০৪:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
ডিপসিকের হঠাৎ জনপ্রিয়তা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, এনভিডিয়ার বাজারমূল্য এক দিনে ৬০ হাজার কোটি ডলার কমে গিয়েছিল।

বাজারে ঝড় তোলা ডিপসিক শেষ পর্যন্ত কী করল?

প্রযুক্তি ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০২:২৫:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩৪ বার পড়া হয়েছে

এআই শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল ডিপসিক। ছবি: রয়টার্স

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার কেবল এক সপ্তাহ আগে সিলিকন ভ্যালিতে ঝড় তুলেছিল নতুন এক চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই অ্যাপ ডিপসিক।

রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপল চার্টে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপ হিসেবে শীর্ষে উঠে আসে ডিপসিকের ‘ডিপসিক-আর১’ সংস্করণটি।

ওই সময় কোম্পানিটি বলেছিল, তাদের নতুন চ্যাটবটটি কেবল ওপেনএআইয়ের এআই অ্যাপ চ্যাটজিপিটিরই প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং মডেলটি তৈরিতে তাদের খুব সামান্য অর্থই খরচ হয়েছে।

এসব দাবি ও অ্যাপটির হঠাৎ জনপ্রিয়তা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, মার্কিন চিপ নির্মাতা জায়ান্ট এনভিডিয়ার বাজারমূল্য এক দিনে ধস নেমেছিল ৬০ হাজার কোটি ডলারের, যা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে কোনো একক কোম্পানির জন্য একদিনে সবচেয়ে বড় পতন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।

এআইনির্ভর খাতে জড়িত আরও বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারও ওই ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিল।

এআই শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল ডিপসিক। ওই সময় পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল, এ খাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে চীন। তবে ডিপসিকের আকস্মিক আর্বিভাবের কারণে অনেকেই মনে করতে লাগলেন, যেন হঠাৎ করেই এআই খাতে সামনের কাতারে উঠে এসেছে চীন।

‘ডিপসিক-আর১’-এর আগমনকে ‘এআইয়ের স্পুটনিক মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বা পুঁজিপতি মার্ক আন্দ্রেসেন। এটি এমন এক ঘটনার ইঙ্গিত, যেমনভাবে এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট স্পুটনিক মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, ঠিক তেমনভাবেই এআইতে নতুন এক প্রতিযোগিতার সূচনা করেছে ডিপসিক।

 

এখনও প্রাসঙ্গিক

এরইমধ্যে বিশ্বকে অবাক করে দেওয়া ডিপসিকের ছয় মাস পেরোল। বর্তমানে চীনের এ যুগান্তকারী অ্যাপটি হারিয়ে গিয়েছে খবরের শিরোনাম থেকে। স্যান ফ্রান্সিসকোতে এখন আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নয় ডিপসিক। তবে এখনও পুরোপুরি মুছেও যায়নি অ্যাপটি।

ডিপসিক এআই সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যা আগে সমর্থন করেছিলেন চ্যাটজিপিটি নির্মাতা ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যানের মতো আমেরিকান প্রযুক্তি নির্বাহীরা।

এআই চিপ স্টার্টআপ ‘ডি-ম্যাট্রিক্স’-এর সিইও সিড শেথ বলেছেন, “আমরা এমন এক পথে ছিলাম যেখানে বড় হওয়াকে আরও ভালো বলে বিবেচনা করা হত।”

এআইকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য হয়ত ডেটা সেন্টার, সার্ভার, চিপ ও বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করাটাই শেষ পর্যন্ত সঠিক পথ ছিল না।

ডিপসিকের কাছে ওই সময় এআই মডেল তৈরির জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ ছিল না উল্লেখ করে শেথ বলেছেন, এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, “স্মার্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আপনি আসলে শক্তিশালী কোনো মডেল তৈরি করতেই পারেন”।

ডিপসিকের প্রতি মানুষের আগ্রহ হঠাৎ করেই খুব বেড়ে যায় জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। সবাই এত দ্রুত এ অ্যাপের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল যে, কোম্পানির আইটি বিভাগ তাদের কর্মীদের অ্যাপটি ব্যবহার করা থেকেও থামাতে পারেনি।

এর পরের সপ্তাহে বিভিন্ন কোম্পানি তড়িঘড়ি করে কর্মীদের অ্যাপটি ব্যবহার করতে নিষেধ করতে শুরু করে। কারণ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য হয়ত চীনের সঙ্গে ভাগ হয়ে যেতে পারে, সেখানেই সদর দপ্তর রয়েছে ডিপসিকের।

সঠিক সংখ্যা পাওয়া না গেলেও এখনও অনেক আমেরিকান ডিপসিক ব্যবহার করেন। খরচ কমানোর জন্য সিলিকন ভ্যালির কিছু কোম্পানি বা স্টার্টআপ আমেরিকার দামী এআই মডেলের বদলে ডিপসিক ব্যবহার করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।

একজন বিনিয়োগকারী বলেছিলেন, “অর্থ সংকটে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ডিপসিকের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ বাঁচে তা জরুরি প্রয়োজন যেমন আরও কর্মী নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খরচ মেটাতে সাহায্য করছে”।

তবে, সাবধানতাও অবলম্বন করছেন তারা।

কীভাবে ‘ডিপসিক-আর১’ নিজস্ব ডিভাইসে চালানো যায় তা অনলাইন ফোরামে শেয়ার করছেন ব্যবহারকারীরা, অর্থাৎ চীনের ডিপসিক সার্ভার ব্যবহারের বদলে নতুন উপায়ে ব্যবহার করা যায় মডেলটি। এতে করে চীনের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের ঝুঁকিও থাকছে না।

‘মিল পন্ড রিসার্চ’-এর সিইও ক্রিস্টোফার কেইন বলেছেন, “এটি হচ্ছে ডিপসিকের এআই ব্যবহারের সেরা উপায়। কারণ এখানে চিন্তা করতে হয় না চীনের কাছে কী তথ্য পাচার করছে মডেলটি।”

 

যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার এআই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল ডিপসিকের আগমন।

‘মার্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজ’-এর নীতি বিশ্লেষক ওয়েন্ডি চ্যাং বলেছেন, “ওই সময় পর্যন্ত চীনকে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরিতে পিছিয়ে থাকা দেশ হিসেবে দেখা হত। তাদের বিভিন্ন মডেল প্রতিযোগিতামূলক হলেও সবসময় পশ্চিমা দেশগুলোর সেরা মডেলের চেয়ে পিছিয়েই থাকত।”

‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ বা এলএলএম হচ্ছে এক ধরনের যুক্তি ব্যবস্থা, যেটিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যেন এটি কোনো বাক্য বা শব্দগুচ্ছের পরবর্তী শব্দটি কী হবে তা আগে থেকে বলে দিতে পারে।

ওই সময় ডিপসিক দাবি করেছিল, নিজেদের মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় খুব অল্প কম্পিউটেশনাল রিসোর্স ও কম খরচে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের মডেল তৈরি করেছে তারা। যার মাধ্যমে এআই মডেল তৈরির ধারণা এক রকম বদলে দিয়েছিল ডিপসিক।

কেবল ২০২৪ সালেই পাঁচশ কোটি ডলার ব্যয় করেছিল ওপেনএআই। এর বদলে ডিপসিকের গবেষকদের দাবি, ‘ডিপসিক-আর১’ মডেল তৈরিতে কেবল ৫৬ লাখ ডলার খচর হয়েছে তাদের, যা সক্ষমতার একাধিক পরীক্ষায় ওপেনএআইয়ের ‘০১’ নামের এআই মডেলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে প্রতিবেদন লিখেছে বিবিসি।

“বিশ্বের সামনে চীনের এআই খাতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানটি প্রকাশ করে দিয়েছে ডিপসিক,” বলেছেন চ্যাং।

আর এ পরিবর্তনকে কাজে লাগাতে পেরেছেন মার্কিন এআই ডেভেলপাররা।

বিবিসি লিখেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ও বড় বিভিন্ন মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির পক্ষ থেকে ঘোষিত এআইসম্পর্কিত চুক্তি ও অন্যান্য উদ্যোগকে প্রায়ই এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন সেগুলো চীনের থেকে এগিয়ে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গত মাসে নিজেদের ‘এআই অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রকাশের সময় ট্রাম্প প্রশাসনের এআই বিষয়ক প্রধান ডেভিড স্যাকস বলেছেন, এ প্রযুক্তি “অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এআইতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ধরে রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।”

তবে নিজেদের শেকড় চীনে থাকার কারণে তৈরি নিরাপত্তা উদ্বেগ কখনোই কমাতে পারেনি ডিপসিক।

জুনে রয়টার্স প্রতিবেদনে লিখেছে, কোম্পানিটির বেইজিং সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের ধারণা “ইচ্ছাকৃতভাবে চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে সহায়তা দিয়েছে ডিপসিক এবং হয়ত ভবিষ্যতেও দেবে।”

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেয়নি ডিপসিক। তবে কোম্পানির প্রাইভেসি নীতিতে উল্লেখ রয়েছে, তাদের বিভিন্ন সার্ভার চীনে অবস্থিত।

“আপনি যখন আমাদের বিভিন্ন পরিষেবা ব্যবহার করবেন তখন আপনার ব্যক্তিগত তথ্য আমাদের চীনে অবস্থিত সার্ভারে প্রক্রিয়া ও সংরক্ষণ করা হতে পারে। সরাসরি আপনার ব্যক্তিগত তথ্যও আমাদের কাছে সরবরাহ করা হতে পারে বা আমাদের বা কোনও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তথ্য স্থানান্তর হতে পারে।”

 

নতুন পদ্ধতি?

এ সপ্তাহের শুরুতে ওপেনএআই একজোড়া এআই মডেল প্রকাশের পর ডিপসিক নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে।

‘ডি-ম্যাট্রিক্স’-এর শেথ বলেছেন, “এ সপ্তাহে ওপেনএআই যা ঘোষণা করেছে তার সঙ্গে ডিপসিকের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

“ডিপসিক প্রমাণ করেছে, ছোট ও আরও দক্ষ মডেল দিয়েও চমকপ্রদ কর্মসক্ষমতা পাওয়া সম্ভব, যা পুরো এআই শিল্পের মানসিকতাকেই বদলে দিয়েছে। আমরা এখন যা দেখছি তা হচ্ছে, সেই চিন্তারই পরবর্তী ধাপ; এমন মডেলের দিকে ঝোঁক যেগুলো সঠিক মাপের, আরও দ্রুত, সাশ্রয়ী সহজে বড় পরিসরে ব্যবহারও করা যায়।”

তবে অন্যান্য বড় বড় মার্কিন এআই কোম্পানি এখনও আগের মতোই তাদের পুরানো নিয়ম ও পদ্ধতিই অনুসরণ করছে।

এসব ফ্রি মডেল প্রকাশের কয়েকদিন পরই নিজেদের জিপিটি-৫ মডেলটি উন্মোচন করেছে ওপেনএআই। এর আগে কোম্পানিটি বলেছিল, নতুন মডেল তৈরির জন্য নিজেদের কম্পিউটিং সক্ষমতা ও এআই অবকাঠামো অনেক বাড়িয়েছে তারা।

বড় বিভিন্ন মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি শীর্ষ পর্যায়ের এআই বিশেষজ্ঞদের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। এজন্য তারা নতুন ডেটা সেন্টার তৈরির বড় ঘোষণাও দিচ্ছে।

মার্কিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জায়ান্ট মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ তার এআই স্বপ্ন পূরণের জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করেছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি থেকে কর্মীদের ভাগিয়ে আনতে ১০ কোটি ডলারের বেতনও অফার করেছেন।

অন্যদিকে ডিপসিক আসার পর এনভিডিয়ার শেয়ার হঠাৎ কমে গেলেও তা আবার নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানি হয়ে উঠেছে এনভিডিয়া।

‘মিল পন্ড রিসার্চ’-এর কেইন বলেছেন, “ডিপসিকের প্রাথমিক ধারণাটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর প্রমাণিত হয়েছে।”

আমরা আবার এমন এক ভবিষ্যতে ফিরে যাচ্ছি, যেখানে এআই মূলত আরও বেশি ডেটা সেন্টার, আরও বেশি চিপ এবং আরও বেশি শক্তির ওপর নির্ভর করবে।

অন্যভাবে বললে, ডিপসিক যে বদল আনতে চেয়েছিল তা বেশিদিন টেকেনি।

 

আর ডিপসিকের কী হল?

‘ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনি’র সহকারী অধ্যাপক মারিনা ঝাং বলেছেন, “এখন নিজের গতিপ্রকৃতি ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে ডিপসিক।”

কিছু অংশে কাজের সমস্যার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা কোম্পানির কঠোর প্রতিযোগিতার মুখেও পড়েছে ডিপসিক। কোম্পানিটির পরবর্তী ‘ডিপসিক-আর২’ মডেলটি সময়মতো আসছে না, যার একটি কারণ হচ্ছে উচ্চমানের চিপের ঘাটতি বলেও উল্লেখ করেছেন ঝাং।

 

 

 

প্রযুক্তি ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

ডিপসিকের হঠাৎ জনপ্রিয়তা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, এনভিডিয়ার বাজারমূল্য এক দিনে ৬০ হাজার কোটি ডলার কমে গিয়েছিল।

বাজারে ঝড় তোলা ডিপসিক শেষ পর্যন্ত কী করল?

আপডেট সময় ০২:২৫:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার কেবল এক সপ্তাহ আগে সিলিকন ভ্যালিতে ঝড় তুলেছিল নতুন এক চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই অ্যাপ ডিপসিক।

রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপল চার্টে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপ হিসেবে শীর্ষে উঠে আসে ডিপসিকের ‘ডিপসিক-আর১’ সংস্করণটি।

ওই সময় কোম্পানিটি বলেছিল, তাদের নতুন চ্যাটবটটি কেবল ওপেনএআইয়ের এআই অ্যাপ চ্যাটজিপিটিরই প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং মডেলটি তৈরিতে তাদের খুব সামান্য অর্থই খরচ হয়েছে।

এসব দাবি ও অ্যাপটির হঠাৎ জনপ্রিয়তা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, মার্কিন চিপ নির্মাতা জায়ান্ট এনভিডিয়ার বাজারমূল্য এক দিনে ধস নেমেছিল ৬০ হাজার কোটি ডলারের, যা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে কোনো একক কোম্পানির জন্য একদিনে সবচেয়ে বড় পতন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।

এআইনির্ভর খাতে জড়িত আরও বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারও ওই ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিল।

এআই শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল ডিপসিক। ওই সময় পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল, এ খাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে চীন। তবে ডিপসিকের আকস্মিক আর্বিভাবের কারণে অনেকেই মনে করতে লাগলেন, যেন হঠাৎ করেই এআই খাতে সামনের কাতারে উঠে এসেছে চীন।

‘ডিপসিক-আর১’-এর আগমনকে ‘এআইয়ের স্পুটনিক মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বা পুঁজিপতি মার্ক আন্দ্রেসেন। এটি এমন এক ঘটনার ইঙ্গিত, যেমনভাবে এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট স্পুটনিক মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, ঠিক তেমনভাবেই এআইতে নতুন এক প্রতিযোগিতার সূচনা করেছে ডিপসিক।

 

এখনও প্রাসঙ্গিক

এরইমধ্যে বিশ্বকে অবাক করে দেওয়া ডিপসিকের ছয় মাস পেরোল। বর্তমানে চীনের এ যুগান্তকারী অ্যাপটি হারিয়ে গিয়েছে খবরের শিরোনাম থেকে। স্যান ফ্রান্সিসকোতে এখন আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নয় ডিপসিক। তবে এখনও পুরোপুরি মুছেও যায়নি অ্যাপটি।

ডিপসিক এআই সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যা আগে সমর্থন করেছিলেন চ্যাটজিপিটি নির্মাতা ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যানের মতো আমেরিকান প্রযুক্তি নির্বাহীরা।

এআই চিপ স্টার্টআপ ‘ডি-ম্যাট্রিক্স’-এর সিইও সিড শেথ বলেছেন, “আমরা এমন এক পথে ছিলাম যেখানে বড় হওয়াকে আরও ভালো বলে বিবেচনা করা হত।”

এআইকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য হয়ত ডেটা সেন্টার, সার্ভার, চিপ ও বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করাটাই শেষ পর্যন্ত সঠিক পথ ছিল না।

ডিপসিকের কাছে ওই সময় এআই মডেল তৈরির জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ ছিল না উল্লেখ করে শেথ বলেছেন, এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, “স্মার্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আপনি আসলে শক্তিশালী কোনো মডেল তৈরি করতেই পারেন”।

ডিপসিকের প্রতি মানুষের আগ্রহ হঠাৎ করেই খুব বেড়ে যায় জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। সবাই এত দ্রুত এ অ্যাপের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল যে, কোম্পানির আইটি বিভাগ তাদের কর্মীদের অ্যাপটি ব্যবহার করা থেকেও থামাতে পারেনি।

এর পরের সপ্তাহে বিভিন্ন কোম্পানি তড়িঘড়ি করে কর্মীদের অ্যাপটি ব্যবহার করতে নিষেধ করতে শুরু করে। কারণ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য হয়ত চীনের সঙ্গে ভাগ হয়ে যেতে পারে, সেখানেই সদর দপ্তর রয়েছে ডিপসিকের।

সঠিক সংখ্যা পাওয়া না গেলেও এখনও অনেক আমেরিকান ডিপসিক ব্যবহার করেন। খরচ কমানোর জন্য সিলিকন ভ্যালির কিছু কোম্পানি বা স্টার্টআপ আমেরিকার দামী এআই মডেলের বদলে ডিপসিক ব্যবহার করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।

একজন বিনিয়োগকারী বলেছিলেন, “অর্থ সংকটে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ডিপসিকের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ বাঁচে তা জরুরি প্রয়োজন যেমন আরও কর্মী নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খরচ মেটাতে সাহায্য করছে”।

তবে, সাবধানতাও অবলম্বন করছেন তারা।

কীভাবে ‘ডিপসিক-আর১’ নিজস্ব ডিভাইসে চালানো যায় তা অনলাইন ফোরামে শেয়ার করছেন ব্যবহারকারীরা, অর্থাৎ চীনের ডিপসিক সার্ভার ব্যবহারের বদলে নতুন উপায়ে ব্যবহার করা যায় মডেলটি। এতে করে চীনের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের ঝুঁকিও থাকছে না।

‘মিল পন্ড রিসার্চ’-এর সিইও ক্রিস্টোফার কেইন বলেছেন, “এটি হচ্ছে ডিপসিকের এআই ব্যবহারের সেরা উপায়। কারণ এখানে চিন্তা করতে হয় না চীনের কাছে কী তথ্য পাচার করছে মডেলটি।”

 

যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার এআই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল ডিপসিকের আগমন।

‘মার্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজ’-এর নীতি বিশ্লেষক ওয়েন্ডি চ্যাং বলেছেন, “ওই সময় পর্যন্ত চীনকে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরিতে পিছিয়ে থাকা দেশ হিসেবে দেখা হত। তাদের বিভিন্ন মডেল প্রতিযোগিতামূলক হলেও সবসময় পশ্চিমা দেশগুলোর সেরা মডেলের চেয়ে পিছিয়েই থাকত।”

‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ বা এলএলএম হচ্ছে এক ধরনের যুক্তি ব্যবস্থা, যেটিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যেন এটি কোনো বাক্য বা শব্দগুচ্ছের পরবর্তী শব্দটি কী হবে তা আগে থেকে বলে দিতে পারে।

ওই সময় ডিপসিক দাবি করেছিল, নিজেদের মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় খুব অল্প কম্পিউটেশনাল রিসোর্স ও কম খরচে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের মডেল তৈরি করেছে তারা। যার মাধ্যমে এআই মডেল তৈরির ধারণা এক রকম বদলে দিয়েছিল ডিপসিক।

কেবল ২০২৪ সালেই পাঁচশ কোটি ডলার ব্যয় করেছিল ওপেনএআই। এর বদলে ডিপসিকের গবেষকদের দাবি, ‘ডিপসিক-আর১’ মডেল তৈরিতে কেবল ৫৬ লাখ ডলার খচর হয়েছে তাদের, যা সক্ষমতার একাধিক পরীক্ষায় ওপেনএআইয়ের ‘০১’ নামের এআই মডেলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে প্রতিবেদন লিখেছে বিবিসি।

“বিশ্বের সামনে চীনের এআই খাতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানটি প্রকাশ করে দিয়েছে ডিপসিক,” বলেছেন চ্যাং।

আর এ পরিবর্তনকে কাজে লাগাতে পেরেছেন মার্কিন এআই ডেভেলপাররা।

বিবিসি লিখেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ও বড় বিভিন্ন মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির পক্ষ থেকে ঘোষিত এআইসম্পর্কিত চুক্তি ও অন্যান্য উদ্যোগকে প্রায়ই এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন সেগুলো চীনের থেকে এগিয়ে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গত মাসে নিজেদের ‘এআই অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রকাশের সময় ট্রাম্প প্রশাসনের এআই বিষয়ক প্রধান ডেভিড স্যাকস বলেছেন, এ প্রযুক্তি “অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এআইতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ধরে রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।”

তবে নিজেদের শেকড় চীনে থাকার কারণে তৈরি নিরাপত্তা উদ্বেগ কখনোই কমাতে পারেনি ডিপসিক।

জুনে রয়টার্স প্রতিবেদনে লিখেছে, কোম্পানিটির বেইজিং সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের ধারণা “ইচ্ছাকৃতভাবে চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে সহায়তা দিয়েছে ডিপসিক এবং হয়ত ভবিষ্যতেও দেবে।”

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেয়নি ডিপসিক। তবে কোম্পানির প্রাইভেসি নীতিতে উল্লেখ রয়েছে, তাদের বিভিন্ন সার্ভার চীনে অবস্থিত।

“আপনি যখন আমাদের বিভিন্ন পরিষেবা ব্যবহার করবেন তখন আপনার ব্যক্তিগত তথ্য আমাদের চীনে অবস্থিত সার্ভারে প্রক্রিয়া ও সংরক্ষণ করা হতে পারে। সরাসরি আপনার ব্যক্তিগত তথ্যও আমাদের কাছে সরবরাহ করা হতে পারে বা আমাদের বা কোনও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তথ্য স্থানান্তর হতে পারে।”

 

নতুন পদ্ধতি?

এ সপ্তাহের শুরুতে ওপেনএআই একজোড়া এআই মডেল প্রকাশের পর ডিপসিক নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে।

‘ডি-ম্যাট্রিক্স’-এর শেথ বলেছেন, “এ সপ্তাহে ওপেনএআই যা ঘোষণা করেছে তার সঙ্গে ডিপসিকের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

“ডিপসিক প্রমাণ করেছে, ছোট ও আরও দক্ষ মডেল দিয়েও চমকপ্রদ কর্মসক্ষমতা পাওয়া সম্ভব, যা পুরো এআই শিল্পের মানসিকতাকেই বদলে দিয়েছে। আমরা এখন যা দেখছি তা হচ্ছে, সেই চিন্তারই পরবর্তী ধাপ; এমন মডেলের দিকে ঝোঁক যেগুলো সঠিক মাপের, আরও দ্রুত, সাশ্রয়ী সহজে বড় পরিসরে ব্যবহারও করা যায়।”

তবে অন্যান্য বড় বড় মার্কিন এআই কোম্পানি এখনও আগের মতোই তাদের পুরানো নিয়ম ও পদ্ধতিই অনুসরণ করছে।

এসব ফ্রি মডেল প্রকাশের কয়েকদিন পরই নিজেদের জিপিটি-৫ মডেলটি উন্মোচন করেছে ওপেনএআই। এর আগে কোম্পানিটি বলেছিল, নতুন মডেল তৈরির জন্য নিজেদের কম্পিউটিং সক্ষমতা ও এআই অবকাঠামো অনেক বাড়িয়েছে তারা।

বড় বিভিন্ন মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি শীর্ষ পর্যায়ের এআই বিশেষজ্ঞদের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। এজন্য তারা নতুন ডেটা সেন্টার তৈরির বড় ঘোষণাও দিচ্ছে।

মার্কিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জায়ান্ট মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ তার এআই স্বপ্ন পূরণের জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করেছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি থেকে কর্মীদের ভাগিয়ে আনতে ১০ কোটি ডলারের বেতনও অফার করেছেন।

অন্যদিকে ডিপসিক আসার পর এনভিডিয়ার শেয়ার হঠাৎ কমে গেলেও তা আবার নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানি হয়ে উঠেছে এনভিডিয়া।

‘মিল পন্ড রিসার্চ’-এর কেইন বলেছেন, “ডিপসিকের প্রাথমিক ধারণাটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর প্রমাণিত হয়েছে।”

আমরা আবার এমন এক ভবিষ্যতে ফিরে যাচ্ছি, যেখানে এআই মূলত আরও বেশি ডেটা সেন্টার, আরও বেশি চিপ এবং আরও বেশি শক্তির ওপর নির্ভর করবে।

অন্যভাবে বললে, ডিপসিক যে বদল আনতে চেয়েছিল তা বেশিদিন টেকেনি।

 

আর ডিপসিকের কী হল?

‘ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনি’র সহকারী অধ্যাপক মারিনা ঝাং বলেছেন, “এখন নিজের গতিপ্রকৃতি ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে ডিপসিক।”

কিছু অংশে কাজের সমস্যার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা কোম্পানির কঠোর প্রতিযোগিতার মুখেও পড়েছে ডিপসিক। কোম্পানিটির পরবর্তী ‘ডিপসিক-আর২’ মডেলটি সময়মতো আসছে না, যার একটি কারণ হচ্ছে উচ্চমানের চিপের ঘাটতি বলেও উল্লেখ করেছেন ঝাং।

 

 

 

প্রযুক্তি ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম