১২:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
নীরবতা ভেঙে আদরের শিশুটি ডাকবে, আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে, এই অপেক্ষা সবার।

যেতে না চাওয়া ছেলেকে স্কুলে পাঠানো মায়ের কান্না থামছেই না

নিঝুম আহমেদ - জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০৮:৪৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাকিন এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি।

 

সপ্তম শ্রেণির মাকিন সোমবার স্কুলে যেতে না চাইলেও জোর করে তাকে পাঠিয়েছিলে মা সালেহা নাজনীন; বার্ন ইনস্টিটিউটের বারান্দায় বসে সেই কথা মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি।

৬৮ শতাংশ পোড়া ক্ষত নিয়ে আইসিইউতে মাকিন। তার মায়ের আহাজারি কোনোভাবেই থামছে না। বারবার বলে উঠছেন, ছেলেটাকে স্কুলে না পাঠালে এই দশা তার হত না।

ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন মাকিন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের আইসিইউর সামনে তার মায়ের সঙ্গে অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনরা।

মঙ্গলবার মা সালেহা নাজনীন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “তার (মাকিনের) চুলটা একটু বড় হইছিল। গেলে বকা দিতে পারে বলে স্কুলে যেতে চাইতেছিল না। ছেলেটারে একরকম জোর করে স্কুলে পাঠাইলাম, আর আজকে এই অবস্থা হইল।”

দুর্ঘটনার পরই মাকিনকে উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে নেওয়া হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।

তার সঙ্গে একই শ্রেণির শিক্ষার্থী বন্ধু আরিয়ান ও আয়ানকেও একই অ্যাম্বুলেন্সে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় বলে জানান মাকিনের মামাতো ভাই দুর্জয়।

তিনি বলেন, “আরিয়ান ৮৫ শতাংশ দগ্ধ আর আয়ান ৪৮ শতাংশ দগ্ধ। তাদের তিনজনকেই (উত্তরার) আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। আয়ানকে যখন এখানে (বার্ন ইনস্টিটিউটে) আনার প্রস্তুতি চলছিল, তার (মাকিনের) জ্ঞান থাকায় তখন সে দেখতে পায় তার দুই বন্ধুকে। পরে সেই বলেছে, তার সঙ্গে তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে।”

 

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের আইসিইউয়ের সামনে আহতদের স্বজনরা।

 

মাকিনের বিষয়ে চিকিৎসকরা ‘কিছুই বলতে পারছেন না’ জানিয়ে দুর্জয় বলেন, “কাল (সোমবার) রাতে মাকিনের মুখটা একটু কালচে ধরনের ছিল। আজকে ফুলে অনেক মোটা হয়ে গেছে। এই অবস্থা দেখে কারও সহ্য করার মত না।”

মাকিনের মা-বাবাকে হাসপাতালের সামনেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এর মধ্যেই সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে তারা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে স্বজনরাও কাঁদছিলেন।

শুধু এ পরিবারই নয়, বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৪৪ জনের প্রত্যেকের পরিবারের অবস্থা প্রায় একই। ভেতরে আদরের সন্তান চিকিৎসাধীন আর বাইরে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হাসপাতালের পরিবেশ।

তুলনামূলক কম দগ্ধ শিশুরাও সারাক্ষণ চিৎকার করে কাঁদছে, আর বেশি দগ্ধরা জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। এই নীরবতা ভেঙে আদরের শিশুটি ডাকবে, আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এই অপেক্ষা সবার।

 

‘গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেই’

বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার।

বাইরে অপেক্ষায় থাকা বাবা আবদুর রহিম বলছিলেন, “ঘটনার সময় সামিয়াকে নিতে আমি স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।

“যেখানে আগুন ওখানেই তো আমার মেয়ে, এটি দেখে আমি ভেতরে যাই। নিচতলা থেকে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেই। তখনও বুঝিনি ওর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এখন কী হবে জানি না।”

আইসিইউয়ের ১৫ নম্বর বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে মাইলস্টোনের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারাবি আয়ান। তার বাবা জুনায়েদ আহমেদ ও মা তামান্না আক্তার দুজনই অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। ছেলের এই অবস্থা দেখে তারা বাইরে বসে কেবল চোখের পানি ফেলছিলেন।

আয়ানের মামা জায়িদী রায়হান বলেন, “ফারাবিদের বাসা মিরপুর ১০ নম্বরে। প্রতিদিন মেট্রোরেলে স্কুলে আসা-যাওয়া করে ফারাবি। জুনাইনা নামে ফারাবির ছোট একটি বোন আছে। এই করুণ পরিণতিতে তার মা-বাবা টানা কান্না করেই যাচ্ছেন।”

তৃতীয় শ্রেণির সায়মাকে পঞ্চম তলা থেকে সপ্তম তলায় নেওয়া হচ্ছিল। সায়মার শরীরের ১৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। দুই হাত, দুই পা ও মুখমণ্ডল পুড়ে গেছে।

হাত-পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো সায়মা তার মাকে বার বার বলছিল, “মা আমার ভয় করছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। মা মা আমি আর পারতেছি না। আমার হাত উঠাতে পারছি না। আমি উঠে বসব। আমার ক্ষুধা লাগছে।”

ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে থাকা মা তার সন্তানকে বারবার বলছিলেন, “বাবা এই তো সুস্থ হয়ে যাবে। উপরে নিয়ে খাবার দিব। লিফট আসলেই আমরা ৭ তলায় যাব। সেখানে গেলে ভালো লাগবে। কান্না করে না বাবা।”

লিফটে করে সায়মাকে নিয়ে উপরে চলে গেলেন স্বজনরা।

 

‘মেয়ের এই অবস্থা কীভাবে সহ্য করব?’

হাত-পা ও মুখসহ শরীরের সামনের অংশ পুড়ে গেছে মাইলস্টোনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া হকের। শরীরের ৩৫ শতাংশ দগ্ধ এবং শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাকে রাখা হয়েছে এইচডিইউতে।

৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকা তাসনিয়া কোনো কথা বলতে পারছে না। কাছে গেলে ব্যান্ডেজে মোড়া হাত নেড়ে ইশারায় কী যেন বুঝাতে চায়।

তেরো বছরের এই শিক্ষার্থীর বাবা হাফিজ উদ্দিন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলছিলেন, “চঞ্চল মেয়েটা আমার কাছে গেলে অপলক তাকিয়ে থাকে। বাবা হিসেবে মেয়ের এই অবস্থা আমি কীভাবে সহ্য করব?”

হাসপাতালের সপ্তম তলায় এইচডিইউর সামনে একটি তালিকা ঝুলিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে দেখে গেছে, মাসুমের ৬০ শতাংশ, তাসনিয়ার ৩৫ শতাংশ, সাইবা জাহানের ৮ শতাংশ, নওরিনের ৪ শতাংশ, নাজিয়ার ৯০ শতাংশ, সাইরার ২০ শতাংশ, সায়মার ২৫ শতাংশ ও আয়মানের ২০ শতাংশ দগ্ধ রয়েছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ছোট ছোট শিশুদের পুড়ে অঙ্গার হওয়ার হৃদয়বিদারক দৃশ্য যেন সইতে পারছেন না কেউই।

দুর্ঘটনার পর আগুনে দগ্ধ শিশুদের ছটফটানি, হাসপাতালে চিৎকারে ভারি হয়ে উঠছে চারপাশ। সেইসঙ্গে পুরো পরিবার মাতিয়ে রাখা শিশু সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো। কোনোভাবেই থামছে না তাদের আহাজারি।

বাবা-মায়েরা সন্তানদের স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করছেন; কেউ শোকে মূর্ছা যাচ্ছেন।

সোমবার উত্তরার দিয়াবাড়ির ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে আছড়ে পড়ে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান। বিধ্বস্তের পরই আগুন ধরে যাওয়ায় দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ২৮ জনের প্রাণ গেছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু। আহত ৬৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বিমান দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য ফোকাল পারসন হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সরকার ফারহানা কবীর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হতাহতের এ তথ্য দিয়েছেন।

চিকিৎসাধীনদের মধ্যে মধ্যে ১০ জনকে ‘শঙ্কামুক্ত’ বলে মনে করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান মঙ্গলবার বলেন, ৩০ জনের অবস্থা এখনও ‘অস্পষ্ট’, তাদের ১০ জনের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’। আর বাকিদের অবস্থা ‘মাঝারি’ ধরনের।

 

 

নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

নীরবতা ভেঙে আদরের শিশুটি ডাকবে, আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে, এই অপেক্ষা সবার।

যেতে না চাওয়া ছেলেকে স্কুলে পাঠানো মায়ের কান্না থামছেই না

আপডেট সময় ০৮:৪৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

 

সপ্তম শ্রেণির মাকিন সোমবার স্কুলে যেতে না চাইলেও জোর করে তাকে পাঠিয়েছিলে মা সালেহা নাজনীন; বার্ন ইনস্টিটিউটের বারান্দায় বসে সেই কথা মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি।

৬৮ শতাংশ পোড়া ক্ষত নিয়ে আইসিইউতে মাকিন। তার মায়ের আহাজারি কোনোভাবেই থামছে না। বারবার বলে উঠছেন, ছেলেটাকে স্কুলে না পাঠালে এই দশা তার হত না।

ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন মাকিন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের আইসিইউর সামনে তার মায়ের সঙ্গে অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনরা।

মঙ্গলবার মা সালেহা নাজনীন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “তার (মাকিনের) চুলটা একটু বড় হইছিল। গেলে বকা দিতে পারে বলে স্কুলে যেতে চাইতেছিল না। ছেলেটারে একরকম জোর করে স্কুলে পাঠাইলাম, আর আজকে এই অবস্থা হইল।”

দুর্ঘটনার পরই মাকিনকে উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে নেওয়া হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।

তার সঙ্গে একই শ্রেণির শিক্ষার্থী বন্ধু আরিয়ান ও আয়ানকেও একই অ্যাম্বুলেন্সে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় বলে জানান মাকিনের মামাতো ভাই দুর্জয়।

তিনি বলেন, “আরিয়ান ৮৫ শতাংশ দগ্ধ আর আয়ান ৪৮ শতাংশ দগ্ধ। তাদের তিনজনকেই (উত্তরার) আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। আয়ানকে যখন এখানে (বার্ন ইনস্টিটিউটে) আনার প্রস্তুতি চলছিল, তার (মাকিনের) জ্ঞান থাকায় তখন সে দেখতে পায় তার দুই বন্ধুকে। পরে সেই বলেছে, তার সঙ্গে তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে।”

 

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের আইসিইউয়ের সামনে আহতদের স্বজনরা।

 

মাকিনের বিষয়ে চিকিৎসকরা ‘কিছুই বলতে পারছেন না’ জানিয়ে দুর্জয় বলেন, “কাল (সোমবার) রাতে মাকিনের মুখটা একটু কালচে ধরনের ছিল। আজকে ফুলে অনেক মোটা হয়ে গেছে। এই অবস্থা দেখে কারও সহ্য করার মত না।”

মাকিনের মা-বাবাকে হাসপাতালের সামনেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এর মধ্যেই সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে তারা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে স্বজনরাও কাঁদছিলেন।

শুধু এ পরিবারই নয়, বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৪৪ জনের প্রত্যেকের পরিবারের অবস্থা প্রায় একই। ভেতরে আদরের সন্তান চিকিৎসাধীন আর বাইরে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হাসপাতালের পরিবেশ।

তুলনামূলক কম দগ্ধ শিশুরাও সারাক্ষণ চিৎকার করে কাঁদছে, আর বেশি দগ্ধরা জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। এই নীরবতা ভেঙে আদরের শিশুটি ডাকবে, আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এই অপেক্ষা সবার।

 

‘গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেই’

বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার।

বাইরে অপেক্ষায় থাকা বাবা আবদুর রহিম বলছিলেন, “ঘটনার সময় সামিয়াকে নিতে আমি স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।

“যেখানে আগুন ওখানেই তো আমার মেয়ে, এটি দেখে আমি ভেতরে যাই। নিচতলা থেকে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেই। তখনও বুঝিনি ওর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এখন কী হবে জানি না।”

আইসিইউয়ের ১৫ নম্বর বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে মাইলস্টোনের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারাবি আয়ান। তার বাবা জুনায়েদ আহমেদ ও মা তামান্না আক্তার দুজনই অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। ছেলের এই অবস্থা দেখে তারা বাইরে বসে কেবল চোখের পানি ফেলছিলেন।

আয়ানের মামা জায়িদী রায়হান বলেন, “ফারাবিদের বাসা মিরপুর ১০ নম্বরে। প্রতিদিন মেট্রোরেলে স্কুলে আসা-যাওয়া করে ফারাবি। জুনাইনা নামে ফারাবির ছোট একটি বোন আছে। এই করুণ পরিণতিতে তার মা-বাবা টানা কান্না করেই যাচ্ছেন।”

তৃতীয় শ্রেণির সায়মাকে পঞ্চম তলা থেকে সপ্তম তলায় নেওয়া হচ্ছিল। সায়মার শরীরের ১৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। দুই হাত, দুই পা ও মুখমণ্ডল পুড়ে গেছে।

হাত-পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো সায়মা তার মাকে বার বার বলছিল, “মা আমার ভয় করছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। মা মা আমি আর পারতেছি না। আমার হাত উঠাতে পারছি না। আমি উঠে বসব। আমার ক্ষুধা লাগছে।”

ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে থাকা মা তার সন্তানকে বারবার বলছিলেন, “বাবা এই তো সুস্থ হয়ে যাবে। উপরে নিয়ে খাবার দিব। লিফট আসলেই আমরা ৭ তলায় যাব। সেখানে গেলে ভালো লাগবে। কান্না করে না বাবা।”

লিফটে করে সায়মাকে নিয়ে উপরে চলে গেলেন স্বজনরা।

 

‘মেয়ের এই অবস্থা কীভাবে সহ্য করব?’

হাত-পা ও মুখসহ শরীরের সামনের অংশ পুড়ে গেছে মাইলস্টোনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া হকের। শরীরের ৩৫ শতাংশ দগ্ধ এবং শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাকে রাখা হয়েছে এইচডিইউতে।

৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকা তাসনিয়া কোনো কথা বলতে পারছে না। কাছে গেলে ব্যান্ডেজে মোড়া হাত নেড়ে ইশারায় কী যেন বুঝাতে চায়।

তেরো বছরের এই শিক্ষার্থীর বাবা হাফিজ উদ্দিন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলছিলেন, “চঞ্চল মেয়েটা আমার কাছে গেলে অপলক তাকিয়ে থাকে। বাবা হিসেবে মেয়ের এই অবস্থা আমি কীভাবে সহ্য করব?”

হাসপাতালের সপ্তম তলায় এইচডিইউর সামনে একটি তালিকা ঝুলিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে দেখে গেছে, মাসুমের ৬০ শতাংশ, তাসনিয়ার ৩৫ শতাংশ, সাইবা জাহানের ৮ শতাংশ, নওরিনের ৪ শতাংশ, নাজিয়ার ৯০ শতাংশ, সাইরার ২০ শতাংশ, সায়মার ২৫ শতাংশ ও আয়মানের ২০ শতাংশ দগ্ধ রয়েছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ছোট ছোট শিশুদের পুড়ে অঙ্গার হওয়ার হৃদয়বিদারক দৃশ্য যেন সইতে পারছেন না কেউই।

দুর্ঘটনার পর আগুনে দগ্ধ শিশুদের ছটফটানি, হাসপাতালে চিৎকারে ভারি হয়ে উঠছে চারপাশ। সেইসঙ্গে পুরো পরিবার মাতিয়ে রাখা শিশু সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো। কোনোভাবেই থামছে না তাদের আহাজারি।

বাবা-মায়েরা সন্তানদের স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করছেন; কেউ শোকে মূর্ছা যাচ্ছেন।

সোমবার উত্তরার দিয়াবাড়ির ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে আছড়ে পড়ে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান। বিধ্বস্তের পরই আগুন ধরে যাওয়ায় দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ২৮ জনের প্রাণ গেছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু। আহত ৬৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বিমান দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য ফোকাল পারসন হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সরকার ফারহানা কবীর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হতাহতের এ তথ্য দিয়েছেন।

চিকিৎসাধীনদের মধ্যে মধ্যে ১০ জনকে ‘শঙ্কামুক্ত’ বলে মনে করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান মঙ্গলবার বলেন, ৩০ জনের অবস্থা এখনও ‘অস্পষ্ট’, তাদের ১০ জনের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’। আর বাকিদের অবস্থা ‘মাঝারি’ ধরনের।

 

 

নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম