বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের গোপন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কীভাবে ‘ম্যাডাম’ নামে পরিচিত কিছু নারী মাত্র ১৩ বছর বয়সী শিশুদের পর্যন্ত যৌনকর্মে জড়াতে বাধ্য করছেন।
গোপন ক্যামেরায় উঠে এল কেনিয়ায় শিশুদের দিয়ে যৌন-বাণিজ্য

- আপডেট সময় ০১:০৭:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫
- / ৫২ বার পড়া হয়েছে
কেনিয়ার রিফট ভ্যালির ব্যস্ত ট্রানজিট শহর মাই-মাহিউ। কেনিয়ার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত এই শহরের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ছুটে চলে—পণ্য আর যাত্রী নিয়ে এগিয়ে যায় উগান্ডা, রুয়ান্ডা, দক্ষিণ সুদান কিংবা কঙ্গোর দিকে।
শহরটির অবস্থান নাইরোবি থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবহন শহর আগে যৌন ব্যবসার জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন সেখানে যৌন বাণিজ্যের ভয়াল ছোবলে পড়ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুরাও।
বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের গোপন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। ‘ম্যাডাম’ নামে পরিচিত কিছু নারী মাত্র ১৩ বছর বয়সী শিশুদের পর্যন্ত যৌনকর্মে জড়াতে বাধ্য করছেন।
এ বছরের শুরুতে ছদ্মবেশে যৌনকর্মী সেজে যৌন ব্যবসার চক্রে ঢুকে পড়েছিলেন বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের দুই অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তারা এমন ভান করেছিলেন, যেন তারা শিখতে চান কীভাবে ‘ম্যাডাম’ হওয়া যায়।
এই দুই অনুসন্ধানকারী গোপনে কিছু ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওতে অন্য দুইজন নারীকে কথা বলতে শোনা যায়। তারা বলছিলেন, এটা বেআইনি কাজ তা তারা জানেন।
এরপর ওই দুই নারী বিবিসি-র অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সঙ্গে যৌন পেশায় জড়িত কয়েকজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের পরিচয় করিয়ে দেন।
বিবিসি ওইসব গোপন ভিডিও এবং সব তথ্য প্রমাণ গত মার্চে কেনিয়ার পুলিশকে দেয়। বিবিসি-র ধারণা, এরপর ‘ম্যাডামরা’ জায়গা বদলেছেন। পুলিশ বলছে, যেসব নারী ও মেয়েদেরকে ভিডিওতে দেখা গেছে তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। কেনিয়ায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া বিরল ঘটনা। মামলায় জিততে হলে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট শিশুর সাক্ষ্য লাগে। কিন্তু শিশুরা প্রায় সময়ই আদালতে সাক্ষ্য দিতে ভয় পায়।
‘ওরা এখনও শিশু, মিষ্টি দিলেই ভোলানো যায়’:
বিবিসি-র অন্ধকারের মধ্যে গোপনে ধারণ করা ঝাপসা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এক নারী নিজেকে ন্যামবুরা নামে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হেসে বলছেন, “তারা তো এখনও শিশু। তাই একটু মিষ্টি দিলেই সহজে ভোলানো যায়।”
ন্যামবুরার সঙ্গে চেপতু নামের আরেক নারী কীভাবে অল্পবয়সী মেয়েদের এই পেশায় যুক্ত করছেন তা উঠে এসেছে গোপন ক্যামেরায়। ন্যামবুরা স্বীকার করেন, তার অধীনে ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে ছয় মাস ধরে কাজ করছে।
তিনি বলেন, “মাই মাহিউতে যৌনবৃত্তি অনেকটা নগদ ফসলের মতো। ট্রাকচালকরা এর মূল চালিকাশক্তি। আমরা সেখান থেকেই লাভবান হই। মাই মাহিউতে এটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের নিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ন্যামবুরা বলেন, “আপনি তাদেরকে শহরে প্রকাশ্যে আনতে পারবেন না। আমি কেবল গভীর রাতে, চুপিচুপি তাদেরকে বাইরে নিয়ে আসি।”
অন্যদিকে চেপতু জানান, অল্পবয়সী মেয়েরা তাকে ভালো আয় এনে দেয়। তিনি বলেন, এই মেয়েগুলোর জন্য কিছু নিয়মিত খদ্দেরও তৈরি হয়েছে।
এক ক্লাবে চেপতু বিবিসি অনুসন্ধানী সাংবাদিকের সঙ্গে চারজন কিশোরীকে পরিচয় করিয়ে দেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটজনের বয়স ১৩ বছর। বাকিরা তাদের বয়স ১৫ বলে জানায়।
তাদের একজন সাংবাদিককে জানায়, দিনে গড়ে পাঁচজন খদ্দেরের সঙ্গে তাকে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা হয়। খদ্দেররা অনেক সময় এমন সব কাজ করতে বাধ্য করে যা অকল্পনীয়।
কেনিয়ার আইন কী বলছে:
কেনিয়ার জাতীয় আইনে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের নিজ সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক করাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। যদিও অনেক পৌরসভায় স্থানীয় আইন অনুযায়ী, এটি নিষিদ্ধ। কিন্তু নাকুরু কাউন্টির অন্তর্ভুক্ত মাই মাহিউ শহরে এটি নিষিদ্ধ নয়।
তবে কেনিয়ার দণ্ডবিধি অনুযায়ী অবশ্য যৌনবৃত্তির আয় দিয়ে জীবন যাপন করা বেআইনি। তা সেই ব্যক্তি যৌনকর্মী বা দালাল যা-ই হোক না কেন। ১৮ বছরের কমবয়সী শিশুকে যৌন বাণিজ্যের জন্য বিক্রি বা পাচার করার অপরাধে ১০ বছর থেকে শুরু করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
তবে কেনিয়ার বাস্তবতা হচ্ছে, শিশু যৌন নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা বাড়লেও, বিচার পর্যন্ত পৌঁছানোর নজির খুবই কম। অধিকাংশ মামলাই সাক্ষ্যের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
পরিসংখ্যান কী বলছে:
কেনিয়ায় কতজন শিশুকে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কেনিয়ায় প্রায় ৩০ হাজার শিশু ‘দেহ ব্যবসায়’ জড়িত।
২০২২ সালে স্থানীয় এক এনজিও ‘গ্লোবাল ফান্ড টু অ্যান্ড মডার্ন স্লেভারি’ এক প্রতিবেদনে কিলিফি ও কোয়ালে অঞ্চলে আড়াই হাজার শিশুকে যৌন পেশায় বাধ্য করার তথ্য প্রকাশ করে।
মাই মাহিউ শহরে ঠিক কতজন শিশুকে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের এই ছোট্ট শহরে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া সহজ।
বেবি গার্ল:
কেনিয়ার এই অন্ধকার জগতের মধ্যে কিছুটা আলোর নাম ‘বেবি গার্ল’ নামে পরিচিত এক সাবেক যৌনকর্মী। ৪০ বছর যৌনপেশায় কাটিয়ে এখন ৬১ বছর বয়সে মাই-মাহিউ শহরে একটি ছোট আশ্রয়কেন্দ্র চালান তিনি।
মাই মাহিউ শহরে যৌন নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা মেয়েদের আশ্রয় ও সহায়তা দেন এই বেবি গার্ল। তার আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা চার কিশোরী বিবিসি-কে জানিয়েছে, কীভাবে তারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, আর এখন কীভাবে তারা চেষ্টা করছে নতুন করে বাঁচার।
বেবি গার্ল তাদের শেখাচ্ছেন বিউটি পারলারের কাজ ও ফটোগ্রাফি। তবে মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে চলা এই কার্যক্রমের তহবিল সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বেবি গার্ল বলেন, “এই মেয়েরা এখনও অরক্ষিত। তারা নিজে নিজে কীভাবে টিকে থাকবে? এখনও তারা ক্ষত কাটিয়ে উঠছে।” তার তত্ত্বাবধানে থাকা লিলিয়ান নামে এক কিশোরী এখন ফটোগ্রাফি শিখছে।
লিলিয়ান বলেন, “আমি এখন আর ভয় পাই না। কারণ, বেবি গার্ল আমাদের পাশে আছেন। তিনি আমাদের অতীতকে কবর দিতে সাহায্য করছেন।”
সূত্র : বিবিসি আফ্রিকা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম