গত মার্চ মাসে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েল ফের গাজায় হামলা চালানোর পর থেকে তারা এই ভবন ধ্বংস শুরু করেছে।
গাজায় হাজার হাজার ভবন মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল

- আপডেট সময় ০৭:১৮:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
- / ৩৮ বার পড়া হয়েছে
গাজাজুড়ে হাজার হাজার আবাসিক ভবন নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরিকল্পিতভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল।
চলতি বছরের মার্চ মাসে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েল ফের গাজায় হামলা চালানোর পর থেকে তারা এই ভবন ধ্বংস শুরু করেছে।
পুরো শহর ও শহরতলী গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল, এক সময় যে এলাকাগুলোতে ছিল শত-সহস্র মানুষের বাড়ি। গত কয়েক সপ্তাহে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বেশ কিছু এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ স্যাটেলাইট চিত্রে উঠে এসেছে। ইসরায়েলের সামরিক কমান্ড এসব এলাকা তাদের পরিচালনাধীনে আছে বলে দাবি করেছে।
এসব এলাকার আবাসিক ভবনগুলোর বিশাল একটি অংশ নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন যেমন ছিল, তেমনি অক্ষত ভবনও ছিল।
যাচাই করা ভিডিওতে দেখা গেছে, বহুতল ভবন, স্কুল ও অন্যান্য স্থাপনা ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে কীভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিবিসি ভেরিফাইকে একাধিক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, এই কর্মকাণ্ড জেনেভা কনভেনশনের আওতায় যুদ্ধাপরাধের সামিল হতে পারে। এই কনভেনশন অনুযায়ী, কোনও দখলদার শক্তির পক্ষে কোনও এলাকার অবকাঠামো ধ্বংস করা আইনত নিষিদ্ধ।
তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ-এর একজন মুখপাত্র বলছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
হামাস বেসামরিক এলাকায় “সামরিক স্থাপনা” লুকিয়ে রেখেছে বলেও দাবি করেন তিনি। তার ভাষ্য, “ভূসম্পত্তি বা ঘরবাড়ি ধ্বংস কেবল তখনই করা হয়, যখন সামরিকভাবে তা জরুরি হয়ে পড়ে।”
তবে, বিবিসি ভেরিফাইয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ধ্বংস ছিল বেশিরভাগই পূর্বপরিকল্পিত এবং অনেক ভবন তখনও ব্যবহার উপযোগী ছিল।
জুলাই মাসে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ রাফাহ নগরীর ধ্বংসাবশেষের উপর একটি ‘মানবিক শহর’ গড়ার রূপরেখা প্রকাশ করেছিলেন।
সেখানে প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ ফিলিস্তিনিকে রাখা, পরে আরও ফিলিস্তিনিকে সেখানে ঢোকানো এবং তারপর তাদেরকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন তিনি।
তবে এই পরিকল্পনার ব্যাপক নিন্দা জানান খোদ ইসরায়েলেরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। তিনি এই পরিকল্পনাকে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন।’
গাজায় মার্চে যুদ্ধবিরতি শেষের পর থেকে বিবিসি ভেরিফাই ৪০ টি স্থানে অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়ার ফুটেজ শনাক্ত করেছে। এই ফুটেজে তেল আল সুলতানের মতো এলাকায় বিভিন্ন স্কুলসহ আবাসিক ও পৌর ভবনও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে দেখা গেছে।
রাফায় ধ্বংসজ্ঞ:
তেল আল সুলতান রাফা নগরীর সবচেয়ে প্রাণবন্ত এলাকাগুলোর একটি। ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকার রাস্তা বরাবর ছিল শহরের একমাত্র বিশেষায়িত প্রসূতি হাসপাতাল, এতিমখানা ও পরিত্যক্ত শিশুদের পরিচর্যা কেন্দ্র।
এলাকাটির অধিকাংশ ভবন ইসরায়েলের বিমান হামলায় আগেই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে ব্যাপক বোমাবর্ষণের পরও বেশকিছু ভবন দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু গত ১৩ জুলাই নাগাদ গোটা এলাকার ভবনই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেবল একটি হাসপাতাল আর কয়েকটা ভবন এখনও আছে।
রাফার পাশের এখন সৌদিপাড়া সংলগ্ন এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। সেখানে ছিল রাফার বড় বড় বেশ কয়েকটি মসজিদ ও স্কুল। ভিডিওতে এলাকাটিতে ইসসরায়েলের ট্যাংক এগুতে দেখা গেছে এবং রাস্তার পাশে খননযন্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের সেনাদেরকে ভবন গুঁড়িয়ে দিতে দেখা যায়।
বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গাজার অন্যান্য অংশেও ভবন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল।
কৃষি শহরও রেহাই পায়নি:
গাজা সীমান্ত থেকে মাত্র ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরের কৃষিনির্ভর শহর খুজা’আতেও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরায়েল। খুজা’আ এবং আবাসান আল-কবিরা— দুটি কৃষি প্রধান শহরই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর আগে খুজা’আ শহরে ১১ হাজার মানুষের বাস ছিল। গত মে মাসে স্যাটেলাইট ছবিতে শহরটিতে বহু বাড়িঘর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।
টমেটো, গম ও জলপাইয়ের জন্য পরিচিত এই শহরের প্রায় ১,২০০ ভবন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ। মধ্য জুন নাগাদ ইসরায়েলি বাহিনী খুজা’আ শহর প্রায় সবটাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কয়েক কিলোমিটার দূরের আবাসান আল-কাবিরা শহরেরও অবস্থাও অনেকটা একইরকম। সেখানকার ২৭ হাজার জনসংখ্যার অনেকেই এখন গৃহহীন। ৩১ মে থেকে ৮ জুলাইয়ের মধ্যে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, শহরের একটা বড় অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
‘নিরাপত্তা করিডোর’ ও ‘বাফার জোন’:
ইসরায়েল গাজার বিভিন্ন অংশকে ভাগ করে নিরাপত্তা করিডোর তৈরি করছে। এসব করিডোর বরাবর ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া, বাড়িঘর ভেঙে গাজায় সীমান্তের কাছের এলাকায় ইসরায়েলের ‘বাফার জোন’ তৈরির কথা শোনা গিয়েছিল আগেই।
আর এখন ইসরায়েল সীমান্ত ছাড়িয়ে গাজার আরও ভেতরে ঢুকে বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় তারা এরই মধ্যে বাড়িঘর ধ্বংস করেছে।
এছাড়াও, ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে কিজান আবু রাশওয়ান নামের একটি গ্রামে ১৭ মে’র পর থেকে প্রায় সব ভবন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একসঙ্গে থাকা বেশ কয়েকটি টাওয়ার ব্লক একযোগে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আইডিএফ জানিয়েছে, এলাকাগুলো “সন্ত্রাসী অবকাঠামো” মুক্ত করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে বিবিসি এসব নির্দিষ্ট ভবন ধ্বংসের পেছনে সামরিক কারণ জানতে চাইলে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধাপরাধের আশঙ্কা:
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইতান ডায়মন্ড বলেছেন, “সাধারণ নাগরিকের সম্পদ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা, যদি সেটি সরাসরি সামরিক প্রয়োজনে না হয়, তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
একজন বিশ্লেষকের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে গাজায় একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘সিকিউরিটি জোন’ গড়ে তুলতে চাইছে ইসরায়েল, যা তারা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে।
অন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, রাফা-তে প্রস্তাবিত ‘মানবিক শহর’ গড়তে ভেঙে ফেলা হচ্ছে ভবনগুলো। জেরুজালেম ‘ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির’ প্রেসিডেন্ট এফ্রায়িম ইনবারের ভাষ্য, এই ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ইসরায়েল হয়ত চায় ফিলিস্তিনিদের ‘প্রবলভাবে গাজা ভূখন্ড ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা’ তৈরি হোক।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এর আগেও এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এমপিদের বলেছিলেন, সেনাবাহিনী “ধ্বংস করে চলেছে আরও বেশি ঘরবাড়ি”, যাতে ফিলিস্তিনিদের আর “ফিরে আসার জায়গা না থাকে”। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে সেই বৈঠকের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
গাজাবাসীর হতাশা:
গাজার বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, তারা এখন নিঃস্ব।
তেল আল-সুলতানের বাসিন্দা মোয়াতাজ ইউসুফ আল-আবসি বলেন, “আমি যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে বাড়িটায় উঠেছিলাম। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছিলাম।
“এখন সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার আর কোনও ঘর নেই, নেই কোনও আশ্রয়ও।”
সূত্র : বার্তাসংস্থা রয়টার্স / বিবিসি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম