অতীতের অভিযোগ নিয়ে ডিজিএফআইয়ের সাবেক এই কর্মকর্তার ভাষ্য, তিনি নিজে থেকে কিছু করেননি, সরকারি চাকুরে হিসেবে ‘দায়িত্ব পালন’ করেছেন।
জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ, কে এই অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফিজুর রহমান

- আপডেট সময় ১২:৫৪:২০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫
- / ৪৪ বার পড়া হয়েছে
কর্মীদের একটি অংশের পাল্টা সম্পাদকীয় বোর্ড গঠনের মধ্য দিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগের মধ্যে সামনে এসেছে একটি নাম, যে নাম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সাংবাদিক মহলে নানা কারণে আলোচনায় ছিল।
আফিজুর রহমান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। বিস্ময়করভাবে প্রায় ১১ বছর তার কাজের জায়গা ছিল প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআই।
সেই দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংবাদমাধ্যমে হস্তক্ষেপ, সাংবাদিকদের ডিজিএফআই কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ‘হয়রানি ও চাপ প্রয়োগ’, কোনো প্রতিবেদন কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিপক্ষে গেলে ‘হুমকি-ধামকি দেওয়া’, এমনকি সাংবাদিক সমিতির নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে প্রার্থীদের বসিয়ে দেওয়ার মত বহু অভিযোগ সে সময় ওঠে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পাঁচ বছর বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন আফিজ।
সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর তিনি নাফিজ সরাফাতের পত্রিকা দৈনিক বাংলার নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এখন তিনি গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চিফ অপারেটিং অফিসার।
জনকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খানের অভিযোগ, গত শনিবার ‘ষড়যন্ত্র করে মব সৃষ্টি করে’ দখল করা হয়েছে জনকণ্ঠ ভবন। আর এর পেছনের ‘মূল ব্যক্তি’ হলেন আফিজুর রহমান।
জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত অতিকুল্লাহ খান মাসুদের স্ত্রী শামীমা বলছেন, আফিজই পুরনোদের বাদ দিয়ে পত্রিকায় নতুন লোকজন এনেছেন এবং তারা ‘ষড়যন্ত্র করে পত্রিকা দখল’ করেছেন।
আর অতীতের অভিযোগ নিয়ে তার ভাষ্য, তিনি নিজে থেকে কিছু করেননি, সরকারি চাকুরে হিসেবে ‘দায়িত্ব পালন’ করেছেন।
কী ধরনের সরকারি দায়িত্ব আফিজ পালন করতেন?
এশিয়ান এজের সম্পাদক শোয়েব চৌধুরীকে ২০১৯ সালে ডিজিএফআই কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। কেন তিনি তার পত্রিকায় আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ দুই ব্যাংক চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত ও নজরুল ইসলাম মজুমদারকে নিয়ে লিখেছেন, সেজন্য শাসিয়ে দেওয়া হয়।
“আফিজ ডিজিএফআইয়ে পক্ষ থেকে এসব যোগাযোগ করত। ডিজিএফআইয়ের রেফারেন্স দিয়ে নিউজ সেন্সর করা, চাপ দেওয়া–এসব করত। আফিজই এসব কোঅডিনেট করতো। শুধু আমার না, প্রায় প্রত্যেকটা মিডিয়ায় এসব করত।”
জনকণ্ঠ কাণ্ডের পর এক এক্স পোস্টে আফিজের মাধ্যমে ‘হেনস্তার শিকার হওয়ার’ অতীত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন বাংলা আউটলুকের সাংবাদিক মুক্তাদীর রশীদ রোমিও।
তিনি লিখেছেন, “শেখ হাসিনার আমলে মেজর আফিজ ডিজিএফআইতে থাকার সময় আমাকে বারংবার জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে হেনস্তারের প্রধান সমন্বয়ক। সব অফিসে আমাকে ব্লক করার জন্য সেই নির্দেশনা দিত। তাকে সাথে নিয়ে NCP নেতা শিশির জনকন্ঠ পত্রিকা দখল নিয়েছে।”
আফিজ যখন ডিজিএফআইয়ে দায়িত্বরত, তখন থেকেই পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা সাংবাদিকদের মধ্যে আলোচনার বিষয় ছিল।
নাফিজ সরাফাতের ‘স্বার্থ রক্ষার’ জন্য সাংবাদিকদের ফোন করে হুমকি দেওয়া এবং ডিজিএফআই কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে হেনস্তা করার বহু অভিযোগ সেসময় ওঠে। কিন্তু বোধগম্য কারণেই সে সময় বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলতে পারেননি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে কোনো কোনো প্রার্থীকে ‘বসিয়ে’ দিতে চাপ প্রয়োগ এবং কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে ‘প্রভাব খাটানোর’ অভিযোগও সে সময় ওঠে।
ইত্তেফাকের সাংবাদিক সাইদুর রহমান এক ফেইসবুক পোস্টে শেখ হাসিনার সঙ্গে আফিজের একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, “বিগত আওয়ামী লীগের আমলে তিনি দৈনিক বাংলা, নিউজবাংলা২৪-এর নির্বাহী ভূমিকা পালন করছেন। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সমন্বয়কারী হিসেবেও কর্মরত। গোপালগঞ্জের পৈতৃক বাড়ির অধিবাসী ও পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফতের ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মেজর (অব.) আফিজুর রহমান।
“তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), জাতীয় প্রেস ক্লাব নির্বাচনে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপকারী। গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে সকাল-বিকাল প্রার্থীদের হয়রানী করতেন। রাতে তার অনুসারি সাংবাদিকদের নিয়ে করতেন বিশেষ পার্টি। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন এই আফিজের নেতৃত্বে বর্তমানে জনকন্ঠ সংস্কার কার্যক্রম চলিতেছে।”
নানা অভিযোগের কারণে আফিজকে একবার ডিজিএফআই থেকে সরানো হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের এক মন্ত্রীর তদবিরে পরে তাকে ফের ওই গোয়েন্দা সংস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। তবে পরে তাকে অবসরে পাঠানো হয়।
সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে নাফিজ সরাফাতের কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন সাবেক মেজর আফিজ।
নাফিজ সরাফাত ছিলেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। আর ওই বোর্ডের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন আরাফাত। আফিজ ওই ইউনিভার্সিটির প্রধান সমন্বয়ক, ডাইরেক্টর (অ্যাডমিশন, মার্কেটিং ও স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স) হিসেবে চাকরি নেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন নাফিজ সরাফাতের পত্রিকা দৈনিক বাংলার নির্বাহী পরিচালক।
গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সখ্য ছিল আফিজের, এমনকি খোদ শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছবিও পত্রিকায় এসেছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে এবং পরে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের আগে আগে জুলাই মাসে সম্পাদকদের একটি অংশের সঙ্গে যে দুটি বৈঠক শেখ হাসিনা করেছিলেন, সেখানেও আফিজ উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পিএইচডি গবেষণাও শুরু করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আফিজ। বিষয়টি নিয়ে সে সময় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি ‘বঙ্গবন্ধু গবেষক’ হিসেবে তিনি বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও করেছেন।
সেই আফিজের বিরুদ্ধে ‘জনকণ্ঠ দখলে’ ভূমিকা রাখার অভিযোগ ওঠায় ফেইসবুকে হতাশা প্রকাশ করেছেন হামজা রহমান নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী, যিনি সরকার পতনের পর লন্ডনে চলে গেছেন।
আফিজ অবশ্য দাবি করছেন, সেনাবাহিনীর চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি যা করেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশেই’ করেছেন। তার কাজ ছিল শুধু ‘সমন্বয়’ করা।
সে সময় সাংবাদিকদের হেনস্তার অভিযোগ অস্বীকার করে আফিজ বলেন, “ডিজিএফআইতে দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর চাকরির সুবাদের বরং সাংবাদিকদের সাথে আমার একটা সুসম্পর্ক হয়েছে এবং এটা এখনো আছে।”
তিনি দাবি করেন, ডিআরইউর নির্বাচনের প্রভাব বিস্তার ‘কখনোই হয়নি’।
“প্রার্থিতা নিয়ে যে কথা উঠেছে, সেটা শুধু অথরিটির নির্দেশে সমন্বয় করার দায়িত্ব ছিল আমার। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হেলাল স্যারও (প্রয়াত ইহসানুল করিম) এটাতে যুক্ত ছিলেন।”
অফিজ বলছেন, ডিজিএফআইয়ে ১১ বছর দায়িত্ব পালনের মাঝে একবার তাকে জাতিসংঘ শন্তি মিশনে পাঠানো হয়েছিল। ফেরার পর তাকে আগের জায়গাতেই পোস্টিং দেওয়া হয়।
নাফিজ সরাফাত বা তার কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবির বিষয়ে আফিজের ভাষ্য, “মিডিয়া ট্রায়াল যেটা হয়, বিশেষ করে সোশাল মিডিয়া ট্রায়াল যেটা হয়, মূল জিনিস না জেনে ভেরিফাই না করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছবি দিয়ে… এটা প্রফেশনাল নয়।”
‘যাচাই না করেই’ এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে দাবি করে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “মিস কমিউনিকেশন হচ্ছে। না জেনেই অনেকে অনেক কিছু বলছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্লিয়ার হলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।”
জনকণ্ঠের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করলে আফিজ বলেন, গত সপ্তাহে তার মা হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ফলে গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে ঢাকায় আনা, হাসপাতালে ছোটাছুটি–এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি সেদিকে ‘নজর দিতে পারেননি’।
তবে এক পর্যায়ে জনকণ্ঠের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সম্পাদকের ছোট ছেলেকে দায়ী করে আফিজ বলেন, সাতজনের চাকরি চলে যাওয়ার কারণে ‘মূল সমস্যা’ তৈরি হয়।
“এটা সম্পাদকের মিথ্যাচার। এর সাথে আমি কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নই। শনিবার ছুটি, রোববার থেকে অফিসে যাচ্ছি না। অফিসের গাড়ি ব্যবহার করছি না আর। চাকরি ছেড়ে দেব।”
নিঝুম আহমেদ – জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম