যারা ভোট দেয়নি তাদের জন্যও কাজ করতে হবে
শপথ নিলেন ৫ সিটির মেয়র, যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

- আপডেট সময় ০৯:৫১:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ জুলাই ২০২৩
- / ১৩২ বার পড়া হয়েছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রতিনিধিদের জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দলমত নির্বিশেষে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বারবার ক্ষমতায় এসেছি বলেই একটা গণতান্ত্রিক ধারা ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত আছে। এজন্যই আজ বাংলাদেশের এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে কেউ অবহেলা করতে পারে না। বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে এখন সম্মানের চোখে দেখে। আমরা এই উন্নতিটা করতে পেরেছি বলেই সম্ভব হয়েছে। আর আমাদের পেছনের দিকে তাকাতে হবে না। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।
সোমবার পৃথকভাবে দুটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে প্রথমে গাজীপুর, খুলনা ও বরিশাল এবং পরে সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনে নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করতে দলমত নির্বিশেষে সকল জনপ্রতিনিধিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
সরকারপ্রধান বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য আমি দল-মত বির্বিশেষে সকল জনপ্রতিধিকে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও কৃষিসহ সবকিছুই স্মার্ট হবে। তাই দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নে কাজ করতে হবে। নগরের উন্নয়নে কাজ করার ক্ষেত্রে কারা ভোট দিয়েছে আর কারা দেয়নি সেই বিষয়টি না দেখার পরামর্শ দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, কাউন্সিলর নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় না। তবে নির্বাচিত বেশিরভাগ প্রতিনিধিই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য। তাই যারা ভোট দেয়নি, কাজ তাদের জন্যও করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে নবনির্বাচিত খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, বরিশালের আবুল খায়ের আবদুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত) এবং গাজীপুরের মেয়র জায়েদা খাতুনকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাউন্সিলরদের শপথবাক্য পাঠ করান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এম তাজুল ইসলাম। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহাম্মদ ইবরাহিম।
পরে দ্বিতীয় দফায় একই স্থানে শপথ নেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এবং এই দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলরগণ। শপথ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনির্বাচিত খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর, রাজশাহী এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং কাউন্সিলরদের সঙ্গে ফটোসেশন করেন। নতুন পাঁচ মেয়রের মধ্যে চারজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে জিতেছেন। কেবল গাজীপুরে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন।
দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমরা কিন্তু এলাকা দেখে কাজ করি না। কে ভোট দিল কে দিল না সেটা না। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য আমাদের কাজ। আমাদেরকে (জনপ্রতিনিধিদের) সেভাবেই কাজ করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক করেছি, ৩০ প্রকার ওষুধ দিচ্ছি, ইনসুলিনও দেওয়া শুরু করেছি। এটা কিন্তু সকলের জন্য, শুধু আওয়ামী লীগের লোক পাবে, অন্য দলের লোক পাবে না তা কিন্তু না, এটা সকলের জন্য। আমরা যা করি জনগণের জন্য করি, জনগণের কল্যাণে করি- সেটা আপনারা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছেন। আমাদের সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের কল্যাণ করা।’
জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হবে জানিয়ে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যে জনগণ আপনাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, তাদের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আপনারা জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। আমি চাই জনগণের সেবক হিসেবে আপনারা সবসময় স্ব-স্ব এলাকায় কাজ করবেন।
এলাকার উন্নয়ন করার আগে পরিকল্পনা করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, কাজগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, মানুষের আস্থা-বিশ্বাসটা যেন অর্জন করতে পারেন; সেভাবেই আপনাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। নিজের রাজনৈতিক দর্শন তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারাটা যেন অব্যাহত থাকে, তারা যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে, দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পারে, সবাই যেন উন্নত জীবন পায় সেটাই আমাদের কাম্য। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের কাছে আমার আবেদন থাকবে, সবাই মিলে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩-১৪ সালের অগ্নিসন্ত্রাস; সাড়ে তিন হাজার গাড়ি, বাস, লঞ্চ স্টিমার পোড়ানো; ৫০০ জনের মতো মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা- এই ধরনের ভয়াবহ অবস্থা আমরা দেখেছি। তাদের দুঃশাসনের কারণেই দেশে ইমার্জেন্সি আসে। কাজেই সেই ধরনের অবস্থা আর সৃষ্টি করুক, আমরা চাই না। বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারা যেন অব্যাহত থাকে; বাংলাদেশের মানুষ যেন শান্তিতে বাস করতে পারে; সবাই যেন উন্নত জীবন পায় সেটাই আমরা চাই।
মেয়র ও কাউন্সিলরদের উদ্দেশ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। আশা করি জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগের বাংলাদেশ কেমন ছিল, একটু চিন্তা করেন। ২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতায় আসি। এরপর গত সাড়ে ১৪ বছরে দেশের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সবকিছুর উন্নতির মধ্য দিয়ে এই সময়ে বাংলাদেশ বদলে গেছে কি না, সেটা আপনাদের থেকে জানতে চাই। আন্তরিকভাবে এই প্রচেষ্টা আমরা চালিয়েছি কেবল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের জন্য। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে।
জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশে ফেরার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমি এমন একটি দেশে এসেছিলাম, যেখানে আমার পিতা-মাতা ও ভাইদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। যেখানে খুনিরা ছিল ক্ষমতায়। আর ছিল স্বাধীনতাবিরোধী, জিয়াউর রহমান যাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। আমাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। পিতা-মাতার বিচারের জন্য আমাকে ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর এটা পেরেছি ক্ষমতায় আসতে পেরেছি বলেই।
বৈশ্বিক মহামারির প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও কোভিড-১৯ এর অতিমারির কারণে অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বব্যাপী। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়। বরং বাংলাদেশে তো আমরা এখনো বলিনি যে দুটি-তিনটির বেশি টমেটো কিনতে পারবেন না, ছয়টির বেশি ডিম কিনতে পারবেন না। পানি ব্যবহার করতে পারবেন না। বিদ্যুৎ এতটুকুর বেশি ব্যবহার করতে পারবেন না। কিন্তু পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সেই অবস্থা চলছে। লন্ডনে বাজারে গেলে তো সীমিত জিনিসই কিনতে হবে। তার বেশি কেনা যাবে না। বিদ্যুৎ একটু ব্যবহার করলেই ফাইন দিতে হবে। গাছে পানি দেওয়া যাবে না। বালতিতে করে একটু একটু করে পানি দিতে হবে। পানি দিয়ে গাড়ি ধোয়া যাবে না। শুধু লন্ডন নয়, ইউরোপের সব জায়গায় এই একই অবস্থা।
মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জানি জিনিসের দাম বেড়েছে, মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ঈদের আগে পাটগাতী বাজার (প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার বাজার) থেকেই ২০০ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। ওই বাজারে ৫৫ ইঞ্চি টিভিও পাওয়া যাচ্ছে। ওখানে কয়েকটি টিনের ঘর ছাড়া আর কিছু ছিল না। এই বদলে যাওয়ার চিত্র এখন সর্বত্র।
১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর সারা দেশ ঘুরে বেড়ানোর প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি এজন্যই যে দেশটাকে না চিনলে উন্নতি করব কীভাবে? যখনই সরকারে এসেছি, সেই মোতাবেক কাজ করেছি, আজ উন্নয়নটা করতে পেরেছি। আমাদের কাজ জনগণের সেবা করা। আমরা সেই চেষ্টাটাই করেছি। আমাদের লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ করা। এ সময় খুব শীঘ্রই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করতে যাচ্ছে বলে জানান সরকারপ্রধান। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক পরিশ্রম করেই আমাদের এই উন্নয়নটা করতে হয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জনসংখ্যা বেশি। চাষ উপযোগী জমি কম। তারপরও আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও যুদ্ধের কারণে আজ ভোজ্যতেল, গম, জ্বালানি তেল, চিনি এ রকম অনেক কিছু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর দাম বিশ্বে বেড়ে গেছে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, এখন আমাদের কাঁচামরিচও আমদানি করতে হয়। কেন করতে হবে? জানি বর্ষাকালে খেতে পানি উঠে যায়। মরিচ তোলা যায় না বা মরিচ পচে যায়। সেজন্য সমস্যা হয়। এখন থেকে আমাদের কিছু ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে। নিজেই আমরা গাছ লাগাব, উৎপাদন করব। ছাদবাগান অথবা ভাসমান বাগান করব। ঝুলন্ত বাগান করব। আমার এলাকায় কিন্তু আমি শুরু করে দিয়েছি। গণভবনও এখন মোটামুটি খামারবাড়ি করে ফেলেছি। আমার ছাদেও মরিচ গাছ আছে। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশকে কেউ অবহেলা করতে পারে না। বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে এখন সম্মানের চোখে দেখে। আমরা এই উন্নতিটা করতে পেরেছি বলেই সম্ভব হয়েছে।
বরিশালে বড় পর্দায় দেখানো হলো শপথ অনুষ্ঠান ॥ বরিশাল থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, বরিশাল সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ও নির্বাচিত কাউন্সিলরদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে।
নবনির্বাচিত বরিশাল সিটি মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার জনকণ্ঠকে জানান, সোমবার সকালে বরিশাল নৌকা মার্কার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নগরবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে প্রজেক্টর স্ক্রিনের বড় পর্দার মাধ্যমে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়েছে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি বড় পর্দায় সরাসরি উপভোগ করেছেন দলের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের নগরবাসী।