরে অসংখ্য অপকর্ম ঘটিয়েছে। আমরা তার বিচার চাই।”

এসময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা ফজর আলীর ছবিও প্রদর্শন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ফজর আলীকে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির (চেয়ারম্যান) ‘বডিগার্ড’ হিসেবে দাবি করা হয়।

যদিও ওই জনপ্রতিনিধি দাবি করেছেন, ফজর আলী তার ‘বডিগার্ড’ ছিলেন না। তিনি বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে তোলা ছবিগুলো দিয়েই মানুষ এখন অপপ্রচার চালাচ্ছে।”

সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মোল্লা মুজিবুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম, মুরাদনগর পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দুলাল দেবনাথ, সাধারণ সম্পাদক দয়ানন্দ ঠাকুর, উপজেলা মহিলা দলের আহ্বায়ক কাজী তাহমিনা আক্তার, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

 

 

কুমিল্লা প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা-প্রতিবাদের মধ্যে সায়েদাবাদ থেকে ফজর আলী এবং বিভিন্ন স্থান আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফজর দরজা ভেঙে ‘ধর্ষণ’ করে, পরে ভিডিও করে তার ভাই: ভুক্তভোগী নারী

আপডেট সময় ০৫:০১:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

 

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় ‘ধর্ষণের শিকার’ ওই হিন্দু নারী অভিযোগ করেছেন, ফজর আলী রাতের বেলায় এসে দরজা ভেঙে তাকে ‘যৌন নির্যাতন’ করেছেন। এর কিছু পরেই তার ভাই এসে তাদের মারধর ও ভিডিও করেন।

‘ধর্ষণ’ ও ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া ও মারধরের ঘটনার বিচারও চেয়েছেন ওই নারী।

রোববার ২৯ জুন দুপুরে মুরাদনগরের বাড়িতে ওই নারী বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে খালি বাড়িতে ফজর আলী আমার ঘরের দরজা খোলার জন্য ডাক দেয়। আমি না খোলায় সে দরজাটা ভেঙে ফেলে। ভেতরে ঢুকে আমার উপর অত্যাচার করে।

“এর মধ্যেই সাত-আটজন লোক আমার ঘরে ঢুকে ফজর আলীকেও মারছে, আমাকেও মারছে। তার ছোট ভাই শাহ পরানই ইন্ধন দিয়েছে। পরদিন (শুক্রবার) আমি থানায় একটা মামলা করেছি।”

ওই নারী দিন ১৫ আগে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসেন, তার স্বামী প্রবাসী। সুদে টাকা ধার নেওয়ার সূত্রে ফজর আলীর সঙ্গে আগে থেকেই তার পরিবারের যোগাযোগ ছিল। সে কারণেই পরিচয়, এর বাইরে ‘আর কোনো সম্পর্ক’ নেই বলেও দাবি করেন ওই নারী।

এদিকে এদিন কুমিল্লা জেলা পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে মুরাদনগরের একটি গ্রামে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ফজর আলী নামে এক ব্যক্তি আটক ও পিটুনির শিকার হয়। পরে ফজর সেখান থেকে পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে কিছু ব্যক্তি ভুক্তভোগীর ভিডিও ধারণ করে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। পরে মুরাদনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ গ্রহণ করে।

 

কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু নামের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

 

মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফজর আলীকে আসামি করে শুক্রবার ২৮ জুন  মামলা করেছেন এক হিন্দু নারী। বাদীর মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে।

এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের মধ্যে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে শনিবার ভোরে ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এছাড়া কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু নামের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগের আলাদা মামলায় তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

 

‘মেয়েকে মারলো আবার ভিডিও করল কেন’

মুরাদনগরের এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। তারপরই তোলপাড় শুরু হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, বিবস্ত্র অবস্থায় ওই নারীকে বেশ কয়েকজন যুবক মারধর করছেন। নারীটি অনেক আকুতি-মিনতি কান্নাকাটি করলেও যুবকরা তাকে মারতে থাকে এবং ভিডিও ধারণ করতে থাকে।

রোববার ২৯ জুন সকালে ভুক্তভোগী ওই নারীর বাবার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, শুনশান নিরবতা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আশপাশের পাড়া-প্রতিবেশীরা আসেন। তারপর সেখানে সংবাদকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসেন।

ভুক্তভোগী নারীর সত্তোরোর্ধ্ব বাবা একজন জেলে। খালবিলে মাছ ধরে বিক্রি করেন। মেয়ের ঘটনায় তিনি অনেকটাই নির্বাক। ঘটনার রাতে তিনি ও তার স্ত্রী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাড়ির বাইরে ছিলেন। বাড়িতে মেয়ে একাই ছিলেন।

ওই নারীর বাবা বলছিলেন, “ওই রাতে আমরা একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। চিৎকার শুনে এসে দেখি, অনেক মানুষ উঠানে। ঘরে কেউ ফজর আলীকে মারছে, কেউ আমার মেয়ের ভিডিও করছে। পরে আশপাশের লোকজন চলে এলে যারা মারছিল তারা চলে যায়। কেউ ফজর আলীকেও নিয়ে যায়। এসব আসলেই বলার মত না।

“তারা মারলো আবার ভিডিও করল কেন? আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন সব জানলো। কিছু বলার মুখ নাই আমার।”

এ সময় ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, শাহ পরান (ফজরের ছোট ভাই) ভাবত ফজর আলীর (৩৮) সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। এ কারণে কয়েকদিন আগে শাহ পরান বাড়ি এসে তার মোবাইল ফোন দেখতে চায়। তখন দিতে অস্বীকার করলে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলে চলে যান। এ ঘটনা তিনি ফজর আলীকে জানিয়েছিলেন। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ‘দ্বন্দ্ব হতে পারে’ বলে ধারণা করেন ওই নারী।

তিনি বলেন, “ফজর আলীর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু যে দিন রাতে এসেছে খারাপ উদ্দেশ্যেই এসেছে। না হলেও তো দিনের বেলাতেই আসতো। সে আসার দুই-তিন মিনিট পরেই তারা কয়েকজন এসে মারধর শুরু করে। কিছু বলার আগেই ভিডিও করা শুরু করে। পরে আমি চিৎকার দিলে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন আসে।

“যারা ভিডিও করেছে তাদের চেহারা চিনি; কিন্তু পরিচয় জানি না। তাদের নামে থানায় মামলা করেছি। তারা অন্যায় করছে- আশা করছি বিচার পাব।”

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “বৃহস্পতিবার ২৬ জুন রাতে ওই বাড়িতে অনেক শব্দ হচ্ছিল। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু লোক ওই নারীকে মারধর ও ভিডিও করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন বুঝতে পারি, ওই নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তখন লোকজন ফজর আলীকে মারধর করেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

তবে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি (ইউপি চেয়ারম্যান) দাবি করেছেন, ফজর আলীর সঙ্গে ওই নারীর সম্পর্কের বিষয়টি তিনি জানতেন। তবে তিনি ‘ধর্ষণে’ জড়িত ফজর আলীর পাশাপাশি যারা এই ঘটনার ভিডিও করেছেন তারাও সমান অপরাধী, তাদের বিচারও দাবি করেন।

ওই জনপ্রতিনিধি একজন আওয়ামী লীগ নেতাও। বিএনপি দাবি করেছে, ফজর আলী তার ‘বডিগার্ড’ ছিলেন।

 

ফজর আলী ও সুমনের রাজনৈতিক পরিচয়

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফজর আলী নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের কাজ করেন। তবে তার মূল পেশা হচ্ছে সুদের ব্যবসা। এলাকায় তিনি আধিপত্য বিস্তার করেই চলেন। তিনি নানা অপকর্ম করেছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

কেউ কেউ তাকে ‘আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তবে তার পদ-পদবীর বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেননি। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের মিছিলে তিনি অংশ নিয়েছেন- এমন ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকার কথা বলেছেন। যদিও এসব স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা যায়নি।

তবে ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার সুমন ছাত্রলীগের একটি ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ছিলেন বলে স্থানীয়রা বলেছেন।

 

বিএনপির সংবাদ সম্মেলন

‘ধর্ষণ’ ও নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন।

রোববার ২৯ জুন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিকভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এক গভীর চক্রান্ত’ চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ওই এলাকার (মুরাদনগর) একজন উপদেষ্টা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুরাদনগরে ক্রমাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন।”

এদিকে বিকালে আওয়ামী লীগ নেতা ফজর আলীকে বিএনপির কর্মী বলে অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানিয়েছে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি।

কুমিল্লা নগরীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভুইয়া বলেন, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুরাদনগরের ধর্ষক ফজর আলীকে বিএনপির কর্মী হিসেবে প্রচার চালানো হচ্ছে, যা সত্য নয়। ফজর আলীর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত সে আওয়ামী লীগের ক্যাডার। গত ১৫ বছরে সে মুরাদনগরে অসংখ্য অপকর্ম ঘটিয়েছে। আমরা তার বিচার চাই।”

এসময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা ফজর আলীর ছবিও প্রদর্শন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ফজর আলীকে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির (চেয়ারম্যান) ‘বডিগার্ড’ হিসেবে দাবি করা হয়।

যদিও ওই জনপ্রতিনিধি দাবি করেছেন, ফজর আলী তার ‘বডিগার্ড’ ছিলেন না। তিনি বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে তোলা ছবিগুলো দিয়েই মানুষ এখন অপপ্রচার চালাচ্ছে।”

সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মোল্লা মুজিবুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম, মুরাদনগর পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দুলাল দেবনাথ, সাধারণ সম্পাদক দয়ানন্দ ঠাকুর, উপজেলা মহিলা দলের আহ্বায়ক কাজী তাহমিনা আক্তার, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

 

 

কুমিল্লা প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম