“আমার দল নেই; যারা (ভোটে) সরে দাঁড়িয়েছেন, তাদের একসঙ্গে নিয়ে জাবিকে নতুনভাবে বিনির্মাণ করতে চাই,” বলেন তিনি।
সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চান জাকসুর নির্বাচিত ভিপি ‘স্বতন্ত্র’ জিতু

- আপডেট সময় ১২:১২:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৩ বার পড়া হয়েছে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয়-জয়কারের মধ্যে ভিপি পদে জয় পেয়েছেন ‘স্বতন্ত্র’ আব্দুর রশিদ জিতু; যিনি ‘দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে’ কাজের অঙ্গীকার করেছেন।
ফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, “জাকসুতে এককভাবে কোনো প্যানেল নির্বাচিত হয়নি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দলমতের বাইরে গিয়ে একটি ‘ইনক্লুসিভ’ জাহাঙ্গীরনগর গড়ার চেষ্টা করব। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে এবং জাহাঙ্গীরনগরের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে সবসময় কাজ করব।”
তেত্রিশ বছর পর হওয়া জাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র থেকে ভিপি হলেও জিএস হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাজহারুল ইসলাম। জিতু ৩৩৩৪ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
জাকসুর ২৫ পদের ২০টিতেই জয়লাভ করেছেন ছাত্রশিবিরের মনোনীত প্রার্থী। তিনটি পদে স্বতন্ত্র এবং বাকি দুটিতে বাগছাসের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
জিতু বলেন, “শিক্ষার্থীরা আমার উপর আস্থা রেখেছে, আমাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে। শিক্ষার্থীরা যে ভরসার জায়গা থেকে আমাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে, এজন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভাইবোনকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
“ভোটের আগ মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের যে কথাগুলো বলেছিলাম, আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব সেগুলোকে শতভাগ বাস্তবায়ন করার।”
শিক্ষার্থীরা যে সুযোগ-সুবিধা থেকে ‘দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত’, সেগুলো সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই ‘প্রথম কাজ’ হবে বলে মন্তব্য করেন জিতু।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখানে আমরা যারাই নির্বাচিত হয়েছি বা নির্বাচন করেছি, সকলেরই ক্যাম্পাসের স্বার্থে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা ছিল, বিধায় আমরা সেখানে ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম এবং শিক্ষার্থীরা আমাদের উপর আস্থা রেখেছেন।
“যে দল থেকে বা যে প্যানেল থেকেই নির্বাচিত হোক না কেন, একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়ত হব না। আমরা সকলেই জাকসুতে কাজ করব, কার্যকর জাকসু গড়ে তোলার জন্য সকলে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাব।”
ক্যাম্পাস থেকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা, ক্যাম্পাসকে নিরাপদ করা এবং শিক্ষার্থীরা যেন কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জিতু।
তিনি বলেন, “যারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে থেকে গেলে ভাল হত। আমার দল নেই; যারা সরে দাঁড়িয়েছেন তাদের একসঙ্গে নিয়ে জাবিকে নতুনভাবে বিনির্মাণ করতে চাই।”
‘ছাত্রলীগ থেকে স্বতন্ত্র’
ক্যাম্পাসে আব্দুর রশিদ জিতুর ঘনিষ্ঠ সাবেক এক ছাত্রনেতা বলছিলেন, জিতু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। থাকতেন আল বেরুনি হলে। সেখানে রাজনীতি করেই তিনি ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যও হন।
২০২৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রাফিতি মুছে নতুন করে গ্রাফিতি অঙ্কন করে ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ। সে সময় বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর প্রতিবাদে তখন ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতার বহিষ্কার চেয়ে অনশনে বসেছিলেন ছাত্রলীগের সহসভাপতি এনামুর রহমান এনাম। সেই অনশনে আওয়ামীপন্থি শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির অধ্যাপক সোহেল আহমেদের পাশাপাশি আব্দুর রশিদ জিতুও সংহতি জানিয়েছিলেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে তিনি সবসময়ই সক্রিয় ছিলেন। ২০২৪ সালে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তখন জিতু তার হল ও ক্যাম্পাসে সংগঠক হিসেবে কাজ করেন।
আন্দোলন চলাকালে সে বছর ১৫ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। তখন অনেকের সঙ্গে জিতুও আহত হন। পরদিন ১৬ জুলাই হল বন্ধ হয়ে গেলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান। কিন্তু জিতুসহ অন্যান্য সংগঠকরা ক্যাম্পাস ছাড়েননি।
জিতু তখন আন্দোলনের একেবারে সামনের কাতারে চলে আসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যে ১৫৮ সমন্বয়ক ছিলেন, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাতে দুজন ছিলেন। একজন আব্দুর রশিদ জিতু, অন্যজন আরিফ সোহেল।
এরপর থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত পুরো সময়টাই জিতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আন্দোলনকারী নেতাদের একটা অংশ নানা ‘নেতিবাচক’ কর্মকাণ্ডে জড়ালেও জিতু তাতে জড়াননি। বরং সে বছর অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে ফেনী-লক্ষীপুর-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার সময় তিনি ত্রাণ কাজে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হন। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ান।
জুলাই আন্দোলনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে একসঙ্গে ১৮ জন সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক পদত্যাগ করেন। ওই সময় জিতুর নেতৃত্বে পদত্যাগকারী কয়েকজন মিলে ‘গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। পরে ওই সংগঠনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, পোষ্য কোটা বাতিলসহ বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন জিতুসহ অন্যরা।
সেই ছাত্রনেতা বলছিলেন, জিতুর ক্যাম্পাসে একটা পুরনো সার্কেল আছে। যারা দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে প্রভাব রেখেছেন, নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ৫ অগাস্টের পর নতুন পরিস্থিতিতে নতুন আরেকটি বলয় তৈরি হয়েছে। জিতু এই পুরনো ও নতুন দুই বলয়েকেই ‘নিজের মত করে সমন্বয়’ করতে পেরেছেন। স্বতন্ত্র হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরাই তার শক্তির মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে।
মইদুল হাসান – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম