জাতিসংঘের উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, ৩০ দিনের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য সময় থাকে ১২ মাস।
৩০ সেকেন্ডেই বিধ্বস্ত: যেভাবে এগোচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্ত

- আপডেট সময় ০৯:৩১:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
- / ১১ বার পড়া হয়েছে
৪০ সেকেন্ডেরও কম সময়। এটুক পর্যন্তই আকাশে ছিল এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৭১। তারপরই ভারতের গুজরাটে আহমেদাবাদের ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় বিধ্বস্ত হয় উড়োজাহজটি।
ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ও রহস্যজনক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ছিল এটি। উড়োজাহাজে থাকা ২৪২ আরোহীর একজন বাদে সবারই মৃত্যু ঘটেছে। উড়োজাহাজটি যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর ভেঙে পড়েছিল সেখানেও নিহত হয়েছেন কয়েকজন।
এখন তদন্তকারীদের কঠিন দায়িত্ব, ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে তথ্য বের করা, ‘ব্ল্যাক বক্স’ বা ককপিট ভয়েস ও ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা, উড্ডয়নের ঠিক পরেই কী হয়েছিল উড়োজাহাজটির।
জাতিসংঘের বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থা আইসিএওর নিয়ম অনুযায়ী, ৩০ দিনের মধ্যে তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে সাধারণত এক বছর সময় পায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
লন্ডনগামী বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারটি আহমেদাবাদ থেকে স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে ছেড়ে গিয়েছিল। ককপিটে ছিলেন ক্যাপ্টেন সুমিত সাবারওয়াল ও সহ-পাইলট ক্লাইভ কুন্দার। যাত্রী ছিলেন ২৪২ জন। বোর্ডে ছিল প্রায় ১০০ টন জ্বালানি। উড্ডয়নের কিছু সময় পরই রেডিওতে আসে একটি ‘মে ডে’ সংকেত—সেটিই ছিল বিমানের শেষ বার্তা। মুহূর্তের মধ্যে উড়োজাহজটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিদ্ধস্ত হয়।
ভারতের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরোর সাবেক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন কিশোর এই ঘটনাকে বলেছেন, “রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার”—অর্থাৎ ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা। তিনি বলেন, উড্ডয়নের ৩০ সেকেন্ডের মাথায় এমন দুর্ঘটনা তিনি আগে দেখেননি।
এখন প্রশ্ন, উড্ডয়নের পর এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এমন পরিণতি কেন ঘটল? দুটি ইঞ্জিন কি পাখির ধাক্কায় বা জ্বালানির দূষণের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? প্রচণ্ড গরমে কি ভারি ওজনের উড়োজাহাজ ঠিকমতো ফ্ল্যাপ না খোলার কারণে ওপরে উঠতে পারেনি?
ইঞ্জিন মেরামতের সময় কি কোনো ত্রুটি হয়েছিল? না কি কোনও ক্রুর অসাবধানতার কারণে দুই ইঞ্জিনেই জ্বালানি বন্ধ হয়েছিল? তদন্তকারীরা এই সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখছেন। দুর্ঘটনার নেপথ্যে নাশকতামূলক কার্যকলাপের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
যে কারণেই বিমান বিপর্যয় ঘটে থাকুক, সেটা যান্ত্রিক ত্রুটি হোক বা নাশকতা -ক্লু একমাত্র মিলতে পারে ব্ল্যাক বক্স থেকে। উড়োজাহাজের যাবতীয় তথ্য এর মধ্যেই নথিবদ্ধ হয়। উড়োজাহাজ কত উচ্চতায় উড়েছে, কত গতিবেগে উড়েছে, কোন পথে এগিয়েছে, ইঞ্জিন কী অবস্থায় ছিল, সমস্ত তথ্য জমা হয় এই ব্ল্যাক বক্সে।
বোয়িংয়ের অত্যাধুনিক বিমানে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ককপিট থেকে দেওয়া কমান্ড ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে ধরা পড়া ককপিটের কথোপকথন, রেডিও ট্রান্সমিশন, ওয়ার্নিং অ্যালার্ম এবং অন্যান্য যান্ত্রিক শব্দও ‘ব্ল্যাক বক্সে’ সংরক্ষিত থাকে।
ফলে কোন কারণে উড়োজাহাজ বিপর্যয় ঘটে থাকতে পারে, সেই তথ্য একমাত্র মিলতে পারে ব্ল্যাক বক্স থেকে। সেকারণে ব্ল্যাক বক্সের তথ্যের ওপরই বিশেষজ্ঞরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তা ছাড়া, প্রত্যেকটি পোড়া তার, ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিনের ব্লেড, রক্ষণাবেক্ষণের নথিপত্র, এমনকি ককপিটের পটভূমির শব্দ—সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্তে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ক্লু পাওয়া যেতে পারে ইঞ্জিনের ধ্বংসাবশেষ থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ডের সাবেক পরিচালক পিটার গ্যোলজ বলেন, “ইঞ্জিন চালু থাকা অবস্থায় যদি আঘাত পায়, তার ক্ষত ভিন্নভাবে হয়। সেটি থেকেই বোঝা যাবে দুর্ঘটনার সময় ইঞ্জিন চলছিল কি না।”
তিনি বলেন, যদি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তদন্তের দৃষ্টি যাবে ককপিটের দিকে। ককপিটের ভেতর কি হয়েছিল তা জানা যাবে বোয়িং ৭৮৭-এর ‘ব্ল্যাক বক্স’ এর রেকর্ড ঘেঁটে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই রেকর্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। ভারতে এএআইবি (এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো) তদন্ত শেষে এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনারের ব্ল্যাক–বক্স যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় আরলিংটন কাউন্টিতে বোয়িং–এর সদর দপ্তরেও পাঠানো হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, বোয়িংও দেখতে চায়, উড়োজাহাজে কী ধরনের ত্রুটি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ডের সাবেক পরিচালক পিটার গ্যোলজ বলেন, “যদি দেখা যায় ইঞ্জিন পূর্ণ শক্তিতে চলছিল, তাহলে দেখা হবে ফ্ল্যাপ ও স্ল্যাট ঠিকমতো কাজ করেছিল কিনা।
সেগুলোও যদি ঠিক থাকে, তবে তদন্ত কঠিন হয়ে যাবে।” আর যদি বোঝা যায় ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল সিস্টেমেই সমস্যা ছিল, তাহলে তা শুধু বোয়িং নয়, গোটা উড়োজাহাজ শিল্পের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠবে।
বোয়িং ৭৮৭-এর এই স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম উড়োজাহাজের পারফরম্যান্স, জ্বালানি ব্যবহার, রুট নিয়ন্ত্রণসহ নানা দিক সামলায়। ২০১১ সালের পর থেকে বিশ্বের আকাশে ১১০০টির বেশি ৭৮৭ উড়ছে। এই মডেলের কোনও ত্রুটি থাকলে, গোটা বোয়িং উড়োজাহাজই ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানায়, এয়ার ইন্ডিয়ার ৩৩টি বোয়িং ৭৮৭-এর মধ্যে ২৪টি পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে তাতে ‘বড় ধরনের কোনও নিরাপত্তা ঝুঁকি’ পাওয়া যায়নি।
গত ১২ জুন এক বিবৃতিতে বোয়িংয়ের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কেলি ওর্টবার্গ বলেন, “এই তদন্তে আমরা ভারতের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরোর নেতৃত্বে কাজ করব—যা আইসিএও নিয়ম অনুযায়ী।”
তদন্তে অংশ নিচ্ছে বোয়িং, ইঞ্জিন নির্মাতা জেনারেল ইলেকট্রিক, এয়ার ইন্ডিয়া, ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের এনটিএসবি এবং যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ দল।
গ্যোলজ বলেন, “সাধারণত কী ঘটেছে, সেটা দ্রুত বোঝা যায়। কিন্তু কেন ঘটেছে, সেটা বের করতেই বেশি সময় লাগে।”
তিনি মনে করিয়ে দেন, ২০১৪ সালে ইউক্রেইনে বিধ্বস্ত হওয়া মালয়েশিয়ার এমএইচ১৭ বিমানের ক্ষেত্রে ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণই প্রমাণ দিয়েছিল রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের।
এ ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা জ্বালানির নমুনা, ইঞ্জিনে ঢোকার লাইনের অবস্থা, এমনকি ফিল্টার, ভালভ—সবই দেখবেন। একজন তদন্তকারী বিবিসি-কে বলেন, দুর্ঘটনার আগেই রিফুয়েলিংয়ের সরঞ্জাম আলাদা করে রাখা হয়েছে।
তদন্তে বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ রেকর্ড, যন্ত্রপাতি বদলের তথ্য, ক্রুদের লাইসেন্স, প্রশিক্ষণ, সিমুলেটর ফলাফল, এমনকি আগে তারা যেসব ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন, সেসব কিছুই খতিয়ে দেখা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ডের সাবেক পরিচালক গ্যোলজ বলেন, “এই তদন্তগুলো জটিল, সময়সাপেক্ষ। তবে প্রাথমিক কিছু ইঙ্গিত খুব দ্রুত পাওয়া যায়।”
তিনি বলেন, “১৯৯৪ সালে আমি যে ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার পেয়েছিলাম তাতে মাত্র ৪ প্যারামিটার রেকর্ড ছিল। আজকের ডেটা রেকর্ডার প্রতি সেকেন্ডে হাজার না হলেও শত শত প্যারামিটার রেকর্ড ধরে রাখে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি তদন্তের ধরন পাল্টে দিয়েছে।”