১১:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
উত্তরার দিয়াবাড়িতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মাঝে যখন সরকারের দুই উপদেষ্টাসহ অন্যরা অবরুদ্ধ, তখন নয় কিলোমিটার দূরে সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র হল সংঘাতে।

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: বিক্ষোভ আর সংঘাতের এক শোকের দিন

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০৮:২৩:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
  • / ২১ বার পড়া হয়েছে

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিধ্বস্ত ভবনের বাইরে উৎসুক মানুষের ভিড়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

 

যেই শিশুদের কলকাকলীতে সরব থাকার কথা স্কুল প্রাঙ্গণ, তাদের পুড়ে অঙ্গার শবদেহ নিয়ে গোরস্থানমুখী স্বজন, আর হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর অন্যদের নিয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষায় স্তব্ধ বাবা-মা।

নিভে যাওয়া কোমল প্রাণের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোকের দিনে মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাতাসে তখনো পোড়া গন্ধ; এর মাঝে ছয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে ছড়াল উত্তাপ।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মাঝে যখন সরকারের দুই উপদেষ্টাসহ অন্যরা অবরুদ্ধ, তখন নয় কিলোমিটার দূরে সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র হল সংঘাতে।

আগের দিন সোমবার বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২৯ জন মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে সরকার। আর চিকিৎসাধীন আছে ৬৭ জন।

বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।

সোমবার এক শোকবার্তায় আহতদের চিকিৎসায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার সেই প্রস্তাবের সূত্র ধরে আহতদের ভারতে চিকিৎসার প্রস্তাব দিয়ে সরকারকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে ভারতীয় হাই কমিশন।

দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছেন, বিমান বিধ্বস্তে যারা আহত হয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও দগ্ধদের জন্য বিশেষায়িত কিছু সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে ভারত। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনায় এ পদক্ষেপ চূড়ান্ত হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের একটি দলও রাতে পৌঁছানোর তথ্য দিয়েছে সিএমএইচ।

এদিকে দিনভর সচিবালয় ও মাইলস্টোন স্কুলের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সংঘাত ও দুই উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় রাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

দলগুলো আগের মতই মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ‘কঠোর’ হতে বলেছেন।

 

 

অশ্রুজলে শেষ বিদায়

জঙ্গি বিমান আছড়ে পড়ে শিশুদের হতাহতের ঘটনাটি হয়ে ওঠেছে দেশজুড়ে শোক আর বেদনার গল্পের সমষ্টি। এখানে নিহতের সারিতে যেমন আছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী, নয় বছরের শিশু সায়মা আক্তার; তেমনি আছেন তাদের প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী।

ভোলার দৌলতখান থেকে আসা শিক্ষার্থী তাহিয়া তাবাসসুম নাজিয়া ওপারে পাড়ি জমিয়েছে সোমবার গভীর রাতে; এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তার ছোট ভাই নাফি।

এখন পর্যন্ত নিহত ২৯ জনের মধ্যে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া ২২ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে পরিবারের সদস্যদের কাছে। পুড়ে অঙ্গার ছয়জনের পরিচয় নিশ্চিতে ডিএনএ টেস্ট করার কথা জানিয়েছে সরকার।

সিএমএইচে থাকা ছয়টি মৃতদেহ, যেগুলো শনাক্ত হয়নি, তাদের ডিএনএ নমুন সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।

এ ছাড়া পাঁচটি দেহাবশেষের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে এবং সিআইডি তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে বলে জানিয়েছেন তিন।

শাহাদাত বলেন, “যেহেতু এখনো ৬ জন মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, তাই যারা তাদের সন্তান বা স্বজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ—আমাদের প্রদত্ত তালিকায় যদি তাদের সন্তানের বা স্বজনের নাম না থাকে, তাহলে দয়া করে মালিবাগ সিআইডি ভবনে গিয়ে যোগাযোগ করুন এবং ডিএনএ নমুনার জন্য সহযোগিতা করুন।”

মঙ্গলবার নিহত কয়েকজনকে শেষ শয্যায় শায়িত করা হয়েছে। তাদের একজন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিপ্রবর্তা গ্রামের শাহ আলম আর রিনা বেগম দম্পতির মেয়ে সায়মা আক্তার।

বাড়ির উঠানেই সায়মাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে।

বাড়িভর্তি স্বজনদের মধ্যে বিলাপ করে রিনা বেগম বার বার শুধু এই একটা কথাই বলছিলেন। বার বার তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী যারা এই পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন, তারা কাঁদছিলেন অঝোরে।

রিনা বেগম বলছিলেন, “প্রতিদিন আমি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেতাম। সোমবার আমার এক ভাই তাকে স্কুলে নিয়ে যায়। পরে ফেইসবুকে জানতে পারি স্কুলে বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। আমার মা স্কুলে যাওয়ার আগে বলে গেলো, মা, স্কুলে গেলাম, টা টা।

“এরপর আর আমার মার সঙ্গে কথা হয়নি। মা আর কখনও বলবে না, মা স্কুলে যাই, টা টা।”

একই স্কুল থেকে বড় ভাই সাব্বিরও এসএসসি পাস করেছে। বোনের কবরের পাশে সাব্বির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল, “বোন তুমি আমাকে রেখে চলে গেলে। আমরা দু’জন একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। কত কথা বলতাম, আজ তুমি চুপ কেন বোন!”

সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীদের বাঁচিয়ে নিজের জীবন সপে দিয়ে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নেওয়া শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর শবযাত্রায় হাঁটল তার দুই শিশু সন্তান। নিজের পোড়া শরীর নিয়ে কীভাবে শিশুদের রক্ষাকবচ হয়েছিলেন, তা ফিরছে সবার মুখে।

গ্রামের বাড়ি নীলফামারির জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে তার লাশ নিয়ে যান স্বজনরা৷ সেখানে জানাজার পর তার দাফন হয়। এর আগে ভোরে ঢাকার উত্তরায় গাউছুল আজম জামে মসজিদে তার জানাজা হয়।

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় রজনী আক্তারের; প্রাণে বেঁচে ফেরা মেয়ে ঝুমঝুমকে যোগ দিতে হল তার মায়ের শেষযাত্রায়। তিন সন্তান রেখে যাওয়া এই নারীকে দাফন করা হয় কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পারিবারিক কবরস্থানে।

প্রশিক্ষণের শেষ ধাপে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরকে রাজশাহীতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে।

বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত তৃতীয় শ্রেণির মেহেনাজ আফরি হুমায়রার বাবা বলছেন, প্রতিদিন বাবার কপালে চুমু দিয়ে স্কুলের পথ ধরত সে। কফিনে চুমু খেয়ে ৯ বছরের মেয়েকে কবরে শায়িত করেন দেলোয়ার হোসাইন।

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া কেরানিপাড়া মেহেনাজের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

তার বাবা দেলোয়ার হোসাইন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজেরই বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তবে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তিনি ও তার স্ত্রী সুমি আক্তার প্রাণে বেঁচে গেছেন।

কুয়েত প্রবাসী বনি আমিন শেখের স্ত্রী তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকেন উত্তরাতে। প্রাণ হারিয়েছে তাদের বড় মেয়ে, তৃতীয় শ্রেণির ফাতেমা আক্তার। জ্বরের কারণে স্কুলে না যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছে তার ছোট ভাই ওমর।

ফাতেমার মামা স্বপন মীর বলেছেন, বিমান দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কুয়েত থেকে দেশে এসেছেন বনি আমিন শেখ। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় কুনিয়া গ্রামের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয় ফাতেমাকে।

 

 

সচিবালয় এলাকায় সংঘাত

মাইলস্টোন স্কুলে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের দাবি ওঠে। মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতায় পরীক্ষা স্থগিতের সেই ঘোষণা আসে সোমবার রাত ৩টার দিকে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে সেই খবর না পৌঁছানোয় কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসতে হয় তাদের।

শিক্ষা উপদেষ্টার বরাতে তথ্য উপদেষ্টা সোমবার গভীর রাতে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি ফেইসবুকে জানান। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে অনেক পরে, যা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এরপর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এবং শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার দুপুরে প্রথমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করতে যায়। সেখান থেকে বেলা দেড়টার দিকে তারা সচিবালয়ের সামনে জড়ো হন।

ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, নূর মোহাম্মদ কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, কমার্স কলেজ, আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, মিরপুর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ আরো কিছু শিক্ষার্থী এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

শুরুতে তারা সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটকের সামনে বিক্ষোভ দেখান। পরে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রের বাকি ফটোগুলোও বন্ধ করে দেন।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবি মুখে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় সরকার। তাদের অন্যান্য দাবি পর্যালোচনার জন্য কমিটি করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান।

কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়লে সংঘাতের সূত্রপাত হয়।

পুলিশ লাঠিপেটা করে, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের সচিবালয়ের ভেতর থেকে বের করতে পারলেও আশপাশের এলাকায় কয়েক ঘণ্টা ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলে। সচিবালয় এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

এই সংঘর্ষের মধ্যে আহত ৬৬ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন।

সিটি কলেজের শিক্ষার্থীর তানভীর বলেন, “গোপালগঞ্জের সামান্য কারণে এইচএসসি পরীক্ষার স্থগিত করেছে। অথচ কালকে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, বারবার বলার পরও তারা এইচএসসি পরীক্ষার স্থগিত করেনি। রাত ৩টা বাজে যখন স্থগিত করেছে ততক্ষণের সব শিক্ষার্থীরা জানতেও পারেনি।

“সকালবেলা অনেকের পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছে। এগুলো স্পষ্ট দায়িত্ব অবহেলা এবং একঘেয়েমি।”

পরে শিক্ষার্থীদের গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট এলাকায় সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সন্ধ্যার কিছু আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

সচিবালয় ও মাইলস্টোন স্কুলে বিক্ষোভ ও সংঘাতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের ‘যোগ’ দেখছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “ভয়াবহ শোকবহ পরিস্থিতিকে পুঁজি করে সকালে মাইলস্টোনের ওখানে একটু বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। আবার সচিবালয়ের এখানেও বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।

“বিশৃঙ্খলার পিছনে শোনা যায় আওয়ামী লীগেরও কিছু কিছু দুষ্ট চক্র এই পরিস্থিতিটাকে ঘোলাটে করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা নিশ্চিত না।”

কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসীরা স্যাবোট্যাজ’ করছে দাবি করে তাদের প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

আর উদ্ভুত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কেউ যাতে সুবিধা নিতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করেন নাহিদ। এর কারণ তুলে ধরে তিনি দাবি করেন, “আজকে সচিবালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কাউকে কাউকে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের সামাজিক মাধ্যম পেইজগুলো থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।”

 

 

শোকস্তব্ধ মাইলস্টোনে ৯ ঘন্টা আটকা দুই উপদেষ্টা

মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার।

নয় ঘণ্টার নানা ঘটনা প্রবাহের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশ প্রহরায় সেখান থেকে বের হতে পেরেছেন। পতাকাবিহীন সরকারি গাড়িতে চড়ে মেট্রোরেলের ডিপোর ভেতরের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে হন তারা।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমসহ আরও তিনজন এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। তারাও সারাদিন কলেজে আটকা ছিলেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “উপদেষ্টারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। পরে শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানান। সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। এজন্য উপদেষ্টারা বের হতে পারছিলেন না।

“সন্ধ্যার দিকে শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারা বেরিয়ে গেছেন।”

বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণসহ ছয় দাবিতে এদিন সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু করে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা।

বেলা পৌনে ১০টায় ঘটনাস্থলে এসে তোপের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এসময় তাকে দেখে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি দেখেও একই স্লোগান দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তারা ‘উই ওয়ান্ট, জাস্টিস’, ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।

পরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আইন উপদেষ্টা। শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।

ওই বৈঠকের পর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বেরিয়ে এসে আসিফ নজরুল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সব দাবি ‘মেনে নেওয়ার’ আশ্বাস দেন।

তিনি বলেন, “আপনারা যে দাবিগুলো করেছেন, ছয় দফা দাবি সেটার সাথে আমরা সম্পূর্ণ একমত। এবং আপনারা যে দাবি করেছেন তা অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি।

“আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি, আমরা আপনাদের প্রতিটি দাবি পূরণ করব। আমাদের ওপর আপনারা বিশ্বাস রাখেন।”

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে ‘যারা খারাপ ব্যবহার করেছেন’ তাদের বিরুদ্ধেও ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে’ আশ্বাস দেন আইন উপদেষ্টা।

আইন উপদেষ্টা কথা শেষ হওয়ার পরপরই তাদের দিকে তেড়ে যায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। দুই উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব তখন স্কুলের সম্মেলন কক্ষে চলে যান।

শিক্ষার্থীরা তখন বাইরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। দুপুর সোয়া ২টার দিকে উপদেষ্টারা বের হবেন শোনার পর শিক্ষার্থীদের একটি দল মূল ফটক আটকে দেয়। এ সময় পুলিশের একটি ডাবল কেবিন পিকআপও ভাংচুরও করা হয়।

বেলা ৩টার দিকে এক প্লাটুন এপিবিএন, কয়েক প্লাটুন ডিএমপির রিজার্ভ পুলিশ, এক প্লাটুন এটিইউ আসে মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে।

শিক্ষকরা এ সময় শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে দেন এবং বের হয়ে যেতে বলেন। বাড়তি পুলিশের উপস্থিতির মধ্যে বিক্ষোভ থামিয়ে শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছাড়লেও কিছুক্ষণ পর তারা স্কুলের বাইরে গোল চত্বরে অবস্থান নেয়।

এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা ৫ নম্বর ভবনের কাচ ভাংচুর শুরু করলে উপদেষ্টারা ভবনটির নিচ তলার সম্মেলনকক্ষ ছেড়ে উপরের কোনো একটা তলায় অবস্থান নেন। পরে তৃতীয় তলা থেকে তাদের নেমে আসতে দেখা যায়।

বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তারা পতাকাবিহীন সরকারি গাড়িতে চেপে সামনে পেছনে কয়েকশ পুলিশের পাহারা নিয়ে স্কুল ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্কুলের বাইরে গোল চত্বরে কয়েকশ শিক্ষার্থীর অবস্থানের কারণে ১৫ মিনিট পর তারা আবার ভেতরে ফিরে যান।

সন্ধ্যার পর পুলিশ গোলচত্বর থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিলে দুই উপদেষ্টার ফেরার সুযোগ তৈরি হয়।

 

 

শিক্ষার্থীদের ছয় দাবি হল-

>> নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ করা

>> আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ করা।

>> শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় জনসম্মুখে সেনা সদস্যদের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া।

>> নিহত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

>> বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো উড়োজাহাজ বাতিল করে আধুনিক উড়োযান চালু করা।

>> বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করে আরও ‘মানবিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা’ চালু করা।

 

পরীক্ষা পেছানোর ‘অদ্ভূত ঘোষণা’

মাইলস্টোনে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে এত বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীর হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা আসার পরই আলোচনায় আসে এদিনের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কি-না।

শিক্ষা মন্ত্রণালযের তরফে এদিন পরীক্ষা স্থগিত করার বিষয়ে কোনো বক্তব্য না আসার মধ্যে সোমবার রাতে আন্দোলনে নামে একদল শিক্ষার্থী। শোকের দিনে পরীক্ষা স্থগিতের পাশাপাশি শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।

ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবরোধের মধ্যে সোমবার দিবাগত রাত ২টা ৪১ মিনিটে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ফেইসবুক পেইজে এক অ্যাডমিন পোস্টে বলা হয়, “শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎ হয়েছে। আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা।”

তখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ড থেকে কোনো ধরনের ঘোষণা আসেনি। গভীর রাতে শিক্ষামন্ত্রী আবরার, তার দপ্তর এবং শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের টেলিফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।

সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর মাত্র দুই ঘন্টা আগে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মোর্চা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি খন্দোকার এহসানুল কবির স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা স্থগিতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে।

এর কিছু সময় প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষা স্থগিত করার কথাও জানানো হয়। পরে মঙ্গলবার রাতে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতির স্বাক্ষরে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২৪ তারিখের পরীক্ষাও স্থগিতের তথ্য জানানো হয়।

 

‘মারধর’ তদন্তে সেনাবাহিনী

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভিড় ‘নিয়ন্ত্রণের সময়’ কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে ‘শিক্ষার্থীদের মারধরের’ যে অভিযোগ উঠেছে তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর।

ঘটনাটিকে ‘অনভিপ্রেত’ হিসেবে বর্ণনা করে আইএসপিআর বলেছে, তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মঙ্গলবার আইএসপিআর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মাইলস্টোন স্কুল ভবনে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরের পরিস্থিতিরও ব্যাখ্যা দিয়েছে।

বলা হয়েছে, উদ্ধার কাজ নির্বিঘ্ন করতে সেখানে ভিড় করা ‘একদল উৎসুক জনতাকে’ সরাতে গেলে তাদের সঙ্গে সেনাসদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের ‘ভুল বোঝাবুঝি ও বাদানুবাদের’ সৃষ্টি হয়, যা এক পর্যায়ে একটি ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার অবতারণা করে।

এর আগে সেনাবাহিনীর হাতে শিক্ষার্থীদের মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।

 

 

‘গুজবে’ কান না দেওয়ার পরামর্শ বিমান বাহিনী প্রধানের

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘লাশ লুকানোর গুজব’ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।

মঙ্গলবার কুর্মিটোলায় বীর উত্তম এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে ওই বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ বিষয়ে কথা বলেন বিমান বাহিনী প্রধান।

তিনি বলেন, “ক্র্যাশ সাইটে এক ধরনের অশান্তি বিরাজ, এটা খুবই দুঃখজনক। অনেক গুজব চলছে, এই গুজবে কান দেবেন না। যখন আমাদের কাছে যে আপডেট আসছে, আহত-নিহতের, সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি।

“এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয়ই নাই। কার কাছ থেকে লুকাব? আপনারা আমাদের দেশের মানুষ, আমরাও এই দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে।”

হাসান মাহমুদ বলেন, বিমান বাহিনীর বহরে থাকা জঙ্গি বিমানগুলোর বয়স বেশি হলেও ‘লাইফটাইম’ পার হয়ে যায়নি। আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ‘ছাড় দেয় না’ বিমান বাহিনী।

 

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

উত্তরার দিয়াবাড়িতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মাঝে যখন সরকারের দুই উপদেষ্টাসহ অন্যরা অবরুদ্ধ, তখন নয় কিলোমিটার দূরে সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র হল সংঘাতে।

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: বিক্ষোভ আর সংঘাতের এক শোকের দিন

আপডেট সময় ০৮:২৩:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

 

যেই শিশুদের কলকাকলীতে সরব থাকার কথা স্কুল প্রাঙ্গণ, তাদের পুড়ে অঙ্গার শবদেহ নিয়ে গোরস্থানমুখী স্বজন, আর হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর অন্যদের নিয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষায় স্তব্ধ বাবা-মা।

নিভে যাওয়া কোমল প্রাণের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোকের দিনে মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাতাসে তখনো পোড়া গন্ধ; এর মাঝে ছয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে ছড়াল উত্তাপ।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মাঝে যখন সরকারের দুই উপদেষ্টাসহ অন্যরা অবরুদ্ধ, তখন নয় কিলোমিটার দূরে সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র হল সংঘাতে।

আগের দিন সোমবার বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২৯ জন মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে সরকার। আর চিকিৎসাধীন আছে ৬৭ জন।

বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।

সোমবার এক শোকবার্তায় আহতদের চিকিৎসায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার সেই প্রস্তাবের সূত্র ধরে আহতদের ভারতে চিকিৎসার প্রস্তাব দিয়ে সরকারকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে ভারতীয় হাই কমিশন।

দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছেন, বিমান বিধ্বস্তে যারা আহত হয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও দগ্ধদের জন্য বিশেষায়িত কিছু সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে ভারত। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনায় এ পদক্ষেপ চূড়ান্ত হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের একটি দলও রাতে পৌঁছানোর তথ্য দিয়েছে সিএমএইচ।

এদিকে দিনভর সচিবালয় ও মাইলস্টোন স্কুলের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সংঘাত ও দুই উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় রাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

দলগুলো আগের মতই মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ‘কঠোর’ হতে বলেছেন।

 

 

অশ্রুজলে শেষ বিদায়

জঙ্গি বিমান আছড়ে পড়ে শিশুদের হতাহতের ঘটনাটি হয়ে ওঠেছে দেশজুড়ে শোক আর বেদনার গল্পের সমষ্টি। এখানে নিহতের সারিতে যেমন আছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী, নয় বছরের শিশু সায়মা আক্তার; তেমনি আছেন তাদের প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী।

ভোলার দৌলতখান থেকে আসা শিক্ষার্থী তাহিয়া তাবাসসুম নাজিয়া ওপারে পাড়ি জমিয়েছে সোমবার গভীর রাতে; এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তার ছোট ভাই নাফি।

এখন পর্যন্ত নিহত ২৯ জনের মধ্যে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া ২২ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে পরিবারের সদস্যদের কাছে। পুড়ে অঙ্গার ছয়জনের পরিচয় নিশ্চিতে ডিএনএ টেস্ট করার কথা জানিয়েছে সরকার।

সিএমএইচে থাকা ছয়টি মৃতদেহ, যেগুলো শনাক্ত হয়নি, তাদের ডিএনএ নমুন সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।

এ ছাড়া পাঁচটি দেহাবশেষের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে এবং সিআইডি তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে বলে জানিয়েছেন তিন।

শাহাদাত বলেন, “যেহেতু এখনো ৬ জন মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, তাই যারা তাদের সন্তান বা স্বজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ—আমাদের প্রদত্ত তালিকায় যদি তাদের সন্তানের বা স্বজনের নাম না থাকে, তাহলে দয়া করে মালিবাগ সিআইডি ভবনে গিয়ে যোগাযোগ করুন এবং ডিএনএ নমুনার জন্য সহযোগিতা করুন।”

মঙ্গলবার নিহত কয়েকজনকে শেষ শয্যায় শায়িত করা হয়েছে। তাদের একজন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিপ্রবর্তা গ্রামের শাহ আলম আর রিনা বেগম দম্পতির মেয়ে সায়মা আক্তার।

বাড়ির উঠানেই সায়মাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে।

বাড়িভর্তি স্বজনদের মধ্যে বিলাপ করে রিনা বেগম বার বার শুধু এই একটা কথাই বলছিলেন। বার বার তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী যারা এই পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন, তারা কাঁদছিলেন অঝোরে।

রিনা বেগম বলছিলেন, “প্রতিদিন আমি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেতাম। সোমবার আমার এক ভাই তাকে স্কুলে নিয়ে যায়। পরে ফেইসবুকে জানতে পারি স্কুলে বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। আমার মা স্কুলে যাওয়ার আগে বলে গেলো, মা, স্কুলে গেলাম, টা টা।

“এরপর আর আমার মার সঙ্গে কথা হয়নি। মা আর কখনও বলবে না, মা স্কুলে যাই, টা টা।”

একই স্কুল থেকে বড় ভাই সাব্বিরও এসএসসি পাস করেছে। বোনের কবরের পাশে সাব্বির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল, “বোন তুমি আমাকে রেখে চলে গেলে। আমরা দু’জন একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। কত কথা বলতাম, আজ তুমি চুপ কেন বোন!”

সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীদের বাঁচিয়ে নিজের জীবন সপে দিয়ে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নেওয়া শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর শবযাত্রায় হাঁটল তার দুই শিশু সন্তান। নিজের পোড়া শরীর নিয়ে কীভাবে শিশুদের রক্ষাকবচ হয়েছিলেন, তা ফিরছে সবার মুখে।

গ্রামের বাড়ি নীলফামারির জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে তার লাশ নিয়ে যান স্বজনরা৷ সেখানে জানাজার পর তার দাফন হয়। এর আগে ভোরে ঢাকার উত্তরায় গাউছুল আজম জামে মসজিদে তার জানাজা হয়।

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় রজনী আক্তারের; প্রাণে বেঁচে ফেরা মেয়ে ঝুমঝুমকে যোগ দিতে হল তার মায়ের শেষযাত্রায়। তিন সন্তান রেখে যাওয়া এই নারীকে দাফন করা হয় কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পারিবারিক কবরস্থানে।

প্রশিক্ষণের শেষ ধাপে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরকে রাজশাহীতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে।

বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত তৃতীয় শ্রেণির মেহেনাজ আফরি হুমায়রার বাবা বলছেন, প্রতিদিন বাবার কপালে চুমু দিয়ে স্কুলের পথ ধরত সে। কফিনে চুমু খেয়ে ৯ বছরের মেয়েকে কবরে শায়িত করেন দেলোয়ার হোসাইন।

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া কেরানিপাড়া মেহেনাজের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

তার বাবা দেলোয়ার হোসাইন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজেরই বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তবে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তিনি ও তার স্ত্রী সুমি আক্তার প্রাণে বেঁচে গেছেন।

কুয়েত প্রবাসী বনি আমিন শেখের স্ত্রী তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকেন উত্তরাতে। প্রাণ হারিয়েছে তাদের বড় মেয়ে, তৃতীয় শ্রেণির ফাতেমা আক্তার। জ্বরের কারণে স্কুলে না যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছে তার ছোট ভাই ওমর।

ফাতেমার মামা স্বপন মীর বলেছেন, বিমান দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কুয়েত থেকে দেশে এসেছেন বনি আমিন শেখ। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় কুনিয়া গ্রামের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয় ফাতেমাকে।

 

 

সচিবালয় এলাকায় সংঘাত

মাইলস্টোন স্কুলে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের দাবি ওঠে। মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতায় পরীক্ষা স্থগিতের সেই ঘোষণা আসে সোমবার রাত ৩টার দিকে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে সেই খবর না পৌঁছানোয় কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসতে হয় তাদের।

শিক্ষা উপদেষ্টার বরাতে তথ্য উপদেষ্টা সোমবার গভীর রাতে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি ফেইসবুকে জানান। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে অনেক পরে, যা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এরপর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এবং শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার দুপুরে প্রথমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করতে যায়। সেখান থেকে বেলা দেড়টার দিকে তারা সচিবালয়ের সামনে জড়ো হন।

ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, নূর মোহাম্মদ কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, কমার্স কলেজ, আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, মিরপুর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ আরো কিছু শিক্ষার্থী এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

শুরুতে তারা সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটকের সামনে বিক্ষোভ দেখান। পরে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রের বাকি ফটোগুলোও বন্ধ করে দেন।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবি মুখে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় সরকার। তাদের অন্যান্য দাবি পর্যালোচনার জন্য কমিটি করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান।

কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়লে সংঘাতের সূত্রপাত হয়।

পুলিশ লাঠিপেটা করে, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের সচিবালয়ের ভেতর থেকে বের করতে পারলেও আশপাশের এলাকায় কয়েক ঘণ্টা ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলে। সচিবালয় এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

এই সংঘর্ষের মধ্যে আহত ৬৬ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন।

সিটি কলেজের শিক্ষার্থীর তানভীর বলেন, “গোপালগঞ্জের সামান্য কারণে এইচএসসি পরীক্ষার স্থগিত করেছে। অথচ কালকে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, বারবার বলার পরও তারা এইচএসসি পরীক্ষার স্থগিত করেনি। রাত ৩টা বাজে যখন স্থগিত করেছে ততক্ষণের সব শিক্ষার্থীরা জানতেও পারেনি।

“সকালবেলা অনেকের পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছে। এগুলো স্পষ্ট দায়িত্ব অবহেলা এবং একঘেয়েমি।”

পরে শিক্ষার্থীদের গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট এলাকায় সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সন্ধ্যার কিছু আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

সচিবালয় ও মাইলস্টোন স্কুলে বিক্ষোভ ও সংঘাতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের ‘যোগ’ দেখছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “ভয়াবহ শোকবহ পরিস্থিতিকে পুঁজি করে সকালে মাইলস্টোনের ওখানে একটু বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। আবার সচিবালয়ের এখানেও বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।

“বিশৃঙ্খলার পিছনে শোনা যায় আওয়ামী লীগেরও কিছু কিছু দুষ্ট চক্র এই পরিস্থিতিটাকে ঘোলাটে করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা নিশ্চিত না।”

কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসীরা স্যাবোট্যাজ’ করছে দাবি করে তাদের প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

আর উদ্ভুত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কেউ যাতে সুবিধা নিতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করেন নাহিদ। এর কারণ তুলে ধরে তিনি দাবি করেন, “আজকে সচিবালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কাউকে কাউকে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের সামাজিক মাধ্যম পেইজগুলো থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।”

 

 

শোকস্তব্ধ মাইলস্টোনে ৯ ঘন্টা আটকা দুই উপদেষ্টা

মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার।

নয় ঘণ্টার নানা ঘটনা প্রবাহের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশ প্রহরায় সেখান থেকে বের হতে পেরেছেন। পতাকাবিহীন সরকারি গাড়িতে চড়ে মেট্রোরেলের ডিপোর ভেতরের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে হন তারা।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমসহ আরও তিনজন এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। তারাও সারাদিন কলেজে আটকা ছিলেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “উপদেষ্টারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। পরে শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানান। সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। এজন্য উপদেষ্টারা বের হতে পারছিলেন না।

“সন্ধ্যার দিকে শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারা বেরিয়ে গেছেন।”

বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণসহ ছয় দাবিতে এদিন সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু করে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা।

বেলা পৌনে ১০টায় ঘটনাস্থলে এসে তোপের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এসময় তাকে দেখে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি দেখেও একই স্লোগান দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তারা ‘উই ওয়ান্ট, জাস্টিস’, ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।

পরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আইন উপদেষ্টা। শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।

ওই বৈঠকের পর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বেরিয়ে এসে আসিফ নজরুল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সব দাবি ‘মেনে নেওয়ার’ আশ্বাস দেন।

তিনি বলেন, “আপনারা যে দাবিগুলো করেছেন, ছয় দফা দাবি সেটার সাথে আমরা সম্পূর্ণ একমত। এবং আপনারা যে দাবি করেছেন তা অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি।

“আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি, আমরা আপনাদের প্রতিটি দাবি পূরণ করব। আমাদের ওপর আপনারা বিশ্বাস রাখেন।”

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে ‘যারা খারাপ ব্যবহার করেছেন’ তাদের বিরুদ্ধেও ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে’ আশ্বাস দেন আইন উপদেষ্টা।

আইন উপদেষ্টা কথা শেষ হওয়ার পরপরই তাদের দিকে তেড়ে যায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। দুই উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব তখন স্কুলের সম্মেলন কক্ষে চলে যান।

শিক্ষার্থীরা তখন বাইরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। দুপুর সোয়া ২টার দিকে উপদেষ্টারা বের হবেন শোনার পর শিক্ষার্থীদের একটি দল মূল ফটক আটকে দেয়। এ সময় পুলিশের একটি ডাবল কেবিন পিকআপও ভাংচুরও করা হয়।

বেলা ৩টার দিকে এক প্লাটুন এপিবিএন, কয়েক প্লাটুন ডিএমপির রিজার্ভ পুলিশ, এক প্লাটুন এটিইউ আসে মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে।

শিক্ষকরা এ সময় শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে দেন এবং বের হয়ে যেতে বলেন। বাড়তি পুলিশের উপস্থিতির মধ্যে বিক্ষোভ থামিয়ে শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছাড়লেও কিছুক্ষণ পর তারা স্কুলের বাইরে গোল চত্বরে অবস্থান নেয়।

এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা ৫ নম্বর ভবনের কাচ ভাংচুর শুরু করলে উপদেষ্টারা ভবনটির নিচ তলার সম্মেলনকক্ষ ছেড়ে উপরের কোনো একটা তলায় অবস্থান নেন। পরে তৃতীয় তলা থেকে তাদের নেমে আসতে দেখা যায়।

বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তারা পতাকাবিহীন সরকারি গাড়িতে চেপে সামনে পেছনে কয়েকশ পুলিশের পাহারা নিয়ে স্কুল ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্কুলের বাইরে গোল চত্বরে কয়েকশ শিক্ষার্থীর অবস্থানের কারণে ১৫ মিনিট পর তারা আবার ভেতরে ফিরে যান।

সন্ধ্যার পর পুলিশ গোলচত্বর থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিলে দুই উপদেষ্টার ফেরার সুযোগ তৈরি হয়।

 

 

শিক্ষার্থীদের ছয় দাবি হল-

>> নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ করা

>> আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ করা।

>> শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় জনসম্মুখে সেনা সদস্যদের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া।

>> নিহত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

>> বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো উড়োজাহাজ বাতিল করে আধুনিক উড়োযান চালু করা।

>> বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করে আরও ‘মানবিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা’ চালু করা।

 

পরীক্ষা পেছানোর ‘অদ্ভূত ঘোষণা’

মাইলস্টোনে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে এত বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীর হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা আসার পরই আলোচনায় আসে এদিনের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কি-না।

শিক্ষা মন্ত্রণালযের তরফে এদিন পরীক্ষা স্থগিত করার বিষয়ে কোনো বক্তব্য না আসার মধ্যে সোমবার রাতে আন্দোলনে নামে একদল শিক্ষার্থী। শোকের দিনে পরীক্ষা স্থগিতের পাশাপাশি শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।

ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবরোধের মধ্যে সোমবার দিবাগত রাত ২টা ৪১ মিনিটে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ফেইসবুক পেইজে এক অ্যাডমিন পোস্টে বলা হয়, “শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎ হয়েছে। আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা।”

তখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ড থেকে কোনো ধরনের ঘোষণা আসেনি। গভীর রাতে শিক্ষামন্ত্রী আবরার, তার দপ্তর এবং শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের টেলিফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।

সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর মাত্র দুই ঘন্টা আগে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মোর্চা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি খন্দোকার এহসানুল কবির স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা স্থগিতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে।

এর কিছু সময় প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষা স্থগিত করার কথাও জানানো হয়। পরে মঙ্গলবার রাতে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতির স্বাক্ষরে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২৪ তারিখের পরীক্ষাও স্থগিতের তথ্য জানানো হয়।

 

‘মারধর’ তদন্তে সেনাবাহিনী

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভিড় ‘নিয়ন্ত্রণের সময়’ কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে ‘শিক্ষার্থীদের মারধরের’ যে অভিযোগ উঠেছে তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর।

ঘটনাটিকে ‘অনভিপ্রেত’ হিসেবে বর্ণনা করে আইএসপিআর বলেছে, তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মঙ্গলবার আইএসপিআর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মাইলস্টোন স্কুল ভবনে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরের পরিস্থিতিরও ব্যাখ্যা দিয়েছে।

বলা হয়েছে, উদ্ধার কাজ নির্বিঘ্ন করতে সেখানে ভিড় করা ‘একদল উৎসুক জনতাকে’ সরাতে গেলে তাদের সঙ্গে সেনাসদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের ‘ভুল বোঝাবুঝি ও বাদানুবাদের’ সৃষ্টি হয়, যা এক পর্যায়ে একটি ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার অবতারণা করে।

এর আগে সেনাবাহিনীর হাতে শিক্ষার্থীদের মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।

 

 

‘গুজবে’ কান না দেওয়ার পরামর্শ বিমান বাহিনী প্রধানের

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘লাশ লুকানোর গুজব’ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।

মঙ্গলবার কুর্মিটোলায় বীর উত্তম এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে ওই বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ বিষয়ে কথা বলেন বিমান বাহিনী প্রধান।

তিনি বলেন, “ক্র্যাশ সাইটে এক ধরনের অশান্তি বিরাজ, এটা খুবই দুঃখজনক। অনেক গুজব চলছে, এই গুজবে কান দেবেন না। যখন আমাদের কাছে যে আপডেট আসছে, আহত-নিহতের, সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি।

“এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয়ই নাই। কার কাছ থেকে লুকাব? আপনারা আমাদের দেশের মানুষ, আমরাও এই দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে।”

হাসান মাহমুদ বলেন, বিমান বাহিনীর বহরে থাকা জঙ্গি বিমানগুলোর বয়স বেশি হলেও ‘লাইফটাইম’ পার হয়ে যায়নি। আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ‘ছাড় দেয় না’ বিমান বাহিনী।

 

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম