০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংস্কার বাস্তবায়নে চারটি পদ্ধতি সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন: সংবিধান সংশোধন কীভাবে, দলগুলোর ভিন্নমত

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০২:৩৪:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ২৪ বার পড়া হয়েছে

সংবিধান সংশোধন করে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে তাতে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো।

 

সংবিধান সংশোধন করে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে তাতে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে রেখে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের পথ দেখিয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি দল।

অপরদিকে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি।

বৃহস্পতিবার রাজধানী ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনা শেষে এমন ভিন্নমত তুলে ধরা হয়েছে সেসব দলের তরফে।

গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দুই ধাপে গঠন করা ১১টি সংস্কার সংস্কার সরকারপ্রধানের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে।

এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬২টি সুপারিশ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা সংলাপ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

প্রায় সাড়ে ছয় মাসের আলোচনায় যেসব বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে সেগুলো রেখে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হচ্ছে। সাতটি অঙ্গীকার সংবলিত এই সনদে স্বাক্ষর করবে রাজনৈতিক দলগুলো।

বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন স্বাক্ষরের জন্য জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানোর কথা বলেছে। শনিবারের মধ্যে স্বাক্ষরকারী দুইজন প্রতিনিধির নাম দিতে দলগুলোকে অনুরোধ করেছে কমিশন।

কিছুক্ষেত্রে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্টসহ) মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে এই চূড়ান্ত খসড়ায়।

এদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়েনে কমিশনের তরফে চারটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন করতে হবে না, এমন সংস্কার বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশে হবে।

বাকি দুটি প্রস্তাব হল- গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশে সেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে, যেগুলো সংবিধানকে স্পর্শ করেন না।

“এ বিষয়ে লিখিত মতামত, মৌখিক মতামত সবসময় দেওয়া ছিল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও একই রকম মতামত দেওয়া হয়েছে।

“প্রশ্ন আসছে, সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত ১৯টি মৌলিক বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়, সেই বিষয়ে মতামতের জন্য কমিশন বৈঠক ডেকেছিল। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতামত দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “আশু বাস্তবায়নযোগ্য যেকোনো সুপারিশ, যেগুলো জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে অথবা অফিস আদেশসহ অন্যান্য বৈধ যে কোন প্রক্রিয়ায়।

“যে প্রস্তাবগুলো আশু বাস্তবায়ন যোগ্য নয়, অথচ বাস্তবায়ন করার সুযোগ আছে, সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য এই সরকার উদ্যোগ নিতে পারে, এমনকি সমাপ্তও করতে পারে, যদি সম্পন্ন না হয় পরবর্তী সরকার সেটা চালিয়ে যাবে, বাস্তাবয়ন করবে।”

 

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

 

সালাহউদ্দিন বলেন, “জুলাই সনদের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। যে, যারাই ম্যান্ডেট পাবে, পার্লামেন্টে যাবে, তারা এগুলো বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।”

বিএনপির এই নেতা বলেন, “যে বিষয়গুলো সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সেই বিষয়গুলো এখন প্রতিশ্রুতি আকারে অঙ্গীকার আকারে স্বাক্ষর করে, সেই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তীতে গঠিত জাতীয় সংসদের দুই বছরের মধ্যে সংশোধনীগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এইভাবে আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

“এখানে প্রশ্ন আসছে, অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশে জারির মধ্য দিয়ে এই সাংবিধানিক সংশোধনীগুলোকে এখনই কার্যকর করা যায় কিনা? কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং লিখিত পরামর্শও একটি রাজনৈতিক দল দিয়েছে। যেকোনো রকমের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সাংবিধানিক সংশোধনের বিষয়ে, যাতে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিই, সেই জন্য আমরা এই আলোচনাটা করেছি এবং আমরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছি।”

সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংস্কার বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজও দেখিয়েছেন জাতীয় সংসদকে।

তিনি বলেন, “সংবিধান সংশ্লিষ্ট যে বিষয়, সেই বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। গণভোটের কথা আছে, গণপরিষদের কথা আছে, পরবর্তী যে জাতীয় সংসদ সেই সংসদে সেই সংবিধানে বর্ণিত সংশোধনীর যে নিয়ম, সেই নিয়মে হবে। একটা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, এটার কথা বলা হয়েছে।

“সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরবর্তী যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আইনসভা, সেই আইনসভায় সংবিধান বর্ণিত সংবিধান সংশোধনের যে বিধি, সেই অনুযায়ী সেগুলো সংশোধিত হতে হবে। এটা বাসদের পক্ষ থেকে বলেছি।”

বাসদ-মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, “বর্তমান সংবিধানের অধীনে কিন্তু একটা পথ বের করা সম্ভব। এটা না করে অন্য কিছু করতে গেলে বা অন্য কোনো পথ আবিষ্কার করার চেষ্টা করা হলে, সেটা আমার মনে হয়, যতটুকু আমরা একমত হতে পেরেছি, যতটুকু আমাদের অগ্রগতি হয়েছে সেটাকেও একটা নষ্ট করা হবে।”

জামায়াত বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি অথবা গণভোটের মাধ্যমে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া জামায়াতের প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে সংবিধানের উপরে প্রাধান্য দেওয়া। বাকি ক্ষেত্রে সংবিধান যেমন আছে, তেমনি থাকবে।

“গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার ব্যবস্থায় সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণ করার সুযোগ না থাকায় সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি অনুচ্ছেদ ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। এজন্য আমরা বলেছি, একটি নতুন সাংবিধানিক আদেশ জারি করার জন্য। একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে আগামীতে সংবিধানের উপরে বিশেষ সাংবিধানিক আইনকে প্রাধান্য দিয়ে ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর দেখাতে।”

দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “গণভোটের প্রস্তাবকে বিকল্প হিসেবে রেখেছি। বিশেষ সাংবিধানিক আইন জারির প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে গণভোটের মাধ্যমে হবে।”

আর জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান প্রণয়নে কোনো জটিলতা দেখছে না।

দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “আমাদের গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধানের দাবি কোনো জটিল বিষয় নয় বরং এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সামনে একটি গণপরিষদ নির্বাচন হবে, তাহলে ফেব্রুয়ারি নয়, ডিসেম্বরেই গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব।

“এ কারণে আমরা এটাকে কোন জটিল সিদ্ধান্ত বলে মনে করি না। এটাকে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত বলে মনে করি না। এটা অবাস্তব কোন কিছু নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের উপরেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যেকোনো সময় সম্ভব বলেই আমরা মনে করি।”

 

সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।

 

আখতার হোসেন বলেন, “সেটা জুলাই সনদকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নানাবিদভাবে বিঘ্ন করার মত পরিস্থিতি তৈরি করে কিনা? সে সন্দেহ এবং সংশয় আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।”

এ ক্ষেত্রে তিনি ঐকমত্য কমিশনের ঐক্যমত কমিশনের ‘ঢিলেঢালাভাব’ দেখার কথাও বলেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

দলগুলোর মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ২৯ দলের প্রতিনিধিরা।

জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া দলগুলোকে দেওয়া হলেও বাস্তবায়নের উপায় কী হবে তা নিয়ে এখনো দূরত্ব রয়ে গেছে।

সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে এক জায়গায় আনতে দলগুলোর সঙ্গে আবার রোববার বসবে ঐকমত্য কমিশন।

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

সংস্কার বাস্তবায়নে চারটি পদ্ধতি সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন: সংবিধান সংশোধন কীভাবে, দলগুলোর ভিন্নমত

আপডেট সময় ০২:৩৪:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

 

সংবিধান সংশোধন করে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে তাতে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে রেখে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের পথ দেখিয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি দল।

অপরদিকে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি।

বৃহস্পতিবার রাজধানী ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনা শেষে এমন ভিন্নমত তুলে ধরা হয়েছে সেসব দলের তরফে।

গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দুই ধাপে গঠন করা ১১টি সংস্কার সংস্কার সরকারপ্রধানের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে।

এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬২টি সুপারিশ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা সংলাপ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

প্রায় সাড়ে ছয় মাসের আলোচনায় যেসব বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে সেগুলো রেখে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হচ্ছে। সাতটি অঙ্গীকার সংবলিত এই সনদে স্বাক্ষর করবে রাজনৈতিক দলগুলো।

বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন স্বাক্ষরের জন্য জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানোর কথা বলেছে। শনিবারের মধ্যে স্বাক্ষরকারী দুইজন প্রতিনিধির নাম দিতে দলগুলোকে অনুরোধ করেছে কমিশন।

কিছুক্ষেত্রে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্টসহ) মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে এই চূড়ান্ত খসড়ায়।

এদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়েনে কমিশনের তরফে চারটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন করতে হবে না, এমন সংস্কার বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশে হবে।

বাকি দুটি প্রস্তাব হল- গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশে সেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে, যেগুলো সংবিধানকে স্পর্শ করেন না।

“এ বিষয়ে লিখিত মতামত, মৌখিক মতামত সবসময় দেওয়া ছিল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও একই রকম মতামত দেওয়া হয়েছে।

“প্রশ্ন আসছে, সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত ১৯টি মৌলিক বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়, সেই বিষয়ে মতামতের জন্য কমিশন বৈঠক ডেকেছিল। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতামত দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “আশু বাস্তবায়নযোগ্য যেকোনো সুপারিশ, যেগুলো জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে অথবা অফিস আদেশসহ অন্যান্য বৈধ যে কোন প্রক্রিয়ায়।

“যে প্রস্তাবগুলো আশু বাস্তবায়ন যোগ্য নয়, অথচ বাস্তবায়ন করার সুযোগ আছে, সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য এই সরকার উদ্যোগ নিতে পারে, এমনকি সমাপ্তও করতে পারে, যদি সম্পন্ন না হয় পরবর্তী সরকার সেটা চালিয়ে যাবে, বাস্তাবয়ন করবে।”

 

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

 

সালাহউদ্দিন বলেন, “জুলাই সনদের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। যে, যারাই ম্যান্ডেট পাবে, পার্লামেন্টে যাবে, তারা এগুলো বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।”

বিএনপির এই নেতা বলেন, “যে বিষয়গুলো সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সেই বিষয়গুলো এখন প্রতিশ্রুতি আকারে অঙ্গীকার আকারে স্বাক্ষর করে, সেই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তীতে গঠিত জাতীয় সংসদের দুই বছরের মধ্যে সংশোধনীগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এইভাবে আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

“এখানে প্রশ্ন আসছে, অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশে জারির মধ্য দিয়ে এই সাংবিধানিক সংশোধনীগুলোকে এখনই কার্যকর করা যায় কিনা? কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং লিখিত পরামর্শও একটি রাজনৈতিক দল দিয়েছে। যেকোনো রকমের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সাংবিধানিক সংশোধনের বিষয়ে, যাতে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিই, সেই জন্য আমরা এই আলোচনাটা করেছি এবং আমরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছি।”

সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংস্কার বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজও দেখিয়েছেন জাতীয় সংসদকে।

তিনি বলেন, “সংবিধান সংশ্লিষ্ট যে বিষয়, সেই বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। গণভোটের কথা আছে, গণপরিষদের কথা আছে, পরবর্তী যে জাতীয় সংসদ সেই সংসদে সেই সংবিধানে বর্ণিত সংশোধনীর যে নিয়ম, সেই নিয়মে হবে। একটা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, এটার কথা বলা হয়েছে।

“সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরবর্তী যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আইনসভা, সেই আইনসভায় সংবিধান বর্ণিত সংবিধান সংশোধনের যে বিধি, সেই অনুযায়ী সেগুলো সংশোধিত হতে হবে। এটা বাসদের পক্ষ থেকে বলেছি।”

বাসদ-মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, “বর্তমান সংবিধানের অধীনে কিন্তু একটা পথ বের করা সম্ভব। এটা না করে অন্য কিছু করতে গেলে বা অন্য কোনো পথ আবিষ্কার করার চেষ্টা করা হলে, সেটা আমার মনে হয়, যতটুকু আমরা একমত হতে পেরেছি, যতটুকু আমাদের অগ্রগতি হয়েছে সেটাকেও একটা নষ্ট করা হবে।”

জামায়াত বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি অথবা গণভোটের মাধ্যমে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া জামায়াতের প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে সংবিধানের উপরে প্রাধান্য দেওয়া। বাকি ক্ষেত্রে সংবিধান যেমন আছে, তেমনি থাকবে।

“গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার ব্যবস্থায় সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণ করার সুযোগ না থাকায় সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি অনুচ্ছেদ ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। এজন্য আমরা বলেছি, একটি নতুন সাংবিধানিক আদেশ জারি করার জন্য। একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে আগামীতে সংবিধানের উপরে বিশেষ সাংবিধানিক আইনকে প্রাধান্য দিয়ে ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর দেখাতে।”

দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “গণভোটের প্রস্তাবকে বিকল্প হিসেবে রেখেছি। বিশেষ সাংবিধানিক আইন জারির প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে গণভোটের মাধ্যমে হবে।”

আর জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান প্রণয়নে কোনো জটিলতা দেখছে না।

দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “আমাদের গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধানের দাবি কোনো জটিল বিষয় নয় বরং এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সামনে একটি গণপরিষদ নির্বাচন হবে, তাহলে ফেব্রুয়ারি নয়, ডিসেম্বরেই গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব।

“এ কারণে আমরা এটাকে কোন জটিল সিদ্ধান্ত বলে মনে করি না। এটাকে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত বলে মনে করি না। এটা অবাস্তব কোন কিছু নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের উপরেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যেকোনো সময় সম্ভব বলেই আমরা মনে করি।”

 

সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।

 

আখতার হোসেন বলেন, “সেটা জুলাই সনদকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নানাবিদভাবে বিঘ্ন করার মত পরিস্থিতি তৈরি করে কিনা? সে সন্দেহ এবং সংশয় আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।”

এ ক্ষেত্রে তিনি ঐকমত্য কমিশনের ঐক্যমত কমিশনের ‘ঢিলেঢালাভাব’ দেখার কথাও বলেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

দলগুলোর মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ২৯ দলের প্রতিনিধিরা।

জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া দলগুলোকে দেওয়া হলেও বাস্তবায়নের উপায় কী হবে তা নিয়ে এখনো দূরত্ব রয়ে গেছে।

সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে এক জায়গায় আনতে দলগুলোর সঙ্গে আবার রোববার বসবে ঐকমত্য কমিশন।

 

 

সাবরিনা জাহান- বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম