১১:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
“সিসি ক্যামেরার জন্য গভর্মেন্টের টাকার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না, আমাদের দরকার- একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা,” বলেন আব্দুল আলীম।

ভোটের প্রস্তুতির আর ৫ মাস, নির্বিঘ্ন পরিবেশ কি হবে?

নিঝুম আহমেদ - জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০৮:০৭:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
  • / ৩২ বার পড়া হয়েছে

ফাইল ছবি

 

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের প্রস্তুতির জন্য বাকি রয়েছে মাত্র পাঁচ মাস; এর মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ কতটা উপযোগী হয়- সেদিকে নজর সবার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। আর ভোট আয়োজনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাই হবে ইসির চ্যালেঞ্জ। নিজেদের নিরপেক্ষ ভূমিকার পাশাপাশি ভোটের দায়িত্বে রাখতে হবে পক্ষপাতহীন কর্মকর্তাদের।

তারা বলছেন, জুলাই সনদের পাশাপাশি নির্বাচনি সব ধরনের আইনি সংস্কার শেষে দল ও অংশীজনের সংলাপ করে পুরোদমে দৃশ্যমান করতে হবে ভোটের কাজ। তাতে জনগণের মধ্যে নির্বিঘ্ন ভোটের পরিবেশ ও ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশাও প্রতিফলিত হবে।

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে চলছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আইনশৃঙ্খলা যে বিষয়টা, এটা তো কনসার্ন মিনিস্ট্রি দেখবে। আমরা যতটুক বুঝতেছি, তারা সিরিয়াস। ওরা মিটিং করছে- পত্রপত্রিকায় দেখতেছি। তাদের লাইনে কাজ আগাচ্ছে।”

যথাসময়ে নির্বাচনি পরিবেশ সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে তিনি মনে করেন।

ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এখন থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যাতে না ঘটে, সেজন্য বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

গত ৯ জুলাই নির্বাচন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সংক্রান্ত সভায় সরকারপ্রধান এসব নির্দেশনা দেন। তার এক গুচ্ছ নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য করণীয় অনুসন্ধান, ভোটকেন্দ্রকে সিসিটিভির আওতায় আনা।

ইসি বলছে, ভোট প্রস্তুতির ‘রুটিন’ কাজ হিসেবে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ হবে। আর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদে অনেক কিছুর সমাধান আসবে।

নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই জুলাই মাসে ঐকমত্যের যে বিষয়টা- এটাও তো একটা পর্যায়ে আসছে। বিভিন্ন পলিটিকাল পার্টির যে দাবি জুলাই ঘোষণা, সনদ- এগুলো সবকিছু মিলেই একটা জায়গায় ঘোষণাগুলো আসবে। আমার তো মনে হয় যে, ওটার মধ্যে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।”

নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনে এবার ‘দক্ষ’ কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করা হবে বলে জানিয়েছেন ইসি আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি এও বলেছেন, গত তিন নির্বাচনে সম্পৃক্ত ভোট কর্মকর্তাদের এবার নির্বাচনি দায়িত্বে রাখা হবে না।

“আমরা এটা সিরিয়াসলি দেখব। সিরিয়াসলি মানে অর্থাৎ ওদেরকে রাখা হবে না এবং অতীতে যাদের মোটামুটি এরকম প্রমাণ পাওয়া যায়, সেটার বিষয়েও দেখব।”

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার।

“আমরা আশা করি, সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যার ফলে নির্বাচনের জন্য একটা সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। …নির্বাচনের এখনও দেরি রয়েছে। সময় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো, উৎকর্ষের,” বলছিলেন বদিউল আলম।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে প্রয়োজন সমন্বিত নির্বাচনি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যার মধ্যে রয়েছে সিসিটিভি স্থাপন ও মনিটরিং।

তিনি বলেন, “এখন নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা দরকার। আমাদের সামনে কী কী রিস্ক আসতে পারে, কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, কী কী ঝুঁকি আসতে পারে- এই চ্যালেঞ্জগুলো আইডেন্টিফাই করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

“এখানে ইলেকশন কমিশন তো অবশ্যই লিডিং পজিশনে থাকবেন। সাথে অন্যান্য যে সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যত আছে, সবাইকে এটার সঙ্গে ইনভলব করে অ্যাসেসমেন্টটা করে তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”

বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত ও ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গঠিত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন আব্দুল আলীম।

এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন জুলাই মাস শেষ, হাতে আছে পাঁচ মাস।

“যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ রয়েছে- ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রিপারেশন শেষ করার। নিঃসন্দেহে এই পাঁচ মাসের মধ্যেই এই কাজগুলো সব শেষ করতে হবে। এগুলো মানুষকেও জানাতে হবে যে, আমরা সিসি ক্যামেরা বসাচ্ছি। তাহলে এক ধরনের ট্রাস্ট- যারা ভোটার, সাধারণ মানুষ; তাদের আস্থা থাকবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার উপরে।”

 

উপদেষ্টা পরিষদ কী বলছে

সবশেষ ১৩ জুলাই আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভোটের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়, যা বাস্তবায়ন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়, ইসি সচিবালয় ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

  • আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
  • মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ওসিদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে।
  • ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
  • জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুটি পৃথক প্রস্তুতিমূলক মহড়া পরিচালনা করবে।
  • জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঝুঁকিপূর্ণ সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের আসন্ন নির্বাচনে কোনো ধরনের দায়িত্ব প্রদান না করা।
  • সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যেন না ঘটে, সেজন্য নজরদারি জোরদার করতে হবে।
  • নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনপূর্ব এবং নির্বাচনকালীন সময়ে সব সংস্থাকে নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

 

সিসিটিভি কেন দরকার, কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, “আমার মনে হয়, এটার প্রয়োজন এই কারণেই- আমি বারবার যেটা বলছি, আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, নির্বাচনি নিরাপত্তা। আগামী নির্বাচনের জন্য একটা সমন্বিত নির্বাচনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার এবং এটা করতে গেলে সিসিটিভিটা লাগবে।”

‘ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র’র বিষয়টি নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছেন এ বিশ্লেষক।

“এখন যেহেতু একটা একটা পলিটিক্যাল পার্টি নেই (নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত থাকায় ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগও নেই), সুতরাং এই যে কোন কোন কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ; এগুলা নতুন করে অ্যাসেস করে তালিকা তৈরি করতে হবে। এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগবে।”

অতীতে সিটি করপোরেশন ও সংসদীয় আসনের ভোটে সিসিটিভি ব্যবহারের নজির রয়েছে।

আব্দুল আলীম বলেন, “নরমালি ইলেকশন কমিশন শুধু মনিটরিং করে। (ইসি) নিজের থেকে করে না কখনোই।

“(সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন) এটা নরমালি আউটসোর্সিং করা হয় এবং এটা নির্ভর করবে যে কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “খুবই কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন, এই কাজে যাদের অভিজ্ঞতা আছে ওরকম প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আউটসোর্সিং করে এবং খুব ভালো মানের ক্যামেরা লাগবে।

“এভাবে যদি করা হয়, তাহলে আমার কাছে মনে হয় না যে- কোনো ঝামেলা হবে এবং ইলেকশন কমিশন তো সচিবালয়ে বসে এইযে- যেসব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা থাকবে, সেটা যদি দেখতে পারে সেই মেকানিজমও রাখতে হবে। তাহলে আর কোনো অসুবিধা থাকার কথা না।”

প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের জন্য এবার কম-বেশি ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্র দরকার হতে পারে, যাতে দুই লাখের বেশি ভোটকক্ষ লাগবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আলীম বলেন, “যদি সম্ভব হয়- সব কেন্দ্রেই সিসি ক্যামেরা বসানো যেতে পারে। কারণ আমার কাছে আবার মনে হয় যে- সব কেন্দ্রেই কোনো না কোনো ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে। এখন তো গভর্মেন্টের বড় ফোকাসটা হচ্ছে নির্বাচন। প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন।

“সেক্ষেত্রে গভর্মেন্টের টাকার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। আমাদের দরকার, একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এটাই সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি এখন; যাতে করে কোনোভাবেই নির্বাচন নিয়ে কোনো রকমের সহিংসতা যেন না হয়।”

 

প্রস্তুতি নিয়ে কী বলছে ইসি

সংস্কার, আসনভিত্তিক ভোটার, ভোটকেন্দ্র, সীমানা নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার কাজ গোছানো, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটার পাশাপাশি দলের সঙ্গে সংলাপসহ নানা প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন সূচি রয়েছে ইসির।

নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “প্রস্তুতিমূলক যে কাজগুলো আমরা করে যাচ্ছি- ধরে নিন (আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে) আমরা প্রস্তুত।”

তিনি বলেন, আইন, বিধিমালা, নীতিমালাগুলো হয়ে আছে। নির্বনিনী মূল আইন আরপিও সংস্কার প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত। কোনোটাই যেন সংবিধান, আইন ও পরস্পরের সাংঘর্ষিক না হয়, সেই বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে।

নির্বাচনি প্রস্তুতির মধ্যে দলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে জানিয়ে আনোয়ারুল বলেন, “এ বসাটা আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের একটা রুটিন কাজের মধ্যে। সেই হিসাবে তো বসতে হবে।”

সিসিটিভি ব্যবহারের বিষয়টি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হতে পারে বলে মনে করেন এ নির্বাচন কমিশনার।

আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “সিসিটিভির যে বিষয়টা এটা যদি ল’ এনফোর্সিং এজেন্সির ব্যবহারের টুলস হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে এটা রক্ষণাবেক্ষণ, মেনটেইনেন্স-এভরিথিং ল’ এনফোর্সিং এজেন্সি তত্ত্বাবধানে না থাকলে পরে নির্বাচন কমিশন এটা মেইনটেন করবে কী করে?”

 

নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

নিউজটি শেয়ার করুন

“সিসি ক্যামেরার জন্য গভর্মেন্টের টাকার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না, আমাদের দরকার- একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা,” বলেন আব্দুল আলীম।

ভোটের প্রস্তুতির আর ৫ মাস, নির্বিঘ্ন পরিবেশ কি হবে?

আপডেট সময় ০৮:০৭:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

 

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের প্রস্তুতির জন্য বাকি রয়েছে মাত্র পাঁচ মাস; এর মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ কতটা উপযোগী হয়- সেদিকে নজর সবার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। আর ভোট আয়োজনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাই হবে ইসির চ্যালেঞ্জ। নিজেদের নিরপেক্ষ ভূমিকার পাশাপাশি ভোটের দায়িত্বে রাখতে হবে পক্ষপাতহীন কর্মকর্তাদের।

তারা বলছেন, জুলাই সনদের পাশাপাশি নির্বাচনি সব ধরনের আইনি সংস্কার শেষে দল ও অংশীজনের সংলাপ করে পুরোদমে দৃশ্যমান করতে হবে ভোটের কাজ। তাতে জনগণের মধ্যে নির্বিঘ্ন ভোটের পরিবেশ ও ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশাও প্রতিফলিত হবে।

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে চলছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আইনশৃঙ্খলা যে বিষয়টা, এটা তো কনসার্ন মিনিস্ট্রি দেখবে। আমরা যতটুক বুঝতেছি, তারা সিরিয়াস। ওরা মিটিং করছে- পত্রপত্রিকায় দেখতেছি। তাদের লাইনে কাজ আগাচ্ছে।”

যথাসময়ে নির্বাচনি পরিবেশ সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে তিনি মনে করেন।

ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এখন থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যাতে না ঘটে, সেজন্য বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

গত ৯ জুলাই নির্বাচন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সংক্রান্ত সভায় সরকারপ্রধান এসব নির্দেশনা দেন। তার এক গুচ্ছ নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য করণীয় অনুসন্ধান, ভোটকেন্দ্রকে সিসিটিভির আওতায় আনা।

ইসি বলছে, ভোট প্রস্তুতির ‘রুটিন’ কাজ হিসেবে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ হবে। আর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদে অনেক কিছুর সমাধান আসবে।

নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই জুলাই মাসে ঐকমত্যের যে বিষয়টা- এটাও তো একটা পর্যায়ে আসছে। বিভিন্ন পলিটিকাল পার্টির যে দাবি জুলাই ঘোষণা, সনদ- এগুলো সবকিছু মিলেই একটা জায়গায় ঘোষণাগুলো আসবে। আমার তো মনে হয় যে, ওটার মধ্যে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।”

নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনে এবার ‘দক্ষ’ কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করা হবে বলে জানিয়েছেন ইসি আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি এও বলেছেন, গত তিন নির্বাচনে সম্পৃক্ত ভোট কর্মকর্তাদের এবার নির্বাচনি দায়িত্বে রাখা হবে না।

“আমরা এটা সিরিয়াসলি দেখব। সিরিয়াসলি মানে অর্থাৎ ওদেরকে রাখা হবে না এবং অতীতে যাদের মোটামুটি এরকম প্রমাণ পাওয়া যায়, সেটার বিষয়েও দেখব।”

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার।

“আমরা আশা করি, সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যার ফলে নির্বাচনের জন্য একটা সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। …নির্বাচনের এখনও দেরি রয়েছে। সময় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো, উৎকর্ষের,” বলছিলেন বদিউল আলম।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে প্রয়োজন সমন্বিত নির্বাচনি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যার মধ্যে রয়েছে সিসিটিভি স্থাপন ও মনিটরিং।

তিনি বলেন, “এখন নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা দরকার। আমাদের সামনে কী কী রিস্ক আসতে পারে, কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, কী কী ঝুঁকি আসতে পারে- এই চ্যালেঞ্জগুলো আইডেন্টিফাই করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

“এখানে ইলেকশন কমিশন তো অবশ্যই লিডিং পজিশনে থাকবেন। সাথে অন্যান্য যে সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যত আছে, সবাইকে এটার সঙ্গে ইনভলব করে অ্যাসেসমেন্টটা করে তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”

বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত ও ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গঠিত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন আব্দুল আলীম।

এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন জুলাই মাস শেষ, হাতে আছে পাঁচ মাস।

“যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ রয়েছে- ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রিপারেশন শেষ করার। নিঃসন্দেহে এই পাঁচ মাসের মধ্যেই এই কাজগুলো সব শেষ করতে হবে। এগুলো মানুষকেও জানাতে হবে যে, আমরা সিসি ক্যামেরা বসাচ্ছি। তাহলে এক ধরনের ট্রাস্ট- যারা ভোটার, সাধারণ মানুষ; তাদের আস্থা থাকবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার উপরে।”

 

উপদেষ্টা পরিষদ কী বলছে

সবশেষ ১৩ জুলাই আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভোটের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়, যা বাস্তবায়ন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়, ইসি সচিবালয় ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

  • আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
  • মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ওসিদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে।
  • ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
  • জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুটি পৃথক প্রস্তুতিমূলক মহড়া পরিচালনা করবে।
  • জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঝুঁকিপূর্ণ সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের আসন্ন নির্বাচনে কোনো ধরনের দায়িত্ব প্রদান না করা।
  • সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যেন না ঘটে, সেজন্য নজরদারি জোরদার করতে হবে।
  • নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনপূর্ব এবং নির্বাচনকালীন সময়ে সব সংস্থাকে নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

 

সিসিটিভি কেন দরকার, কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, “আমার মনে হয়, এটার প্রয়োজন এই কারণেই- আমি বারবার যেটা বলছি, আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, নির্বাচনি নিরাপত্তা। আগামী নির্বাচনের জন্য একটা সমন্বিত নির্বাচনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার এবং এটা করতে গেলে সিসিটিভিটা লাগবে।”

‘ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র’র বিষয়টি নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছেন এ বিশ্লেষক।

“এখন যেহেতু একটা একটা পলিটিক্যাল পার্টি নেই (নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত থাকায় ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগও নেই), সুতরাং এই যে কোন কোন কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ; এগুলা নতুন করে অ্যাসেস করে তালিকা তৈরি করতে হবে। এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগবে।”

অতীতে সিটি করপোরেশন ও সংসদীয় আসনের ভোটে সিসিটিভি ব্যবহারের নজির রয়েছে।

আব্দুল আলীম বলেন, “নরমালি ইলেকশন কমিশন শুধু মনিটরিং করে। (ইসি) নিজের থেকে করে না কখনোই।

“(সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন) এটা নরমালি আউটসোর্সিং করা হয় এবং এটা নির্ভর করবে যে কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “খুবই কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন, এই কাজে যাদের অভিজ্ঞতা আছে ওরকম প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আউটসোর্সিং করে এবং খুব ভালো মানের ক্যামেরা লাগবে।

“এভাবে যদি করা হয়, তাহলে আমার কাছে মনে হয় না যে- কোনো ঝামেলা হবে এবং ইলেকশন কমিশন তো সচিবালয়ে বসে এইযে- যেসব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা থাকবে, সেটা যদি দেখতে পারে সেই মেকানিজমও রাখতে হবে। তাহলে আর কোনো অসুবিধা থাকার কথা না।”

প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের জন্য এবার কম-বেশি ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্র দরকার হতে পারে, যাতে দুই লাখের বেশি ভোটকক্ষ লাগবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আলীম বলেন, “যদি সম্ভব হয়- সব কেন্দ্রেই সিসি ক্যামেরা বসানো যেতে পারে। কারণ আমার কাছে আবার মনে হয় যে- সব কেন্দ্রেই কোনো না কোনো ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে। এখন তো গভর্মেন্টের বড় ফোকাসটা হচ্ছে নির্বাচন। প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন।

“সেক্ষেত্রে গভর্মেন্টের টাকার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। আমাদের দরকার, একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এটাই সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি এখন; যাতে করে কোনোভাবেই নির্বাচন নিয়ে কোনো রকমের সহিংসতা যেন না হয়।”

 

প্রস্তুতি নিয়ে কী বলছে ইসি

সংস্কার, আসনভিত্তিক ভোটার, ভোটকেন্দ্র, সীমানা নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার কাজ গোছানো, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটার পাশাপাশি দলের সঙ্গে সংলাপসহ নানা প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন সূচি রয়েছে ইসির।

নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “প্রস্তুতিমূলক যে কাজগুলো আমরা করে যাচ্ছি- ধরে নিন (আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে) আমরা প্রস্তুত।”

তিনি বলেন, আইন, বিধিমালা, নীতিমালাগুলো হয়ে আছে। নির্বনিনী মূল আইন আরপিও সংস্কার প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত। কোনোটাই যেন সংবিধান, আইন ও পরস্পরের সাংঘর্ষিক না হয়, সেই বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে।

নির্বাচনি প্রস্তুতির মধ্যে দলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে জানিয়ে আনোয়ারুল বলেন, “এ বসাটা আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের একটা রুটিন কাজের মধ্যে। সেই হিসাবে তো বসতে হবে।”

সিসিটিভি ব্যবহারের বিষয়টি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হতে পারে বলে মনে করেন এ নির্বাচন কমিশনার।

আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “সিসিটিভির যে বিষয়টা এটা যদি ল’ এনফোর্সিং এজেন্সির ব্যবহারের টুলস হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে এটা রক্ষণাবেক্ষণ, মেনটেইনেন্স-এভরিথিং ল’ এনফোর্সিং এজেন্সি তত্ত্বাবধানে না থাকলে পরে নির্বাচন কমিশন এটা মেইনটেন করবে কী করে?”

 

নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম