এখন যারা ভিন্নমত পোষণ করেন বা ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরেন, তাদের ওপর হামলা চালায় ‘মব’। রাষ্ট্র এখন আর নিজ হাতে দমন করে না বরং ‘সামাজিক শাস্তি’র পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
মবের মুখে সাংবাদিকতা, রাষ্ট্র কোথায়?

- আপডেট সময় ০৪:২৪:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
- / ৪৫ বার পড়া হয়েছে
৭ অগাস্ট, ২০২৫। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গাজীপুরে দুজন সাংবাদিক হামলার শিকার হন। বিকেল সাড়ে ৩টায় সাহাপাড়ায় ‘চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায়’ দৈনিক বাংলাদেশের আলোর সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে মব সৃষ্টি করে’ ইট-পাথর দিয়ে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেয় পুলিশের সামনেই। অন্যদিকে রাত সাড়ে ৮টায় চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রকাশ্যে এক ব্যক্তির ওপর হামলা-কোপানোর ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিক তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তথ্য দিচ্ছে পুলিশ। দুটি ঘটনাই ঘটেছে জনসমক্ষে, পুলিশের নীরব উপস্থিতিতে এবং দুটি ঘটনার ভিডিওই ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এগুলো নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর মাত্র একদিন আগে ৬ অগাস্ট ঢাকায় ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: অভিযোগ নিষ্পত্তি ও স্বনিয়ন্ত্রণের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। ওই সংলাপে কয়েকজনের বক্তব্যে যে অভিমত উঠে আসে তা হলো, প্রতিবেদন পক্ষে গেলে সাংবাদিকতা ‘মুক্ত’ থাকে, বিপক্ষে গেলে ‘মবের’ অথবা উশৃঙ্খল জনতার শিকার হতে হয়। বক্তারা উল্লেখ করেন, আজকের বাংলাদেশে সাংবাদিকতা মানেই ঝুঁকির মধ্যে সত্য প্রকাশ করা, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গাজীপুরে দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা যেন এই কথারই হাতেনাতে প্রমাণ।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। একসময় সরকার গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল বা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওই কৌশল বদলেছে। এখন যারা ভিন্নমত পোষণ করেন বা ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরেন, তাদের ওপর সরাসরি হামলা চালায় সংঘবদ্ধ এক ‘মব’। রাষ্ট্র এখন আর নিজ হাতে দমন করে না, বরং সামাজিক শাস্তির পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগাস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত হত্যা মামলার পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্টতায় আসামি করা হয়েছে এবং তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনের সময় হামলায় নিহত হয়েছেন। এছাড়া ২৪ জন সংবাদকর্মী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাপ্রধান বরখাস্ত হয়েছেন, সম্ভবত ১৫০ জন সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং ১৬৭ জনের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে (টিআইবি, ২০২৫)।
এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, এটি একটি প্রবণতার ইঙ্গিত। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন আর রাষ্ট্রের হাতে বন্দী নয় বরং এক সহিংস ‘মব সংস্কৃতি’র কবলে। সরকার এর বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে নীরবতা পালন করছে, যা পরোক্ষ মদদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। তবে এই সহিংসতা বা ‘মব’-নির্ভর শাস্তির সংস্কৃতির দায় শুধু সরকারের নয়। এর জন্য সমানভাবে দায়ী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত যারা ২০২৪ সালের অগাস্টের অভ্যুত্থানের পর নিজেদের রাজনৈতিক সুযোগ ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে গিয়ে সাংবাদিকদের ওপর প্রকাশ্যে সহিংস আচরণ করেছে।
আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন কাভার করতে যাওয়া একাধিক সাংবাদিককে ছাত্রনেতারা হুমকি দিয়েছেন, অপমান করেছেন, এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। বিশেষত, শাহবাগ, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থানে পছন্দ না হওয়া রিপোর্ট করার দায়ে সাংবাদিকদের ঘেরাও, ধাক্কাধাক্কি ও সামাজিকভাবে লজ্জিত করার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে পুলিশও কখনও কখনও পাশে থাকলেও নীরব ছিল।
এই ঘটনাগুলোর দায় কেবল হামলাকারী ব্যক্তির নয়, এটি রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের ফল। যারা নিজেদের রাজনীতিকে জনগণের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বলে দাবি করে, তাদের হাতেই যখন সাংবাদিকরা হেনস্তার শিকার হন, তখন সেটি কেবল দ্বিচারিতা নয়, ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতেরও ইঙ্গিত দেয়।
এখন যে সাংবাদিকতার পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, তা শুধু রাষ্ট্রীয় দমননীতির ফল নয় বরং রাজনৈতিক মিত্র, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ও ক্ষমতালোভীদের নির্মিত এক সহিংস সাংস্কৃতিক পরিবেশের ফল। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে কেবল প্রশাসনিক নিরাপত্তা নয়, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা, মব-সচেতনতা ও মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে হবে।