আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার বাস্তবতা তুলে ধরে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরুর তাগিদ দিয়েছেন।
ফের ভয় জাগাচ্ছে ডেঙ্গু

- আপডেট সময় ০৪:৫৭:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৫২ বার পড়া হয়েছে
বর্ষা মৌসুমের শেষভাগে এসে ফের বাজে চেহারা নিচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ; সেপ্টেম্বরের তিন সপ্তাহেই মাসওয়ারি হিসেবে বছরের সর্বোচ্চ সংক্রমণ আর মৃত্যুর তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩ হাজার ১৭৩ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৮২ জনের।
এর মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ দিনেই সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৬৯৭ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর এই তিন সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি ৬০ জনের মৃত্যু ঘটিয়েছে মশাবাহিত এ রোগ।
গত বছরের চিত্র মনে করিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি অক্টোবরে ‘আরও খারাপ’ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার বাস্তবতা তুলে ধরে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরুর তাগিদ দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের বুলেটিনে বলা হয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৬৪ জন রোগী, মৃত্যু হয়েছে এক জনের।
এর আগে রোববার একদিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৪০ জন রোগী, মৃত্যু হয় ৯ জনের। হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং মৃতের এই সংখ্যা এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ।
ক্রমেই বাড়ছে রোগী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ১৬২.৯২ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতারে ভর্তি হয়েছেন। আর চলতি সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গড়ে ৫০৯ জন রোগী।
সপ্তাহভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে ৪১৯ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪৯৭ জন এবং তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৫৫৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এর আগে অগাস্টে দৈনিক গড়ে ৩৩৯ জন, জুলাইয়ে ৩৪৫ জন, জুনে ১৯৮ জন, মে মাসে ৫৭ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মার্চে ১১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৩ জন এবং জানুয়ারিতে দৈনিক গড়ে ৩৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসে হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সারাদেশে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীর সংখ্যা ছিল গড়ে ১৫৬৩ জন। দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৭৬১ এবং তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ১৯৬০ জনে।
এ সময় মৃত্যুও আগের তুলনায় বেড়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৬০ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় দৈনিক গড়ে ২.৬১ জন মারা গেছেন।
সপ্তাহভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, প্রথম সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ১.৮৬, দ্বিতীয় সপ্তাহে ২.১৪ এবং তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৪.১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য দেয়। কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েও অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হন না। সে কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
চোখ রাঙাচ্ছে অক্টোবর
বাংলাদেশে ২০২৪ সালেও অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১০ হাজার ২৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অক্টোবর মাসে সেই সংখ্যাটি তিনগুণ বেড়ে ৩০ হাজার ৮৭৯ জন হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের অক্টোবরে ডেঙ্গু সংক্রমণ চূড়ায় ছিল। আবহাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় এ বছরও অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন তারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একটি চুক্তির আওতায় ঢাকায় মশার জরিপ কাজের নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় এইডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপ করেন তিনি এবং তার দল।
কবিরুল বাশার বলেন, তারা বিভিন্ন জায়গায় জরিপ চালিয়ে যেসব তথ্য পাচ্ছেন, তাতে সারাদেশেই এইডিস মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
“আমরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছি। এইডিস মশার ব্রুটো ইনডেক্স কোনো কোনো জায়গায় ৪০, ৬০, ৮০ পেয়েছি আমাদের সার্ভেতে। ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ৪০ এর বেশি। আবার ঢাকার বাইরে একটা জেলাও পাওয়া যাবে না যেখানে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর নিচে।”
কবিরুল বাশার বলেন, “এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খারাপ। সামনে আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা আছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনজনকে সচেতন করতে হবে। কারণ এইডিস মশা হয় বাড়িতে। জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নাই। পাশাপাশি শহর এলাকায় এইডিস মশার লার্ভিসাইডিং করতে হবে।”
বাংলাদেশের সংক্রামক রোগ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা মুশতাক হোসেন বলেন, সেপ্টেম্বর মাসেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মশার প্রজনন হচ্ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পরিস্থিতির ‘কোনো উন্নতি নাই’। ফলে মশা বাড়ছেই।
“বৃষ্টি থেমে যখন রোদ হয় তখন ডিম মশার ডিম ফোটে। আবার বৃষ্টি হয়, আবার ডিম পাড়ার জায়গা বাড়ে। কাজেই বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে দুই মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকতে পারে।”
মুশতাক হোসেন বলেন, “সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় হাজার হাজার তরুণ-যুবক স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করতে হবে। আমাদের এখানে এক সময় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল, সেটা দূর করা গেছে মানুষের অংশগ্রহণেই।
“কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এনেছে, আমাদের এখানেও চাইলে সম্ভব। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজটি করতে হবে, এই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। কিন্তু আমাদের চারপাশ তো পরিষ্কারই হচ্ছে না।”
সমন্বিত উদ্যোগ আছে কতটা
ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক, জেলার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের ১২ নির্দেশনা পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে সোমবারও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটা দায়বদ্ধতা আছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ বিষয়টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবকিছু সমন্বিতভাবে হওয়া দরকার, তবে তা হচ্ছে কি না নিয়ে সন্দিহান তিনি।
“মশা নিধনের কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের না। এগুলো স্থানীয় সরকারের অধীনে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের কাজ। এ কারণে সবগুলো সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় অতি জরুরি। সেক্ষেত্রে কতটা কি হচ্ছে সেটাও আপনাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সবকিছু সব সময় সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হচ্ছে না।”
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমুহ) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ হাসপাতালের বাইরে পরিচ্ছ্ন্নতা কার্যক্রম চালাতে পারে না, সেটা সম্ভবও না।
“সেখানে কাজ করেন স্থানীয় সরকার বিভাগ। আমরা প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় চিঠি দিয়েছি যেন মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করে।”
সারাদেশে মশক নিধনে স্থানীয় সরকার বিভাগ কি কাজ করছে তা জানতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নম্বরে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকসুদ জাহেদীকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে মোবাইলে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।
সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম