শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পর বাংলাদেশ এখন নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, রাজনৈতিক সমীকরণ ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ—সব মিলিয়ে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কি?
গণঅভ্যুত্থানের পর সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্ন

- আপডেট সময় ১২:১৬:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫
- / ৪৯ বার পড়া হয়েছে
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারীদের সমর্থনে গঠিত সরকারেরও এক বছর পূর্ণ হলো। এ দুই দিবস ঘিরে ফেলে আসা সময়টার কিছু পর্যালোচনা হয়েছে স্বভাবতই। কোন প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছিল এবং তারপর এতে অংশগ্রহণকারী দল ও অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার দিকগুলো আলোচিত হয়েছে। এ সময়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কী ভূমিকায় ছিল, তা নিয়ে অবশ্য আলোচনা হয়েছে কম। তাদেরও তো এক বছর অতিক্রান্ত হলো। আওয়ামী লীগ নিজেও কি মূল্যায়ন করেছে ঘটনাবহুল এ সময়টার?
যাহোক, হাসিনা সরকার পতনের প্রথম বার্ষিকীতে জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীনসরকারের প্রধান উপদেষ্টা। মাঝে বহুল আলোচিত লন্ডন বৈঠক থেকে যে খবর মিলেছিল– দেখা যাচ্ছে, সে অনুযায়ীই নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন তিনি। ফেব্রুয়ারিতে, রোজা শুরুর আগেই হতে যাচ্ছে প্রত্যাশিত নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) প্রধান উপদেষ্টার অফিসের চিঠি পেয়ে বলেছে, ডিসেম্বরের শুরুতেই তফসিল ঘোষিত হবে। এর আগে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত এবং বিধিবিধান সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় কাজ তারা সম্পন্ন করবেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের কিছু সুপারিশ রয়েছে। ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ সেগুলো বাস্তবায়নের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কিছু বিষয়ে খোদ ইসির আপত্তির খবর অবশ্য মিলেছিল। এ সবকিছুরই একটা গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি করে এগোতে হবে।
ইতোমধ্যে এটা অবশ্য স্পষ্ট, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তাদের ‘কার্যক্রম’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দলটিও বিচারের সম্মুখীন। এর নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও দলটি এতে অংশ নিতো বলে মনে হয় না। ক্ষমতাচ্যুতির পর গোটা পরিবেশ তার প্রতিকূলে। দেশে তারা কার্যত অনুপস্থিত। পলাতক বললেও ভুল হবে না। সম্ভাব্য এ পরিণতির কথা অনেকে মনে করিয়ে দিতে চাইলেও তারা এর পরোয়া করতেন না। এখন সে অভিজ্ঞতাই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তারপরও দলের কোনো পর্যায় থেকে আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধির দেখা মিলছে না। অনুশোচনা অনুপস্থিত। থেকে থেকে গণঅভ্যুত্থানকারীদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের কথাই কেবল বলা হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানকারীদের একাংশ, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর থেকে কিন্তু বলা হচ্ছিল, আওয়ামী লীগ চাইলে (শর্তসাপেক্ষে) নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। তবে সে পরিস্থিতি মাঝে বদলে যায় দৃশ্যত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিক্ষোভের মুখে। এতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ ছিল। সরকারও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এ অবস্থায় এখানে-ওখানে বের করা দলটির ‘ঝটিকা মিছিল’ও বেআইনি বলে বিবেচিত হবে। এগুলো করে কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি তাদের। দেশে থাকা নেতা-কর্মীরা এতে বরং অহেতুক আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় অনলাইনে তাদের তৎপরতা আরও বেড়েছে। সেখানে ভারতে অবস্থানকারী দলটির সভানেত্রীকেও যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। সবশেষে জানা গেল, তারা একটা ‘অফিস’ খুলেছেন কলকাতায়।
এদিকে গণঅভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর ঠিকই পূর্ণ হয়ে গেল। হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী পরিস্থিতি যত জটিলই হোক, মাঠে থাকা রাজনৈতিক দল ও সরকার তা মোকাবিলায় একেবারে ব্যর্থ হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্য অনেক দেশে পরিস্থিতি এর চাইতেও খারাপ হতে দেখা গেছে, যা পরিবর্তনকামীদের জন্য ছিল আঘাতস্বরূপ। ‘আরব বসন্তে’র অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলা যায়। শ্রীলঙ্কায় অবশ্য বাংলাদেশের চেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটানো গেছে। সেখানে কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় ছিল। আর বাংলাদেশে ছিল তিন-তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা সরকার, যারা নজিরবিহীন দুর্নীতির জন্যও অভিযুক্ত। তাকে হটাতে প্রচলিত ধারার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার এক পর্যায়ে নতুন ধরনের নেতৃত্বে ঘটে গণঅভ্যুত্থান। অনেক রক্তক্ষয় করেও সরকার তা দমনে ব্যর্থ হলে বাধ্য হয় ক্ষমতা ছাড়তে। এভাবে ক্ষমতা হারানোর ঘটনা কমই রয়েছে। এ অবস্থায় আসা যে কোনো সরকারের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা কঠিন। গণঅভ্যুত্থানকারীদের ঐক্য বেশিদিন ধরে রাখাও কঠিন, বিশেষত যখন তাদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর এ দুটি দিকই স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।
একটি ইতিবাচক ঘটনা অবশ্য তারা ঘটিয়েছেন গত এক বছরে। তা হলো রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা। হাসিনা সরকারের মতো কোনো সরকারের জন্ম যাতে আর না হতে পারে, সেটা এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বিএনপি যদিও গণঅভ্যুত্থানের অনেক আগে রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা পেশ করেছিল; তা সত্ত্বেও গণঅভ্যুত্থানের শেষদিকে এর নেতৃত্ব থেকে তোলা হয় ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’র অবসান ঘটানোর দাবি। অন্তর্বর্তী সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। পরে রাষ্ট্র সংস্কারে ৬টি কমিশনের বাছাইকৃত সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ নিলে মাঠে থাকা দলগুলো এতে উৎসাহের সঙ্গে অংশ নেয়। এ ক্ষেত্রে কতখানি সাফল্য মিললো, তার চেয়ে বড় হলো এ ধরনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ; বিতর্কে শামিল হওয়া। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে তারা একমতও হয়েছেন এর মধ্যে। আর তাদের মধ্যে ঐকমত্য আনতে সরকার ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। সংস্কারের একটি জাতীয় সনদও রয়েছে চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে। সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের উপায়ও আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা হবে।
এ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ স্বভাবতই অনুপস্থিত। সংস্কার বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্যও মিলছে না। তারা এখনও দিশেহারা ক্ষমতা হারানোর ঘটনা ঘিরে। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা কেন সংস্কারের বিপরীতে নৌকা বাইছিলেন, সে প্রশ্নও নিজেদের করছেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মতো হঠকারিতায় যাওয়ার বিষয়ে তাদের বক্তব্য কী? নির্বাচন ব্যবস্থা বিনষ্ট করে, সত্যিকারের বিরোধী দলকে সংসদে ‘মাইনাস’ করে রাখার পরিণতি কি একবারও মিলিয়ে দেখবেন না? তাদের অনুপস্থিতিতেও একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়া কিন্তু দেশে চলমান। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এর গুরুত্ব অস্বীকার করছে না। উন্নয়ন সহযোগী দেশ আর সংস্থাগুলোও প্রক্রিয়াটিকে স্বাগত জানাচ্ছে। কেননা সংস্কার এতদিন ছিল মূলত তাদের এজেন্ডা। প্রয়োজনীয় সংস্কারের ৫০ শতাংশও যদি এর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়, তাতে কি দেশ উপকৃত হবে না? এর ভেতর দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাও শক্তিশালী হওয়ার কথা। আর এটি ঘটলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে বলেই ধারণা।
কিছু সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। নির্বাচনের আগে যেটুকু সময় মিলছে, তাতে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারে’র পাশাপাশি কিছু ‘মৌলিক সংস্কার’ও সম্পন্ন হতে পারে। এ অবস্থায় সামনে যে নির্বাচিত সরকার মিলবে, তার জবাবদিহি কিছুটা হলেও বাড়ার সম্ভাবনা। নির্বাচিত সরকারের জবাবদিহি কেবল পরবর্তী নির্বাচনে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ভালো হয় তার প্রতিদিনের জবাবদিহি বাড়ানো গেলে। সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার শংকা কম থাকে। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আসা সরকারকেও স্বেচ্ছাচারী হতে না দেওয়ার কিছু প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে সংস্কার আলোচনায়। এর মাধ্যমে ‘নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া’র একটা চক্রান্ত চলছে বলে অনেকের অনুমান অবশ্য। ইতোমধ্যে নির্বাচনের নিঃশর্ত সময়সীমা ঘোষিত হওয়ায় সে আশংকা আবার কমেছে। নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও দেশ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
দেশ নির্বাচনের দিকে গেলে থেমে থাকা বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে। শ্রমবাজারে পড়বে এর প্রভাব। আয় বাড়বে। এতে করে অপরাধ প্রবণতা কমে আসার মতো সুফল মিলবে বলেও ধারণা। রাজনৈতিক অপরাধ কমবে কিনা, সেটা অবশ্য বলা যায় না। নির্বাচন ঘিরে এ ধরনের অপরাধ বরং আরও বাড়তে পারে। অন্তঃকলহ থেকেও সহিংসতা হয়তো বাড়বে। এসব খুব বেড়ে উঠলে নির্বাচন অনুষ্ঠানই কঠিন হতে পারে। গণঅভ্যুত্থানে ভেঙে পড়া পুলিশ তো এখনও মনোবলহীন। সেনাদের ব্যারাকের বাইরে থাকতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সরকার। এখন ‘নির্বাচনের ট্রেন’ চলার সময়ও কি পরিস্থিতি বদলাবে না? নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীরও বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকার কথা। সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণে সরকারকে সহায়তা জুগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন গণঅভ্যুত্থানের পরপরই। সেই সময়সীমার কাছাকাছি সময়েই হতে যাচ্ছে নির্বাচন। সেনাপ্রধানের কথাও থাকছে।
এখন মাঠের বড় রাজনৈতিক দলগুলো কি সংস্কারের সনদ, এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে নির্বাচনকে সংকটে ফেলবে? নাকি নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে থাকা একটি পক্ষ চাইবে চাপ দিয়ে ‘তলে তলে’ আসন সমঝোতা করে ক্ষমতায় প্রভাব বজায় রাখতে? তাহলে কিন্তু হাসিনা মডেলেই এগোবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হবে। সংসদে আসতে হবে সত্যিকারের বিরোধী দল এবং থাকতে হবে সরকারের কার্যকর বিরোধিতা। এটি নিশ্চিত না হলে কিন্তু সব দল-মতের ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহ দেখাবে না। এবারের নির্বাচনে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকা একদল ভোটার বলিষ্ঠভাবে অংশ নেওয়ার কথা। তারা নির্বাচনের প্রচলিত হিসাব-নিকাশ পালটে দেবে বলেও অনেকের ধারণা। তাদের কাছেও নির্বাচনটিকে নির্বাচনের মতো করে উপস্থাপন করতে হবে। এটা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বৈকি। যে দল ক্ষমতাপ্রত্যাশী– তাকেও নিশ্চিত করতে হবে যে, একটা সত্যিকারের নির্বাচনের ভেতর দিয়েই দলটি ক্ষমতায় এসেছে।
তিন-তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর দেশে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটিকে গ্রহণযোগ্য না করার কোনো সুযোগ তো নেই!
হাসান মামুন – সাংবাদিক , কলামিস্ট