০৬:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
ডা. রোকাইয়া খাতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য কখনও আবেদন করেননি। তিনি মনে করেন সময়ের প্রয়োজনেই তখন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে যুক্ত থাকা প্রয়োজন ছিল। ওই কর্তব্যটিই পালন করেছেন মাত্র।

১৯৭১: কাকরাইলে স্তূপ করা ছিল মানুষের মাথার খুলিগুলো

সালেক খোকন - লেখক , গবেষক
  • আপডেট সময় ০২:২৮:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩২ বার পড়া হয়েছে

রশীদ তালুকদারের তোলা একাত্তরের ছবিটিতে মাঝের লাইনের পেছনের দিকে ডা. রোকাইয়া খাতুন।

 

আমার বড় মামা কলকাতায় স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ওই কারণে ছোটবেলায় মা আমাদের ঘুম পাড়াতেন ক্ষুদিরামের গান গেয়ে— ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…’। বুঝিয়েও দিতেন ক্ষুদিরাম কে, ব্রিটিশরা কি অত্যাচার করেছে, নীল চাষ না করলে চাষিদের আঙ্গুল কেটে দেয়ার ঘটনা—এসব গল্পের মতো মায়ের মুখেই শুনেছি। ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ভিত্তিটা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে যায়।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলন চলছে তখন। একপর্যায়ে মিছিলে গুলি চলে। তখন আসাদ শহীদ হন। ওই মিছিলে ছিলাম আমি, ক্লাসমেট নেলী আর ফওজিয়া মোসলেম। সাধারণত মেয়েরা মিছিলের সামনে আর পেছনে থাকত ছেলেরা। কিন্তু ওইদিন নেতারা আমাদেরকে সামনে দেয়নি। বরং নেতারাই মিছিলের সামনে গেলেন। আমাদের দিলেন পেছনে।

মিছিলটা ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেইটের সামনে এলেই পুলিশ গুলি চালায়। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আসাদ। তার লাশ পুলিশ নিতে চাইল। কিন্তু তার আগেই ছাত্ররা সরিয়ে নিলো। পরে আসাদের লাশ নিয়েই আমরা মিছিল করেছি।

এরপর তো আইয়ুব খানের পতন হলো। ইয়াহিয়া খান বসল পাকিস্তানের গদিতে। তিনি নির্বাচনের ঘোষণাও দিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝাতাম। বলতাম, বাঙালি জাতির নিপীড়ন ও পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। মানুষ কিন্তু বুঝত। মুসলিম লীগের লোকদের বাড়িতেও যেতাম। কথা শুনে তারা দূর-দূর করে বের করে দিত। ওইসময় স্বাধীনতাবিরোধী যারা ছিল তাদের হৃদয়ে এখনও জাগ্রত রয়েছে পাকিস্তান।

একাত্তর-পূর্ববর্তী আন্দোলনের ঘটনাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন ডা. রোকাইয়া খাতুন। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে নানা প্রসঙ্গে। আব্দুল মইদার ও মনুজা খাতুনের বড় সন্তান রোকাইয়া খাতুন। বাবা ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার সূর্যকান্তি গ্রামে।

বাবার বদলিজনিত চাকরির কারণেই রোকাইয়াদেরও থাকতে হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়। ফলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি পাকিস্তানের কোহাটে, সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলে। পরে তিনি পঞ্চম শ্রেুণি পর্যন্ত পড়েন সেন্ট পেন্ট্রিক এস স্কুল করাচিতে। এসএসসি পাশ করেন প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট হাই স্কুল, পেশোয়ার থেকে। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ)। ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

 

ডা. রোকাইয়া খাতুন, ছবি: সালেক খোকন।  ডা. রোকাইয়া খাতুন, ছবি: সালেক খোকন।

 

ওই সময়ের কথা উঠতেই রোকাইয়া বললেন যেভাবে, “আমাদের বুকের ওপর দিয়েই গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন এক বছর হয়, যখন পরীক্ষা হবে তখনই এসএম হলে পাঁচপাত্তুর খুন হয়। মোনায়েম খানের গুন্ডাবাহিনী এনএসএফ-এর নেতা ছিল পাঁচপাত্তুর, খোকা প্রমুখ। ওরা হঠাৎ খোলা জিপে দলবলসহ হকস্টিক নিয়ে এসে ভাঙচুর করত। কমন রুমের কাঁচ ভেঙে চলে যেত। কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে টর্চার করত। পাঁচপাত্তুর খুন হওয়ায় সবাই খুব খুশি হয়েছিল।

ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তখন। ইপসু মতিয়া গ্রুপে ছিলাম। ১৯৬৯-এর জানুয়ারির দিকে শুরু হয় ১১ দফা আন্দোলন। তখন সর্বদলীয় পরিষদ করা হয়েছিল। বটতলায় মিটিং শেষে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় লালবাগ স্কুলের। ওখানে গিয়ে টিফিন টাইমে ঢুকে মেয়েদের এগার দফা বোঝানোই ছিল কাজ। কেন ১১ দফা, ১১ দফা বলতে কী বোঝায়— ছাত্রদের দাবিগুলো বোঝাতাম। ওদের প্রশ্নের উত্তরও দিতাম।

আমরা স্কুলে টিফিন টাইমে যেতাম, স্কুল টিচাররা দেখত কিন্তু কখনও বাধা দিত না। শিক্ষকরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন না। প্রতিদিন শহীদ মিনার থেকে মিছিল বের হতো। সেটা চানখারপুল হয়ে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কে গিয়ে শেষ হতো। এভাবে সকল আন্দোলনেই যুক্ত ছিলাম।”

সত্তরের নির্বাচন হলো। সবাই আশাবাদী পাওয়ার এখন ট্রান্সফার হবে শেখ মুজিবের কাছে। কিন্তু সেটি আর হলো না। দেশ এগোয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার পথে। রোকাইয়ার ভাষায়, “২১ ফেরুয়ারি ১৯৭১। ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টি একটা লিফলেট বিতরণ করে। সেখানে বলা ছিল, যেভাবে সংগ্রামটা এগোচ্ছে এটা স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিতে পারে এবং সশস্ত্র সংগ্রামও হতে পারে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ছোটবোন হামিদাকে নিয়ে যাই রেসকোর্স ময়দানে। আর্ট কলেজের উল্টোদিকের গেট দিয়ে ঢুকি আমরা। মঞ্চের খুব কাছে বসার আলাদা জায়গা ছিল মেয়েদের। গোটা মাঠে লোকে লোকারণ্য। সবার হাতে হাতে বাঁশের লাঠি। পাকিস্তানি একটা হেলিকপ্টারও ওপর দিয়ে চলে যায়। ওরা কি গুলি করবে? কিছুটা ভয়েও ছিলাম আমরা। পাকিস্তানি শোষণের পুরো প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধু ভাষণে তুলে ধরেন। শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখনই পরিষ্কার হয়ে যাই আমাদের কী করতে হবে!”

 

কী করলেন তখন?

তিনি বলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। ডামি রাইফেলে ১০ দিনের ট্রেনিং করান মুজিবুর রহমান। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, ইউটিসি ট্রেন্ড ছিলেন। রোকেয়া কবির, নেলী, রাকাসহ আমরা ২৯ জন ছাত্রী সেখানে ট্রেনিং নিই। পরে ঢাকার রাজপথে ডামি রাইফেল হাতে মার্চপাস্টও করেছি।

এরপরই বলা হলো পাড়ায় পাড়ায় নারীদেরও ট্রেনিং করাতে হবে। আমার দায়িত্ব পড়ে খিলগাঁও চৌধুরী পাড়া পলিমা সংসদের পাশের এলাকা। সত্তরে জাতীয় মহিলা পরিষদ গঠনের পরপরই যুক্ত হই। চৌধুরী পাড়ায় এর একটা ব্রাঞ্চ করার জন্য তখন পরিচয় ঘটে ছন্দার আম্মার সঙ্গে। পরে তার মাধ্যমেই আমরা সেখানে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করি। ২৫-৩০ জন নারীকে একত্রিত করে ট্রেনিং করাই পলিমা সংসদের মাঠে।

বাবাও তখন এয়ারফোর্স থেকে সবেমাত্র রিটায়ার্ড করেছেন। স্থানীয়দের অনুরোধে তিনিও পশ্চিম মালিবাগ ডিআইটি মাঠে অনেক লোককেই ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করিয়েছেন।”

১ মার্চ ১৯৭১। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। ৩ মার্চ ছিল অধিবেশন বসার দিন। খবরটা শুনেই সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ওইদিন মহিলারাও হাতের কাছে যা পেয়েছে খুনতি, বাঁশ, লাঠি নিয়েই রাজপথে নেমেছিল।

রোকাইয়া যেমন দেখেছেন, “বিশ্বাস করবেন না তখন কেউ বলেও দেয়নি যে এমনটা করো। আমার আম্মাও আমাদেরকে বের করে দিছে। আম্মা বলে-যা যা মিছিলে যা। ছোটবোন রিতার বয়স তখন সাত। সে তার চেয়েও বড় একটা বাঁশ নিয়ে বের হয়েছিল। ৩ মার্চ সবাই মৌচাকের সামনে যখন মিছিল নিয়ে আসি তখনই গুলি চলে। খুব সামনে ছিল আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র ফারুক। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে সে মারা যায়।”

২৫ মার্চ ১৯৭১। খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় নারীদের ট্রেনিং মনিটরিং করতে আসেন আয়শা খানম আর কমরেড ফরহাদের স্ত্রী রিনা খান। সন্ধ্যা হয় হয় তখন। তিনজন লোক এসে তাদেরকে বললেন, আপনারা হলে ফিরে যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর আলোচনা ভেঙ্গে গেছে। পরিস্থিতি এখন ভালো না। হলে গিয়ে হল ভ্যাকেন্ট করেন।

দ্রুত একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে হলের দিকে যায় সবাই। রোকাইয়া চলে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। হোস্টেলে যারা ছিল তাদের বাড়ি চলে যেতে বলেন। অতঃপর রাতেই একটা রিকশায় হল থেকে বাড়ির দিকে ফেরেন।

তার ভাষায়, “কাছাকাছি এসেই দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড। আব্বাসহ আওয়ামী লীগের লোকজন মালিবাগের ছেলেদের নিয়ে রাস্তা কাটছে। কেন? সবাই বলছে পাকিস্তানি আর্মি মুভ করতে পারে। তারা যেন ইজিলি আসতে না পারে সেজন্যই ব্যারিকড দেয়া।

রাত ১২টার পর চারিদিকে গুলির আওয়াজ। আমাদের মলিবাগের বাসাটা তখন টিনশেড। আব্বা বললেন টিন তো ফুটা হতে পারে। সবাই ডাইনিংয়ে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের নিচে জড়ো হও। আমরা তাই করি। সারা রাত গুলিবর্ষণ হয়। মনে হচ্ছিল বৃষ্টির মতো গুলি পড়ছে।

বাতি জ্বালানো যাবে না। তাই টিপ টিপ আলোয় হারিকেন জ্বলছে। একটা রেডিও ছিল। হঠাৎ একটা ঘোষণা শুনলাম, ‘লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম ইজ ডেড। হিজ বডি ইজ লাইং উইথ আস’। এটা আসলে ওরা ওয়্যারলেসে ট্রান্সমিট করছিল। যা রেডিও মিডিয়ামে ধরা পড়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র আমলার আসামী ছিলেন মোয়াজ্জেম। খবরটি শুনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থার কথা চিন্তা করে আতঙ্ক বোধ করি আমরা।

সারারাত কাটে নানা শংকায়। সকালে মেইন রোডে টহলে ছিল পাকিস্তান আর্মি। দূরে আগুনের ধোয়া দেখা যাচ্ছিল। পরে খবর আসে নয়া বাজারে কাঠের দোকান পুড়িয়ে দিছে ওরা। ২৭ মার্চ সকালে ২ ঘটার জন্য কারফিউ তুলে নেয় আর্মিরা। তখনই চলে যাই পুরান পল্টন, বড় মামা আব্দুল মান্নানের বাড়িতে।”

রোকাইয়াদের পরিবার এরপর চলে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখান থেকে চেষ্টা করেন ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাওয়ার। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় অক্টোবরে তিনি ঢাকায় ফিলে আসেন।

তিনি বলেন যান বাকি ইতিহাস। “মেডিকেলের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তখন। ক্লাস না করলে পিছিয়ে যাব—আম্মাকে রাজি করালাম এই কথা বলে। আম্মার স্কুলফ্রেন্ড ছিলেন আমিন বক্স চাচা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগে চাকরি করতেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকা তার পরিবারের সঙ্গেই মা আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেন।

খালাত ভাই খন্দকার মুনীরুজ্জামান (দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, এখন প্রয়াত) পরে আমার জীবন-সহচর হন। তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ২০ অক্টোবর শান্তিনগরে খালার বাড়িতে গেলে দেখা হয় মনির সঙ্গে। সে মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিল। ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে। একদিন থেকেই সে আবার চলে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে শুধু বলল, ‘আমার জন্য অপেক্ষা করবা’। আমার প্রতি তার যে ভালোবাসাটা ছিল সেদিন সে তা প্রকাশ করে যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। কেউ বেঁচে থাকব কিনা তাও জানি না। তবুও ওইদিনটি মনের ভেতর অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল।”

 

স্বামী খন্দকার মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে রোকাইয়া খাতুন, ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।  স্বামী খন্দকার মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে রোকাইয়া খাতুন, ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।

 

রোকাইয়া নানাভাবে সহযোগী হন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে।

 

কীভাবে?

তিনি বলেন এভাবে, “পুরান পল্টন মামার বাড়িতে থাকি তখন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমাদের দেখাশোনা করতেন ইপসুর নির্মল দা। তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগযোগ হতো নিয়মিত। তিনিই বলতেন টাকা তোলো, কাপড় চোপড় পেলে রাখো। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা আর কাপড় তুলেছি।

ঢাকা মেডিকেলেও যাই একদিন। তখনই দুটো লাশ আসে সেখানে। দেখেই আঁতকে উঠি। ডা. কবির আর ডা. আজহারের লাশ। নটরডেম কলেজের পাশে কাঠেরপুলের নিচে তাদের মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল।

মেডিকেলে তখন দুটো সংগঠন ছিল— অভিযাত্রী আর অগ্রগামী। অগ্রগামী থেকেই একটা গ্রুপ বের হয়ে ইপসু গড়ে। এটা মতিয়া গ্রুপ। আর মেমন গ্রুপ থেকে যায় অগ্রগামী নামেই। কবির ভাই ছিলেন অগ্রগামীর প্রেসিডেন্ট। আমরা তাদের লাশ দেখলাম। বীভৎস সে চেহারা। জিহবা বের হওয়া। খুব খারাপ লাগছে দেখে। বুকের ভেতর প্রতিশোধের আগুনও জ্বলে ওঠে।

ডিসেম্বর তখন। সম্মুখ যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান আর্মিসহ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার কাছাকাছি চলে আসছে। নির্মল দা খবর পাঠালে ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেলে যাই। ওইদিন দেখা হয় ক্লাসমেট সিরাজের সঙ্গে। সে অগ্রগামীর সেক্রেটারি ছিল।

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা আহত হলে সিরাজের কাছে খবর আসত। সে তখন ডা. রাব্বী স্যারকে গোপনে পাঠিয়ে দিতেন চিকিৎসার জন্য। ওইদিন ডা. রাব্বী স্যারের সঙ্গেও শেষ দেখাটা হয়। আমাকে দেখেই বললেন, ‘তুমি লেডিস হোস্টেলে চলে আসো। ওটা সেইফ। আমিও চলে আসব সেখানে’।

কিন্তু সেটা তো আর হলো না। ১৫ ডিসেম্বর সিরাজ আর রাব্বী স্যারকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি।

ওইদিন নির্মল দা বললেন তুমি হলি ফ্যামিলি হাসাপাতালে চলে আসো। স্ট্রিট ফাইট হবে। ঢাকার অলিগলিতে লড়াই চলবে। অনেকে হতাহত হবে। ওখানে আমরা যা পারি করব।

১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ছিলাম হলি ফ্যামিলিতে। ১৬ ডিসেম্বর গোটা ঢাকা শহর একেবারেই চুপচাপ। শব্দ নাই কোনো। সন্ধ্যার পর হঠাৎ প্রায় ৩০-৩৫ জন আহত আসে হাসপাতালে। সেখানে ইন্ডিয়ান আর্মির এক কর্নেল, কিছু সেনা আর সাধারণ মানুষ ছিল। এরা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমরা দৌড়ে গিয়ে পরিষ্কার করে স্টিচ করলাম। কর্নেল সাহেবকে ওটিতে নিয়ে অপারেশন করে গুলি বের করে আনা হয়। পাক সেনাদের সঙ্গে গোলাগুলিতে তারা গুলিবিদ্ধ হন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে আমরা কিছুটা অবদান রাখতে পেরেছি।”

এরপর ঢাকার পরিস্থিতি কেমন দেখেছেন?

রোকাইয়ার বলেন, “১৭ ডিসেম্বর হলি ফ্যামিলি থেকে বের হয়ে রিকশায় রওনা হই ঢাকা মেডিকেলের দিকে। কাকরাইল মসজিদের কাছে এসে দেখলাম স্তুপ করে রাখা হয়েছে মানুষের মাথার অনেক খুলি। দেখে খুব খারাপ লাগছে।

হাইকোর্টের মাজারের পাশে যখন গেলাম তখন দেখি মুক্তিযোদ্ধারা প্লাটুন-ওয়াইজ যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। রিকশা থেকে নেমে একটা প্লাটুনের সাথে যুক্ত হলাম। শহীদ মিনারে গিয়ে পেলাম পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের। মাহবুব জামাল, রফিক প্রমুখ শহীদ মিনারের ওপর উঠে ছবি তুলল। দশ টাকার নোটের ওপর আছে ওই ছবিটা। স্বাধীনতার আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলিও করে।”

ডা. রোকাইয়া খাতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য কখনও আবেদন করেননি। তিনি মনে করেন সময়ের প্রয়োজনেই তখন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে যুক্ত থাকা প্রয়োজন ছিল। ওই কর্তব্যটিই পালন করেছেন মাত্র।

জাতীয় মহিলা পরিষদে ডা. রোকাইয়া খাতুন এখনও কাজ করছেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এদেশের মানুষের জন্যই কাজ করে যেতে চান তিনি।

প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা ডা. রোকাইয়া খাতুনের। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, “শোনেন, এই যে নতুন প্রজন্ম। একাত্তরের দিকে এরা আসবেই। এটা আমি বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই ওরা উদ্বুদ্ধ হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমি বুঝি ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। এক ছাতার নিচে আমরা বাস করব। এটাই আমাদের বাংলাদেশ।”

 

 

সালেক খোকন – লেখক , গবেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

ডা. রোকাইয়া খাতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য কখনও আবেদন করেননি। তিনি মনে করেন সময়ের প্রয়োজনেই তখন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে যুক্ত থাকা প্রয়োজন ছিল। ওই কর্তব্যটিই পালন করেছেন মাত্র।

১৯৭১: কাকরাইলে স্তূপ করা ছিল মানুষের মাথার খুলিগুলো

আপডেট সময় ০২:২৮:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

 

আমার বড় মামা কলকাতায় স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ওই কারণে ছোটবেলায় মা আমাদের ঘুম পাড়াতেন ক্ষুদিরামের গান গেয়ে— ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…’। বুঝিয়েও দিতেন ক্ষুদিরাম কে, ব্রিটিশরা কি অত্যাচার করেছে, নীল চাষ না করলে চাষিদের আঙ্গুল কেটে দেয়ার ঘটনা—এসব গল্পের মতো মায়ের মুখেই শুনেছি। ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ভিত্তিটা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে যায়।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলন চলছে তখন। একপর্যায়ে মিছিলে গুলি চলে। তখন আসাদ শহীদ হন। ওই মিছিলে ছিলাম আমি, ক্লাসমেট নেলী আর ফওজিয়া মোসলেম। সাধারণত মেয়েরা মিছিলের সামনে আর পেছনে থাকত ছেলেরা। কিন্তু ওইদিন নেতারা আমাদেরকে সামনে দেয়নি। বরং নেতারাই মিছিলের সামনে গেলেন। আমাদের দিলেন পেছনে।

মিছিলটা ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেইটের সামনে এলেই পুলিশ গুলি চালায়। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আসাদ। তার লাশ পুলিশ নিতে চাইল। কিন্তু তার আগেই ছাত্ররা সরিয়ে নিলো। পরে আসাদের লাশ নিয়েই আমরা মিছিল করেছি।

এরপর তো আইয়ুব খানের পতন হলো। ইয়াহিয়া খান বসল পাকিস্তানের গদিতে। তিনি নির্বাচনের ঘোষণাও দিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝাতাম। বলতাম, বাঙালি জাতির নিপীড়ন ও পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। মানুষ কিন্তু বুঝত। মুসলিম লীগের লোকদের বাড়িতেও যেতাম। কথা শুনে তারা দূর-দূর করে বের করে দিত। ওইসময় স্বাধীনতাবিরোধী যারা ছিল তাদের হৃদয়ে এখনও জাগ্রত রয়েছে পাকিস্তান।

একাত্তর-পূর্ববর্তী আন্দোলনের ঘটনাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন ডা. রোকাইয়া খাতুন। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে নানা প্রসঙ্গে। আব্দুল মইদার ও মনুজা খাতুনের বড় সন্তান রোকাইয়া খাতুন। বাবা ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার সূর্যকান্তি গ্রামে।

বাবার বদলিজনিত চাকরির কারণেই রোকাইয়াদেরও থাকতে হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়। ফলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি পাকিস্তানের কোহাটে, সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলে। পরে তিনি পঞ্চম শ্রেুণি পর্যন্ত পড়েন সেন্ট পেন্ট্রিক এস স্কুল করাচিতে। এসএসসি পাশ করেন প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট হাই স্কুল, পেশোয়ার থেকে। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ)। ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

 

ডা. রোকাইয়া খাতুন, ছবি: সালেক খোকন।  ডা. রোকাইয়া খাতুন, ছবি: সালেক খোকন।

 

ওই সময়ের কথা উঠতেই রোকাইয়া বললেন যেভাবে, “আমাদের বুকের ওপর দিয়েই গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন এক বছর হয়, যখন পরীক্ষা হবে তখনই এসএম হলে পাঁচপাত্তুর খুন হয়। মোনায়েম খানের গুন্ডাবাহিনী এনএসএফ-এর নেতা ছিল পাঁচপাত্তুর, খোকা প্রমুখ। ওরা হঠাৎ খোলা জিপে দলবলসহ হকস্টিক নিয়ে এসে ভাঙচুর করত। কমন রুমের কাঁচ ভেঙে চলে যেত। কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে টর্চার করত। পাঁচপাত্তুর খুন হওয়ায় সবাই খুব খুশি হয়েছিল।

ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তখন। ইপসু মতিয়া গ্রুপে ছিলাম। ১৯৬৯-এর জানুয়ারির দিকে শুরু হয় ১১ দফা আন্দোলন। তখন সর্বদলীয় পরিষদ করা হয়েছিল। বটতলায় মিটিং শেষে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় লালবাগ স্কুলের। ওখানে গিয়ে টিফিন টাইমে ঢুকে মেয়েদের এগার দফা বোঝানোই ছিল কাজ। কেন ১১ দফা, ১১ দফা বলতে কী বোঝায়— ছাত্রদের দাবিগুলো বোঝাতাম। ওদের প্রশ্নের উত্তরও দিতাম।

আমরা স্কুলে টিফিন টাইমে যেতাম, স্কুল টিচাররা দেখত কিন্তু কখনও বাধা দিত না। শিক্ষকরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন না। প্রতিদিন শহীদ মিনার থেকে মিছিল বের হতো। সেটা চানখারপুল হয়ে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কে গিয়ে শেষ হতো। এভাবে সকল আন্দোলনেই যুক্ত ছিলাম।”

সত্তরের নির্বাচন হলো। সবাই আশাবাদী পাওয়ার এখন ট্রান্সফার হবে শেখ মুজিবের কাছে। কিন্তু সেটি আর হলো না। দেশ এগোয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার পথে। রোকাইয়ার ভাষায়, “২১ ফেরুয়ারি ১৯৭১। ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টি একটা লিফলেট বিতরণ করে। সেখানে বলা ছিল, যেভাবে সংগ্রামটা এগোচ্ছে এটা স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিতে পারে এবং সশস্ত্র সংগ্রামও হতে পারে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ছোটবোন হামিদাকে নিয়ে যাই রেসকোর্স ময়দানে। আর্ট কলেজের উল্টোদিকের গেট দিয়ে ঢুকি আমরা। মঞ্চের খুব কাছে বসার আলাদা জায়গা ছিল মেয়েদের। গোটা মাঠে লোকে লোকারণ্য। সবার হাতে হাতে বাঁশের লাঠি। পাকিস্তানি একটা হেলিকপ্টারও ওপর দিয়ে চলে যায়। ওরা কি গুলি করবে? কিছুটা ভয়েও ছিলাম আমরা। পাকিস্তানি শোষণের পুরো প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধু ভাষণে তুলে ধরেন। শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখনই পরিষ্কার হয়ে যাই আমাদের কী করতে হবে!”

 

কী করলেন তখন?

তিনি বলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। ডামি রাইফেলে ১০ দিনের ট্রেনিং করান মুজিবুর রহমান। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, ইউটিসি ট্রেন্ড ছিলেন। রোকেয়া কবির, নেলী, রাকাসহ আমরা ২৯ জন ছাত্রী সেখানে ট্রেনিং নিই। পরে ঢাকার রাজপথে ডামি রাইফেল হাতে মার্চপাস্টও করেছি।

এরপরই বলা হলো পাড়ায় পাড়ায় নারীদেরও ট্রেনিং করাতে হবে। আমার দায়িত্ব পড়ে খিলগাঁও চৌধুরী পাড়া পলিমা সংসদের পাশের এলাকা। সত্তরে জাতীয় মহিলা পরিষদ গঠনের পরপরই যুক্ত হই। চৌধুরী পাড়ায় এর একটা ব্রাঞ্চ করার জন্য তখন পরিচয় ঘটে ছন্দার আম্মার সঙ্গে। পরে তার মাধ্যমেই আমরা সেখানে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করি। ২৫-৩০ জন নারীকে একত্রিত করে ট্রেনিং করাই পলিমা সংসদের মাঠে।

বাবাও তখন এয়ারফোর্স থেকে সবেমাত্র রিটায়ার্ড করেছেন। স্থানীয়দের অনুরোধে তিনিও পশ্চিম মালিবাগ ডিআইটি মাঠে অনেক লোককেই ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করিয়েছেন।”

১ মার্চ ১৯৭১। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। ৩ মার্চ ছিল অধিবেশন বসার দিন। খবরটা শুনেই সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ওইদিন মহিলারাও হাতের কাছে যা পেয়েছে খুনতি, বাঁশ, লাঠি নিয়েই রাজপথে নেমেছিল।

রোকাইয়া যেমন দেখেছেন, “বিশ্বাস করবেন না তখন কেউ বলেও দেয়নি যে এমনটা করো। আমার আম্মাও আমাদেরকে বের করে দিছে। আম্মা বলে-যা যা মিছিলে যা। ছোটবোন রিতার বয়স তখন সাত। সে তার চেয়েও বড় একটা বাঁশ নিয়ে বের হয়েছিল। ৩ মার্চ সবাই মৌচাকের সামনে যখন মিছিল নিয়ে আসি তখনই গুলি চলে। খুব সামনে ছিল আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র ফারুক। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে সে মারা যায়।”

২৫ মার্চ ১৯৭১। খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় নারীদের ট্রেনিং মনিটরিং করতে আসেন আয়শা খানম আর কমরেড ফরহাদের স্ত্রী রিনা খান। সন্ধ্যা হয় হয় তখন। তিনজন লোক এসে তাদেরকে বললেন, আপনারা হলে ফিরে যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর আলোচনা ভেঙ্গে গেছে। পরিস্থিতি এখন ভালো না। হলে গিয়ে হল ভ্যাকেন্ট করেন।

দ্রুত একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে হলের দিকে যায় সবাই। রোকাইয়া চলে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। হোস্টেলে যারা ছিল তাদের বাড়ি চলে যেতে বলেন। অতঃপর রাতেই একটা রিকশায় হল থেকে বাড়ির দিকে ফেরেন।

তার ভাষায়, “কাছাকাছি এসেই দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড। আব্বাসহ আওয়ামী লীগের লোকজন মালিবাগের ছেলেদের নিয়ে রাস্তা কাটছে। কেন? সবাই বলছে পাকিস্তানি আর্মি মুভ করতে পারে। তারা যেন ইজিলি আসতে না পারে সেজন্যই ব্যারিকড দেয়া।

রাত ১২টার পর চারিদিকে গুলির আওয়াজ। আমাদের মলিবাগের বাসাটা তখন টিনশেড। আব্বা বললেন টিন তো ফুটা হতে পারে। সবাই ডাইনিংয়ে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের নিচে জড়ো হও। আমরা তাই করি। সারা রাত গুলিবর্ষণ হয়। মনে হচ্ছিল বৃষ্টির মতো গুলি পড়ছে।

বাতি জ্বালানো যাবে না। তাই টিপ টিপ আলোয় হারিকেন জ্বলছে। একটা রেডিও ছিল। হঠাৎ একটা ঘোষণা শুনলাম, ‘লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম ইজ ডেড। হিজ বডি ইজ লাইং উইথ আস’। এটা আসলে ওরা ওয়্যারলেসে ট্রান্সমিট করছিল। যা রেডিও মিডিয়ামে ধরা পড়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র আমলার আসামী ছিলেন মোয়াজ্জেম। খবরটি শুনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থার কথা চিন্তা করে আতঙ্ক বোধ করি আমরা।

সারারাত কাটে নানা শংকায়। সকালে মেইন রোডে টহলে ছিল পাকিস্তান আর্মি। দূরে আগুনের ধোয়া দেখা যাচ্ছিল। পরে খবর আসে নয়া বাজারে কাঠের দোকান পুড়িয়ে দিছে ওরা। ২৭ মার্চ সকালে ২ ঘটার জন্য কারফিউ তুলে নেয় আর্মিরা। তখনই চলে যাই পুরান পল্টন, বড় মামা আব্দুল মান্নানের বাড়িতে।”

রোকাইয়াদের পরিবার এরপর চলে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখান থেকে চেষ্টা করেন ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাওয়ার। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় অক্টোবরে তিনি ঢাকায় ফিলে আসেন।

তিনি বলেন যান বাকি ইতিহাস। “মেডিকেলের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তখন। ক্লাস না করলে পিছিয়ে যাব—আম্মাকে রাজি করালাম এই কথা বলে। আম্মার স্কুলফ্রেন্ড ছিলেন আমিন বক্স চাচা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগে চাকরি করতেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকা তার পরিবারের সঙ্গেই মা আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেন।

খালাত ভাই খন্দকার মুনীরুজ্জামান (দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, এখন প্রয়াত) পরে আমার জীবন-সহচর হন। তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ২০ অক্টোবর শান্তিনগরে খালার বাড়িতে গেলে দেখা হয় মনির সঙ্গে। সে মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিল। ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে। একদিন থেকেই সে আবার চলে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে শুধু বলল, ‘আমার জন্য অপেক্ষা করবা’। আমার প্রতি তার যে ভালোবাসাটা ছিল সেদিন সে তা প্রকাশ করে যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। কেউ বেঁচে থাকব কিনা তাও জানি না। তবুও ওইদিনটি মনের ভেতর অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল।”

 

স্বামী খন্দকার মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে রোকাইয়া খাতুন, ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।  স্বামী খন্দকার মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে রোকাইয়া খাতুন, ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।

 

রোকাইয়া নানাভাবে সহযোগী হন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে।

 

কীভাবে?

তিনি বলেন এভাবে, “পুরান পল্টন মামার বাড়িতে থাকি তখন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমাদের দেখাশোনা করতেন ইপসুর নির্মল দা। তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগযোগ হতো নিয়মিত। তিনিই বলতেন টাকা তোলো, কাপড় চোপড় পেলে রাখো। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা আর কাপড় তুলেছি।

ঢাকা মেডিকেলেও যাই একদিন। তখনই দুটো লাশ আসে সেখানে। দেখেই আঁতকে উঠি। ডা. কবির আর ডা. আজহারের লাশ। নটরডেম কলেজের পাশে কাঠেরপুলের নিচে তাদের মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল।

মেডিকেলে তখন দুটো সংগঠন ছিল— অভিযাত্রী আর অগ্রগামী। অগ্রগামী থেকেই একটা গ্রুপ বের হয়ে ইপসু গড়ে। এটা মতিয়া গ্রুপ। আর মেমন গ্রুপ থেকে যায় অগ্রগামী নামেই। কবির ভাই ছিলেন অগ্রগামীর প্রেসিডেন্ট। আমরা তাদের লাশ দেখলাম। বীভৎস সে চেহারা। জিহবা বের হওয়া। খুব খারাপ লাগছে দেখে। বুকের ভেতর প্রতিশোধের আগুনও জ্বলে ওঠে।

ডিসেম্বর তখন। সম্মুখ যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান আর্মিসহ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার কাছাকাছি চলে আসছে। নির্মল দা খবর পাঠালে ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেলে যাই। ওইদিন দেখা হয় ক্লাসমেট সিরাজের সঙ্গে। সে অগ্রগামীর সেক্রেটারি ছিল।

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা আহত হলে সিরাজের কাছে খবর আসত। সে তখন ডা. রাব্বী স্যারকে গোপনে পাঠিয়ে দিতেন চিকিৎসার জন্য। ওইদিন ডা. রাব্বী স্যারের সঙ্গেও শেষ দেখাটা হয়। আমাকে দেখেই বললেন, ‘তুমি লেডিস হোস্টেলে চলে আসো। ওটা সেইফ। আমিও চলে আসব সেখানে’।

কিন্তু সেটা তো আর হলো না। ১৫ ডিসেম্বর সিরাজ আর রাব্বী স্যারকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি।

ওইদিন নির্মল দা বললেন তুমি হলি ফ্যামিলি হাসাপাতালে চলে আসো। স্ট্রিট ফাইট হবে। ঢাকার অলিগলিতে লড়াই চলবে। অনেকে হতাহত হবে। ওখানে আমরা যা পারি করব।

১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ছিলাম হলি ফ্যামিলিতে। ১৬ ডিসেম্বর গোটা ঢাকা শহর একেবারেই চুপচাপ। শব্দ নাই কোনো। সন্ধ্যার পর হঠাৎ প্রায় ৩০-৩৫ জন আহত আসে হাসপাতালে। সেখানে ইন্ডিয়ান আর্মির এক কর্নেল, কিছু সেনা আর সাধারণ মানুষ ছিল। এরা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমরা দৌড়ে গিয়ে পরিষ্কার করে স্টিচ করলাম। কর্নেল সাহেবকে ওটিতে নিয়ে অপারেশন করে গুলি বের করে আনা হয়। পাক সেনাদের সঙ্গে গোলাগুলিতে তারা গুলিবিদ্ধ হন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে আমরা কিছুটা অবদান রাখতে পেরেছি।”

এরপর ঢাকার পরিস্থিতি কেমন দেখেছেন?

রোকাইয়ার বলেন, “১৭ ডিসেম্বর হলি ফ্যামিলি থেকে বের হয়ে রিকশায় রওনা হই ঢাকা মেডিকেলের দিকে। কাকরাইল মসজিদের কাছে এসে দেখলাম স্তুপ করে রাখা হয়েছে মানুষের মাথার অনেক খুলি। দেখে খুব খারাপ লাগছে।

হাইকোর্টের মাজারের পাশে যখন গেলাম তখন দেখি মুক্তিযোদ্ধারা প্লাটুন-ওয়াইজ যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। রিকশা থেকে নেমে একটা প্লাটুনের সাথে যুক্ত হলাম। শহীদ মিনারে গিয়ে পেলাম পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের। মাহবুব জামাল, রফিক প্রমুখ শহীদ মিনারের ওপর উঠে ছবি তুলল। দশ টাকার নোটের ওপর আছে ওই ছবিটা। স্বাধীনতার আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলিও করে।”

ডা. রোকাইয়া খাতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য কখনও আবেদন করেননি। তিনি মনে করেন সময়ের প্রয়োজনেই তখন মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে যুক্ত থাকা প্রয়োজন ছিল। ওই কর্তব্যটিই পালন করেছেন মাত্র।

জাতীয় মহিলা পরিষদে ডা. রোকাইয়া খাতুন এখনও কাজ করছেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এদেশের মানুষের জন্যই কাজ করে যেতে চান তিনি।

প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা ডা. রোকাইয়া খাতুনের। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, “শোনেন, এই যে নতুন প্রজন্ম। একাত্তরের দিকে এরা আসবেই। এটা আমি বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই ওরা উদ্বুদ্ধ হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমি বুঝি ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। এক ছাতার নিচে আমরা বাস করব। এটাই আমাদের বাংলাদেশ।”

 

 

সালেক খোকন – লেখক , গবেষক।