‘‘বেক্সিমকোর মালিকানায় কারা আছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী, আমরা সেগুলো দেখছি না। আমরা শিল্প ও কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দিচ্ছি,’’ বলছেন সচিব সফিকুজ্জামান।
সচল হতে পারে বেক্সিমকো টেক্সটাইল, আগ্রহী জাপানি কোম্পানি

- আপডেট সময় ০৪:০৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
- / ৬৪ বার পড়া হয়েছে
অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের ‘বেক্সিমকো টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল ডিভিশন’ (বেক্সটেক্স) সচল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সরকারের উদ্যোগে তৈরি পোশাক খাতের জাপানি কোম্পানি রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেড এটি লিজ নিয়ে সচল করতে রাজি হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপও লিজ দিতে ‘কমফোর্ট লেটার‘ দিয়েছে।
এতে নতুন করে ২ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে রিভাইভাল প্রজেক্ট। কোম্পানিটির পোশাক খাতে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
চলতি অগাস্ট মাসেই এ বিষয়ে ঋণদাতা জনতা ব্যাংক, বেক্সটেক্স, রিভাইভাল প্রজেক্ট ও সরকারের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হতে পারে। সরকারের প্রস্তাবে প্রথমে রাজি না হলেও বর্তমানে বেক্সিমকো গ্রুপ সম্মত হয়েছে লিজ দিয়ে হলেও কারখানা সচল করতে।
কয়েকটি সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থায়নকারি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক ও সরকার প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দিতে হোমওয়ার্ক করছে। বিষয়টি সরকারের পক্ষে সমন্বয় করছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে সবশেষ সভা করেছে মন্ত্রণালয়। সেখানে বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও. কে. (ওসমান কায়সার) চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
বৃহস্পতিবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমাদের মন্ত্রণলায় মূলত কো-অর্ডিনেশনের কাজটি করছে। আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি কর্মসংস্থান ও ব্যাংক ঋণের দিকটি। প্রতিষ্ঠানটি সচল হলে কিছু কিছু করে হলেও ব্যাংকের টাকা শোধ দিতে পারবে, জানি তাতে অনেক সময় লাগবে।’’
পোশাক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটিতে ১২ হাজারের মত শ্রমিক কাজ করছিল বন্ধ হওয়ার আগে। সেই কর্মসংস্থানের পুরোটা ফিরতে সময় লাগবে।
সফিকুজ্জামান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বেক্সিমকোর টেক্সটাইল ইউনিট রপ্তানিমুখী। তাদের মেশিন আছে, সেটাপ রেডি। আমরা কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিচ্ছি। লিজ নিয়ে চালালেও কিছু লোকের কর্মসংস্থান তো হবে। এখন পক্ষগুলো (বেক্সিমকো, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও রিভাইভাল প্রজেক্ট) চুক্তিতে পৌঁছাতে পারলে চালু হতে পারে প্রতিষ্ঠানটি।’’
তিনি বলেন, ‘‘বেক্সিমকোর মালিকানায় কারা আছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়টা কী, আমরা তা দেখছি না। এটা রাজনৈতিক বিষয়। আমরা শিল্প ও কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’’
কতো টাকা লাগবে সচল হতে
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থ্যানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গ্রেপ্তার হন শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
এছাড়া সরকার পতনের পর থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে অস্থিরতা শুরু হয়। শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে বন্ধ রাখা হয় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬ কারখানা।
সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান। বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ৩২টি কারখানার নাম ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে ১৬টির অস্তিত্ব পায় সরকারের তদন্ত কমিটি।
অস্তিত্ব না থাকা ১৬টির নামে ঋণ নেওয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে ৩২ কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয় ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকার ঋণ।
এ ঋণের সিংহভাগের যোগান দেয় রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ব্যাংক। এসব ঋণ খেলাপী হয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই ২৩ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে অস্তিত্ব থাকা ১৬টির মধ্যে ১১টি বস্ত্র ও পোশাক খাতের কোম্পানি, যেগুলো লে-অফ ছিল গত জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর সেগুলো আর খোলা হয়নি।
বিশেষ সুবিধায় বেক্সটেক্সের নেওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিলে নতুন অর্থায়ন করতে পারবে জনতা ও বিভিন্ন ব্যাংক। শুধু কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা চালু করার সুবিধা দেওয়ার পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তাতে শর্ত দেওয়া হয়েছে, লিজ নেওয়া কোম্পানি যে মুনাফা করবে, তা থেকে সার্ভিস চার্জ বাদে পুরোটা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হতে হবে।
একসময়কার লাভজনক কোম্পানি বেক্সটেক্সের বড় ক্রেতাগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে জারা, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, টারগেট, আমেরিকান ঈগল, পুল অ্যান্ড বিয়ার ও বেস্ট সেলারের মত প্রতিষ্ঠান।
কারখানা চালু হলে প্রথম তিন মাস পরিচালন খরচ বাবদ নতুন অর্থান লাগবে। বন্ধ হওয়ার পরে গত জানুয়ারিতে একদল শ্রমিক ও কর্মাচারিদের নিয়ে হাজির হয়ে সংবাদ সম্মেলনে বেক্সিমকো গ্রুপের হেড অব এডমিন আব্দুল কাউয়ুম বলেছিলেন, ‘‘কারখানা চালু করতে পরিচালন খরচ বাবদ প্রতি মাসে একশ কোটি টাকা লাগবে।‘‘
আব্দুল কাউয়ুমের ভাষ্যে, সরকার সহিযোগিতা করে কারখানা খুলে দেওয়ার পর পরিচালন খরচ বাদ দিলে প্রতি বছরে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব।
এ হিসাবে তিন মাসে ৩০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন লাগবে বেক্সটেক্সের।
কোনো ক্রয়াদেশ পাওয়ার পর তা রপ্তানি শেষে অর্থ দেশে আসতে ৩ মাসের মত সময় লাগে। এই তিন মাস ও পরবর্তী ক্রয়াদেশের জন্য প্রস্তুতি নিতে যে চলতি মূলধন লাগবে তা জনতা ব্যাংক দিতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসে চুক্তি হতে পারে জানিয়ে শ্রম সচিব বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তাগুলো দিলে অর্থায়ন সমস্যার একটা উপায় বের করবেন তারা।
শুধু বেক্সিমকোর ঋণ খেলাফি হয়ে যাওয়ার কারণে এক সময়ের লাভজনক জনতা ব্যাংক এখন দুর্বল ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম ফজলুর রহমান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এটা তো কর্তৃপক্ষের (সরকারের) সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা জানালে আমরা প্রসেস করব। ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের কাছে পাঠানোর পর আমরা বিস্তারিত জানতে পারব।’’
সক্ষমতা থাকার পরও ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি বেক্সিমকো গ্রুপ। এজন্য দিনের পর দিন গ্রুপটির ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে জনতা ব্যাংকে, তার প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপীতে পরিণত হয়েছে।
নতুন করে জনতা ব্যাংক অর্থায়ন করতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্নে ফজলুর রহমান বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা তো খাদের মধ্যে পড়ে আছি। কখনো বের হওয়ার চেষ্টা করি, আবার পড়ে যাই। চেষ্টা চলছে উন্নতি করার। প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এক সময় উন্নতি হবে।‘‘
অর্থের যোগান করতে পারে জাপানি প্রতিষ্ঠান
ব্যাংকের বাইরে চলতি মূলধধের যোগান রিভাইভাল প্রজেক্টের মাধ্যমে আসতে পারে, এমন আলোচনাও হয় শ্রম মন্ত্রণালয়েরে সভায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ক্রয়াদেশের সময় জাপানি প্রতিষ্ঠানটি মুলধন আনবে বলে জানানো হয়েছে। চুক্তি হওয়ার সময় তা স্পষ্ট হবে।‘‘
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, রপ্তানি থেকে হওয়া আয় দিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ হওয়া এবং পুরো আর্থিক স্বচ্ছতা বজায় রাখতে জাপানি কোম্পানি ডেলয়েটকে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।
বেক্সটেক্স একটি কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল। ওভেন খাতে ১৫০ লাইনের মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা ৬১ লাখ পিস ও নিট খাতের ৪০ লাইনে উৎপাদন হয় ৩০ লাখ পিস পোশাক।
মইদুল হাসান – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম