১১:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
"ছোট ছেলেটার আগেই ছুটি হইছে, ওরে নিয়া আমি চইলা গেছি। আর বড়টারে খুঁজতে খুঁজতে আইসা পাইলাম লাশ।"

ক্লাস ক্যাপ্টেন তানভীর এখন শুধুই সংখ্যা

নিঝুম আহমেদ - জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০১:১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
  • / ৪১ বার পড়া হয়েছে

 

স্কুল শেষে বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে বাড়তি ক্লাস করছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি মাধ্যমের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. তানভীর আহমেদ; কিন্তু মুহূর্তেই প্রাণচঞ্চল শিশুটি হয়ে পড়ে নিথর।

স্কুলে বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে মারা যাওয়া তানভীরের লাশ যখন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে রাখা, তাৎক্ষণিক তার পরিবারের কারও খোঁজ পাচ্ছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

বাসায় সন্তানের ফেরার অপেক্ষায় থাকা বাবা রুবেল হোসেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রথমেই স্কুলে ছুটে যান। সেখানে না পেয়ে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ নিতে থাকেন উত্তরার হাসপাতালগুলোতে।

খোঁজাখুজির পর রাত ৮টার দিকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে রুবেল খবর পান তার ছেলে আর নেই।

আইডি কার্ড দেখে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হলেও লাশ শনাক্ত করে হস্তান্তরের জন্য যখন হাসপাতালে ‘প্রয়োজনীয় কার্যক্রম’ চলছিল, তখন নিচে অপেক্ষমান বাবার কান্না স্বাভাবিকভাবেই থামছিল না।

কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হওয়া রুবেলকে শান্তনা দিতে গিয়ে তার ভাইও অশ্রু আটকে রাখতে পারছিলেন না।

তানভীরের বাবা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, “সে খুব মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল, ক্লাসে ক্যাপ্টেন ছিল। বাংলায় কথা বলত না, সবসময় ইংলিশে বলত।”

তিনি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে আহাজারি করছিলেন আর বলছিলেন, “খবর পাইয়া আমরা সব জায়গায় খুঁজছি, এরপর এইখানে আসছি। আমরা তো জানি না, আমার বাবাটা আর নাই।”

তার ছোট ছেলে তাসফিক একই স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলের ক্লাস শেষ হয় বেলা ১১টায়। এরপর তাকে নিয়ে বাসায় ফেরেন রুবেল।

তিনি বলেন, “তারও (তানভীর) ক্লাস শেষ হয়ে গেছিল। স্কলারসিপের জন্য এক্সট্রা ক্লাস করতেছিল। নয়তো সেও বাসায় চলে যেত।

“ছোট ছেলেটার আগেই ছুটি হইছে, ওরে নিয়া আমি চইলা গেছি। আর বড়টারে খুঁজতে খুঁজতে আইসা পাইলাম লাশ।”

 

 

তানভীরদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। ছেলেকে দাফন করবেন গ্রামেই। এই কথা বলতে বলতে রুবেল বলেন, “গত ঈদে সবাই বাড়ি গেছি। আজ ছেলের লাশ নিয়া যাইতে হইবো।”

সময় গড়ায়, রাত ৯টা নাগাদও ছেলের লাশের অপেক্ষায় ছিলেন বাবা রুবেল। যে ছেলের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন দুপুরেও, সে অপেক্ষা বুঝি বাবার আর ফুরালো না।

মাইলস্টোন কলেজের ভেতর বিমান বাহিনীর এটি জঙ্গিবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে; দগ্ধ ও আহত হয়েছে দেড় শতাধিক।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে যাদের চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল, এরমধ্যে রাত ৯টা পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। ৪৪ জন এখনও চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’ বলে জানানো হয়েছে।

তানভীরের বাবার মতো আরও অনেক স্বজন অপেক্ষায় রয়েছেন হাসপাতালে, যাদের প্রিয় শিশুটির চিকিৎসা চলছে ভেতরে।

রাত বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে স্বজনদের ভিড়ও। দুপুরের পর থেকেই নতুন নতুন রোগী আসছিল, এর সঙ্গে স্বজনরা এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন, আর তাদের সহায়তায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকরা সহায়তা করছিলেন।

প্রতিষ্ঠানটির ভিড় সামলাতে বিপুল পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। সামনের সড়ক সামলাতেও পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

বিকালের পর থেকেই জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের ভেতরে সংবাদকর্মী ও বাড়তি মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা হয়; প্রয়োজন ছাড়া কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।

 

নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

"ছোট ছেলেটার আগেই ছুটি হইছে, ওরে নিয়া আমি চইলা গেছি। আর বড়টারে খুঁজতে খুঁজতে আইসা পাইলাম লাশ।"

ক্লাস ক্যাপ্টেন তানভীর এখন শুধুই সংখ্যা

আপডেট সময় ০১:১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

 

স্কুল শেষে বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে বাড়তি ক্লাস করছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি মাধ্যমের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. তানভীর আহমেদ; কিন্তু মুহূর্তেই প্রাণচঞ্চল শিশুটি হয়ে পড়ে নিথর।

স্কুলে বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে মারা যাওয়া তানভীরের লাশ যখন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে রাখা, তাৎক্ষণিক তার পরিবারের কারও খোঁজ পাচ্ছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

বাসায় সন্তানের ফেরার অপেক্ষায় থাকা বাবা রুবেল হোসেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রথমেই স্কুলে ছুটে যান। সেখানে না পেয়ে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ নিতে থাকেন উত্তরার হাসপাতালগুলোতে।

খোঁজাখুজির পর রাত ৮টার দিকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে রুবেল খবর পান তার ছেলে আর নেই।

আইডি কার্ড দেখে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হলেও লাশ শনাক্ত করে হস্তান্তরের জন্য যখন হাসপাতালে ‘প্রয়োজনীয় কার্যক্রম’ চলছিল, তখন নিচে অপেক্ষমান বাবার কান্না স্বাভাবিকভাবেই থামছিল না।

কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হওয়া রুবেলকে শান্তনা দিতে গিয়ে তার ভাইও অশ্রু আটকে রাখতে পারছিলেন না।

তানভীরের বাবা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, “সে খুব মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল, ক্লাসে ক্যাপ্টেন ছিল। বাংলায় কথা বলত না, সবসময় ইংলিশে বলত।”

তিনি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে আহাজারি করছিলেন আর বলছিলেন, “খবর পাইয়া আমরা সব জায়গায় খুঁজছি, এরপর এইখানে আসছি। আমরা তো জানি না, আমার বাবাটা আর নাই।”

তার ছোট ছেলে তাসফিক একই স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলের ক্লাস শেষ হয় বেলা ১১টায়। এরপর তাকে নিয়ে বাসায় ফেরেন রুবেল।

তিনি বলেন, “তারও (তানভীর) ক্লাস শেষ হয়ে গেছিল। স্কলারসিপের জন্য এক্সট্রা ক্লাস করতেছিল। নয়তো সেও বাসায় চলে যেত।

“ছোট ছেলেটার আগেই ছুটি হইছে, ওরে নিয়া আমি চইলা গেছি। আর বড়টারে খুঁজতে খুঁজতে আইসা পাইলাম লাশ।”

 

 

তানভীরদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। ছেলেকে দাফন করবেন গ্রামেই। এই কথা বলতে বলতে রুবেল বলেন, “গত ঈদে সবাই বাড়ি গেছি। আজ ছেলের লাশ নিয়া যাইতে হইবো।”

সময় গড়ায়, রাত ৯টা নাগাদও ছেলের লাশের অপেক্ষায় ছিলেন বাবা রুবেল। যে ছেলের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন দুপুরেও, সে অপেক্ষা বুঝি বাবার আর ফুরালো না।

মাইলস্টোন কলেজের ভেতর বিমান বাহিনীর এটি জঙ্গিবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে; দগ্ধ ও আহত হয়েছে দেড় শতাধিক।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে যাদের চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল, এরমধ্যে রাত ৯টা পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। ৪৪ জন এখনও চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’ বলে জানানো হয়েছে।

তানভীরের বাবার মতো আরও অনেক স্বজন অপেক্ষায় রয়েছেন হাসপাতালে, যাদের প্রিয় শিশুটির চিকিৎসা চলছে ভেতরে।

রাত বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে স্বজনদের ভিড়ও। দুপুরের পর থেকেই নতুন নতুন রোগী আসছিল, এর সঙ্গে স্বজনরা এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন, আর তাদের সহায়তায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকরা সহায়তা করছিলেন।

প্রতিষ্ঠানটির ভিড় সামলাতে বিপুল পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। সামনের সড়ক সামলাতেও পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

বিকালের পর থেকেই জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের ভেতরে সংবাদকর্মী ও বাড়তি মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা হয়; প্রয়োজন ছাড়া কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।

 

নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম