নির্বাচন কমিশন শুক্রবার রাতের মধ্যেই ফল প্রকাশের আশা দিলেও নানা ঘটনাপ্রবাহে তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
৩২ ঘণ্টা পরও মেলেনি জাকসু ভোটের ফল, পারদ চড়ছে

- আপডেট সময় ০১:৫৮:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৩ বার পড়া হয়েছে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ-জাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের পর ৩২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ফল কখন প্রকাশিত হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যাচ্ছে না।
ওএমআর মেশিনের পরিবর্তে হাতে ভোট গোনার সিদ্ধান্ত, গণনা প্রক্রিয়ায় ধীর গতি, আর পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে ভোটের সম্ভাব্য ফল নিয়ে আস্থাও কমছে।
ভোট গণনার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে শুক্রবার সকালে সিনেট ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যু হয়। এজন্য নির্বাচন কমিশনের ‘অব্যবস্থাপনাকে’ দায়ী করেছেন তার সহকর্মীরা।
অপরদিকে দ্রুত ভোটের ফলাফল প্রকাশের জন্য এখনও নির্বাচনি লড়াইয়ে থাকা প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা বিক্ষোভ করছেন। তারা বলছেন, ভোট গণনায় এত দীর্ঘ সময় লাগা দুঃখজনক। এটি পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে হয়েছে।
যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোট গণনা এগিয়ে নেওয়া এবং রাতের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশের প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে।
১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে ২১টি হলে ভোটগ্রহণ শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায়। বিকাল ৫টার মধ্যে অধিকাংশ হলের ভোটগ্রহণ শেষ হলেও দু-তিনটি হলে ভোটারের দীর্ঘ লাইন থাকায় তা রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত গড়ায়।
রাত ১০টার পরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সিনেট ভবনে শুরু হয় ভোট গণনার কাজ। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এ নির্বাচনের ভোট পড়েছে প্রায় ৬৮ শতাংশ।।
সবশেষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণনা শুরু হওয়ার প্রায় ২১ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ২১টি হল সংসদের ভোট গণনা শেষ হয়েছে। এরপরই কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা শুরু হয়। বিকালে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, প্রায় আট হাজার ভোটার ভোট দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য তিনটা করে ব্যালট গুনতে হবে। তার মানে, প্রায় ২৪ হাজার ব্যালট গণনা করতে হবে।
এদিকে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা নানা অসংগতি ও অনিয়মের কথা বলছিলেন। তারা কেন্দ্রে ভোটের চেয়ে ব্যালট বেশি যাওয়া, প্রতিপক্ষের আচরণবিধি ভঙ্গ করা, জামায়াত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন সরবরাহ করা, পোলিং এজেন্টের অনুমতি থাকলেও তাদের প্রবেশে বাধা দেওয়া, ডোপ টেস্টের ফলাফল না আসা, নির্বাচনকে ‘ম্যানিপুলেট’ করার নানা অভিযোগ আসছিল।
এর মধ্যে একে একে পাঁচটি প্যানেল ও স্বতন্ত্র কয়েকজন প্রার্থীও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো ঘোষণা দেন। একজন নির্বাচন কমিশনারসহ ভোটের দায়িত্বে থাকা মোট চারজন শিক্ষক নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ান। পরে বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা নির্বাচন বাতিলের দাবিও জানান।
অপরদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির এসব ঘটনাকে ‘লেজ গুটিয়ে পালানো এক ধরনের প্রতারণা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। একটি প্যানেল থেকে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তোলা হলেও তারা নির্বাচন বর্জন না করার পক্ষে অবস্থান দেন।
নির্বাচন যারা বর্জন করেছেন, তাদের ভোট গণনা-প্রক্রিয়ার সময় আর সক্রিয় থাকতে দেখা যায়নি। অনেকে ক্যাম্পাসও ছেড়ে চলে গেছেন।
শুক্রবার রাতেও অনেক শিক্ষার্থী ভোট গণনার সময় হল থেকে সিনেট ভবনের সামনে এসে জড়ো হন। তার মধ্যে প্রার্থী ও প্যানেলের সমর্থক যেমন ছিলেন, তেমনি সাধারণ উৎসুক শিক্ষার্থীও ছিলেন। ভোটের ফলাফল প্রকাশের এই দীর্ঘসূত্রতায় সবাই বেশ বিরক্ত।
রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী আনিসুজ্জামান সানির সঙ্গে কথা হয় সিনেট ভবনের সামনে।
তিনি বলছিলেন, “দেরিটা হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের এই নির্বাচনে প্রথমে ভোট গোনার পদ্ধতিটা ছিল মেশিনের মাধ্যমে। কিন্তু, ছাত্রদল এবং অন্যান্য কিছু প্রার্থীদের দাবির মুখে এটা ‘ম্যানুয়ালি’ গোনার সিদ্ধান্ত হয়।
“কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘ম্যানুয়ালি’ গণনার প্রস্তুতি ছিল না। ফলস্বরূপ দেখা গেছে, প্রত্যেকটা হলের ফল গুনতেই তাদের গড়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল। যদি প্রস্তুতি থাকত তাহলে তো তারা আর জনবল বাড়াত।”
জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) সজীব আহমেদ জেনিচ বলেন, “কোটি টাকার বাজেট দিয়ে ভোট গণনার মেশিন কিনে এনেও তা কাজে লাগাতে পারছে না, বিভিন্ন অভিযোগে। সব কিছুই পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। প্রশাসন নির্লজ্জভাবে এসব প্রব্লেম তৈরি করেছে একটা গোষ্ঠীকে সুবিধাভোগী করার জন্য।
“ওএমআর মেশিন যাদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে তাদের দলীয় পরিচয় সামনে এসেছে। ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠন আপত্তি জানালে প্রশাসন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সবগুলো হলের ভোট সিনেট হলে গণনার সিদ্ধান্ত নেয়। এ পরিকল্পনাটা ছিল প্রশাসনের অদক্ষতা আর কমিশনের অথর্বতার পরিচায়ক। আর এ সিদ্ধান্তের কারণেই ভোট গণনায় এত দেরি।”
আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলের এই শিক্ষার্থী বলেন, “অল্প কিছু মানুষ আর মাত্র তিনটা বা চারটা টেবিল দিয়ে গোনার কারণে অনেক সময় লাগছে। একেকজন শিক্ষার্থী ৪০টি করে ভোট দিয়েছেন। সবমিলিয়ে সময় অনেক বেশি লাগছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী তাহসিন মাহমুদ বলছিলেনন, এত দীর্ঘ সময় ধরে ফলাফল দেওয়াটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এত সময় লাগে, একটা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে, এটা সত্যিই দুঃখজনক।
“ডাকসু তো প্রায় ছয় বছর পরে হল। তাদের প্রস্তুতি ছিল। আর এখানে প্রায় ৩৩ বছর পর এই নির্বাচন হচ্ছে। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিতে পারেনি, এটা একদম স্পষ্ট।”
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, “ভোট গণনার ক্ষেত্রে জায়গার কিছুটা সংকট আছে। তার মধ্যেই লোকবল বাড়ানো হয়েছে। ভোট গণনার কাজ অব্যাহত গতিতে চলছে। চেষ্টা করছি, যেন ভোট গণনার গতি আরেকটু বাড়ে। আমি আশা করি, রাতের মধ্যেই আমরা ভোট গণনার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারব। আমরা সুনির্দিষ্ট সময় বলতে পারছি না।”
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেছেন, “বলা প্রয়োজন, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নির্বাচনের ভোট গণনা করা হচ্ছে।… নিরবচ্ছিন্নভাবে এই গণনা কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে। কমিশন আশা করছে, রাতের মধ্যে ভোট গণনা সম্পন্ন হবে এবং যথারীতি ফলাফল ঘোষণা করা হবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম