০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
জুলাই অভ্যুত্থান ঘিরে ছিল সুশাসনের স্বপ্ন, সংস্কারের প্রতিশ্রুতি আর মেটিকুলাস ডিজাইনের গল্প। এক বছর পর সেই প্রতিশ্রুতি ম্লান—তাহলে প্রতীক্ষিত সেই নকশা গেল কোথায়?

দেশ পরিচালনার মেটিকুলাস ডিজাইন কই?

আলমগীর খান : সাংবাদিক , কলামিস্ট
  • আপডেট সময় ০৫:১৩:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩৫ বার পড়া হয়েছে

গণঅভ্যুত্থানের সফল পরিণতির পর দেশজুড়ে ছাত্রজনতা গ্রাফিতিতে যে নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা চিত্রিত করেছিল—তা অপূর্ণই রয়ে গেছে।

 

“আবু সাঈদের জীবন দিয়ে কি হলো? ছ্যোলটা হামার থাকাই ভালো আছিল। দেশ তো গঠনই হলো না। আগে যে রকম ছিল, ঠিক সে রকমই আছে।” জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম তার ছেলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আক্ষেপ নিয়ে এমনটাই বলছিলেন।

সাঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবা মকবুল হোসেন ওই পত্রিকাটির সঙ্গেই বললেন, “যে বৈষম্য দূর করার জন্য আমার ছেলে জীবন দিয়েছে, তা রয়েই গেছে। বিএনপি চায় শুধুই নির্বাচন। আর জামায়াত-এনসিপি চায় বিচার। আমরা চাই এমন সরকার, যারা সুশাসন দেবে, বৈষম্য করবে না। দেশ শান্তিতে থাকবে।”

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন বলছেন, দেশে এক বছরে অনেক ধরনের উন্নতি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ করে ক্ষমতাবান বলে তাদের কথা আমাদের বিশ্বাস করা উচিত। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছে কারণ আমাদের চোখকানও যে খোলা। তাছাড়া উপদেষ্টাদের কথা বিশ্বাস করলে জুলাই শহীদদের গরীব মা-বাবাদের কথা অবিশ্বাস করতে হয়, যা অন্যায়। পরে বুঝেছি, আসলে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে প্রত্যেকে সঠিক। উপদেষ্টারা নিশ্চয়ই ভালো আছেন ও অনেকে উন্নতিও করেছেন, না হলে কেউ উপদেষ্টা হবেন কেন? কিন্তু দেশের মানুষ ভালো আছে কি? নেই যে তার কারণ বর্তমান সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার একটা মেটিকুলাস ডিজাইনের অভাব, যা খুবই আশ্চর্যের।

লক্ষণীয় যে, বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের একটি অনুষ্ঠানে স্বয়ং বিল ক্লিনটনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মূল কারিগরদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, আন্দোলনটি ছিলো গোছানো বা নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত। ঠিক এইটা অবশ্য বলেননি। তিনি ইংরেজি বক্তৃতায় ইংরেজিতে বলেছিলেন মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। কারণে অকারণে অনেক কিছুর মত এই শব্দটাও ভাইরাল হয়ে যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শত্রুরা যারা নিজেরা ষড়যন্ত্র করে বিনা নির্বাচনে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকতে অভ্যস্ত তারা এই নিষ্পাপ শব্দটার মধ্যেও একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেতে শুরু করে। এ তাদের স্বভাব, তাই নানা কথার গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।

আসলে কিন্তু এটি ছিলো আহ্লাদিত হওয়ার ব্যাপার। যে বিরাট সংখ্যক ছাত্রজনতা এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন ও যারা জীবন পর্যন্ত দান করেছেন তারা কিন্তু এ মেটিকুলাস ডিজাইন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। যে আন্দোলনে এমন দুর্দান্ত মেটিকুলাস ডিজাইন থাকে যা এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেটিকুলাস ডিজাইনের দেশে গর্বের সঙ্গে বলা যায় এবং এভাবে তার সবচেয়ে মেটিকুলাসলি ডিজাইনড প্রেসিডেন্টকেও চমকে দেয়া যায়–তাতে এত সংখ্যক মানুষের আত্মাহুতি বেখাপ্পাই ঠেকে। মেটিকুলাস ডিজাইন শব্দগুচ্ছটিও মেটিকুলাসলি ডিজাইনড কিনা সে সন্দেহ দেখা দেয়।

আমাদের বাঙ্গালের কানে মেটিকুলাস ডিজাইন শব্দটি ফ্যাশনের, গাড়িবাড়ি নির্মাণের বা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের নকশার সঙ্গে বেশি খাপ খায়। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, স্বৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডই বরং মেটিকুলাসলি ডিজাইনড, না হলে বছরের পর বছর বিনা ভোটে অন্তত সংগ্রামী বাংলায় ক্ষমতায় বসে থাকা সম্ভব না। হয়তো প্রধান উপদেষ্টা বাংলায় গোছানো, পরিকল্পিত ইত্যাদি বললে কোনো সমস্যাই হতো না। কিন্তু ক্লিনটনের উর্বর মস্তিষ্কে ঢুকানোর জন্য তিনি উর্বর ইংরেজিতে বলতে বাধ্য ছিলেন। তাই এর মর্মার্থ আমাদের অনুর্বর মস্তিষ্কে কিছুতেই ঢুকছিল না। আর কেউ এ শব্দগুচ্ছটির যুতসই বাংলা ব্যবহারের প্রয়োজনও অনুভব করলেন না।

গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং বিল ক্লিনটনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মূল কারিগরদের একজন বলে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন। ছবি: পিআইডিগত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং বিল ক্লিনটনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মূল কারিগরদের একজন বলে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন। ছবি: পিআইডি

 

অবশেষে এই অসাঞ্জস্য থেকে মুক্তি দিতে আন্দোলনের মূল কারিগর বলে পরিচিত উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকেই বিতর্কে নামতে হলো। তিনি প্রশ্ন করলেন, “মেটিকুলাস ডিজাইনে সমস্যা কোথায়?” বললেন, “পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মেটিকুলাস ডিজাইন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আর ৭১-এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন ও বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা সঠিক হইতে পারলে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান মেটিকুলাস ডিজাইন হইলে সমস্যা কোথায়?”

আমরাও তখন পরিষ্কার বুঝলাম যে, যদি তাই হয়, তবে আর সমস্যা কি? সব গোলমাল তো মিটে গেল। আবার আরেকটা রহস্যও তিনি মীমাংসা করলেন এই বলে যে, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের দুটি অংশ। ৫ জুন থেকে ১৮ জুলাই। এ অংশে অভ্যুত্থানের প্রক্ষাপট এবং নেতৃত্ব তৈরি হয়েছিল। আর ১৯ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত সকল স্তরের ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে এবং আত্মদানে অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। পরের অংশের কৃতিত্ব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার।”

তার কথায় এতক্ষণে বোঝা গেল, যে দ্বিতীয় অংশে আন্দোলন সফল হয়ে এটি এক সফল গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়েছে সেটি মেটিকুলাসলি ডিজাইনড নয়, হতেও পারে না। সে হচ্ছে এক নির্যাতিত জনতার ঐতিহাসিক-কাব্যিক উত্থান যার পেছনে স্বপ্ন থাকে, তবে মেটিকুলাস ডিজাইন হয় না। বরং স্বৈরাচারী সরকারেরই মেটিকুলাস ডিজাইন ছিল এ আন্দোলনটিকে নস্যাৎ করার যা ব্যর্থ হয়ে গেছে বিরাট সংখ্যক ছাত্রজনতার আনমেটিকুলাসের উত্থানে। স্বৈরাচারের মেটিকুলাস ডিজাইনের ক্ষুদ্র ফ্রেমে তা ধরা যায়নি বলেই তাকে পালাতে হয়েছে। লক্ষণীয় ক্লিনটনের সহধর্মিণী হিলারি ক্লিনটনের মেটিকুলাসলি ডিজাইনড নির্বাচনি প্রচারাভিযান আনমেটিকুলাস ডনাল্ড ট্রাম্পের ততোধিক আনমেটিকুলাস ক্যাম্পেইনের কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। এটা যে ঘটতে পারে মেটিকুলাস ক্লিনটন ক্যাম্প তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। পালানোর আগের দিন পর্যন্ত টের পাননি আমাদের মেটিকুলাস লৌহমানবীও। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ মেটিকুলাসলি লিখিত বক্তব্যের পাঠ নয়, খানিকটা আনেমেটিকুলাস— তাই এত জীবন্ত, কাব্যিক ও ইতিহাসের এমন এক চূড়া যে উচ্চতায় না বঙ্গবন্ধু নিজে না আর কোনো বাঙালি আর কখনো আরোহণ করতে পেরেছেন।

গণঅভ্যুত্থানের সফল পরিণতির পর দেশজুড়ে ছাত্রজনতা গ্রাফিতিতে যেমন একটি দেশের আকাঙ্ক্ষা চিত্রিত করেছিল, তা-ও কিন্তু মেটিকুলাসলি ডিজাইনড নয় এবং তারা সেই দেশটি এখনও পায়নি। পাবে বলে আর আশা না করতে পারায় তাদের বেশির ভাগই এখন হতাশ। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই দেয়ালে আঁকা বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় গ্রাফিতির ছবি-সংবলিত একটি আর্ট বুকও প্রকাশ হয় সরকারের তরফে। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশ সফরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কিংবা দেশে আসা বিদেশি অতিথিকে সেই আর্ট বুক উপহার দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন হয়তো। ওই সফরে ক্লিনটনকে যে দিয়েছিলেন, সেটার ছবি তো আমরা দেখেছি তখনই। দেয়ালের লিখন মিথ্যে হতে চলেছে কী?

তবু মেটিকুলাস ডিজাইন কথাটা আমাদের মনে ধরেছিল, অনেকের মনে আশার আলো সঞ্চার করেছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এমন মেটিকুলাস ডিজাইন যাদের হাতে থাকতে পারে, এই দেশ তাদের হাতে উন্নতি না করেই পারে না। যখন আমূল সংস্কারের কথা বলা হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু তখন সবচেয়ে বড় যার আবির্ভাব ঘটল তা এক আশ্চর্য পদার্থ— মব জাস্টিস। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষাক্ষেত্রে বাগাড়ম্বর ভিন্ন কোথাও এক ফোঁটা পরিবর্তন ছাড়াই শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের প্যাঁদানো শুরু হলো। ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে ও প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মিলে বেচারা জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেওয়ার ম্যাজিক ল্যাম্প দেখানো হলো।

মানুষ এক চেতনার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে না বাঁচতেই আরেক নতুন চেতনার খপ্পরে পড়ল। দেশজুড়ে আনমেটিকুলাস ডিজাইনের এমন সব মেটিকুলাস রূপ চারদিকে দেখা দিতে শুরু করল যে, প্রধান উপদেষ্টাকেই কয়েকবার হতাশ হয়ে বলতে হয়েছে, তিনি দায়িত্বে থাকতে চান না। দেশের মানুষ যারা ভেবেছিলেন এই নতুন সরকার দেশ পরিচালনার একটা অনবদ্য মেটিকুলাস ডিজাইন ব্যাকপকেটে ভরে রেখেছেন তারাও হতাশ হলেন ও প্রতিদিন হচ্ছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের সময় শেষ হয়েছে মন্তব্য করে এখন এক্সিট পলিসি নির্ধারণের পরামর্শ দিতে শুরু করেছেন সুধীজন। যারা ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের ফসল এ অন্তর্বর্তী সরকারকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন তারাও অনেকে এখন হতাশাগ্রস্ত। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, লুটপাট বন্ধ করা, চাঁদাবজি দমন, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন ব্যবস্থা কোনো ক্ষেত্রেই কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান কিংবা ভবিষ্যতে সম্পাদনেরও মেটিকুলাস দূরে থাক, কোনো ডিজাইনই দেখা যাচ্ছে না।

বরং হঠাৎ সাদা পাথরের ম্যাজিকে আমজনতার চোখ ধাঁধায়ে গেল। সাংবাদিক আমীন আল রশীদের সাম্প্রতিক একটি ফেইসবুক পোস্ট থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করা যাক: “এনজিও চালানো আর দেশ চালানো যে এক কথা নয়, সেটা সিলেটের অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ধ্বংসের পরেও কি আমাদের মহান উপদেষ্টাগণ বুঝতে পারছেন? চেয়ারে বসে থাকবেন, গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়াবেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন অথচ কাজ করবেন না, করতে পারবেন না, রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষারোপ করবেন এবং সুশীলমার্কা বক্তব্য দিবেন, তা হবে না। সুশীলর্মাকা বক্তব্য দেয়ার জন্য আমরা আছি। এক বছরে যথেষ্ট সংস্কার করেছেন! আপনাদের সংস্কারে মানুষ বিরক্ত!”

এ পোস্টে যে পরিমাণ প্রতিক্রিয়া ও কমেন্ট পড়েছে তাতে এটি যে এখন অনেকেরই মনের কথা তা আঁচ করা যায়। অবশ্য মনের কথা এখন বলা যায়, সেটাই বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমল থেকে এখনকার আমলের একটা পার্থক্য। কিন্তু বাকি সব যে মেটিকুলাসলি আনমেটিকুলাস! দেশটা পরিচালনার একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা যদি ওনাদের হাতে থাকতো তবেই যে আমরা আমজনতা একেবারে বর্তে যেতাম! সেইটা পেলাম কই?

 

 

আলমগীর খান : সাংবাদিক , কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

জুলাই অভ্যুত্থান ঘিরে ছিল সুশাসনের স্বপ্ন, সংস্কারের প্রতিশ্রুতি আর মেটিকুলাস ডিজাইনের গল্প। এক বছর পর সেই প্রতিশ্রুতি ম্লান—তাহলে প্রতীক্ষিত সেই নকশা গেল কোথায়?

দেশ পরিচালনার মেটিকুলাস ডিজাইন কই?

আপডেট সময় ০৫:১৩:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫

 

“আবু সাঈদের জীবন দিয়ে কি হলো? ছ্যোলটা হামার থাকাই ভালো আছিল। দেশ তো গঠনই হলো না। আগে যে রকম ছিল, ঠিক সে রকমই আছে।” জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম তার ছেলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আক্ষেপ নিয়ে এমনটাই বলছিলেন।

সাঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবা মকবুল হোসেন ওই পত্রিকাটির সঙ্গেই বললেন, “যে বৈষম্য দূর করার জন্য আমার ছেলে জীবন দিয়েছে, তা রয়েই গেছে। বিএনপি চায় শুধুই নির্বাচন। আর জামায়াত-এনসিপি চায় বিচার। আমরা চাই এমন সরকার, যারা সুশাসন দেবে, বৈষম্য করবে না। দেশ শান্তিতে থাকবে।”

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন বলছেন, দেশে এক বছরে অনেক ধরনের উন্নতি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ করে ক্ষমতাবান বলে তাদের কথা আমাদের বিশ্বাস করা উচিত। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছে কারণ আমাদের চোখকানও যে খোলা। তাছাড়া উপদেষ্টাদের কথা বিশ্বাস করলে জুলাই শহীদদের গরীব মা-বাবাদের কথা অবিশ্বাস করতে হয়, যা অন্যায়। পরে বুঝেছি, আসলে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে প্রত্যেকে সঠিক। উপদেষ্টারা নিশ্চয়ই ভালো আছেন ও অনেকে উন্নতিও করেছেন, না হলে কেউ উপদেষ্টা হবেন কেন? কিন্তু দেশের মানুষ ভালো আছে কি? নেই যে তার কারণ বর্তমান সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার একটা মেটিকুলাস ডিজাইনের অভাব, যা খুবই আশ্চর্যের।

লক্ষণীয় যে, বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের একটি অনুষ্ঠানে স্বয়ং বিল ক্লিনটনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মূল কারিগরদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, আন্দোলনটি ছিলো গোছানো বা নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত। ঠিক এইটা অবশ্য বলেননি। তিনি ইংরেজি বক্তৃতায় ইংরেজিতে বলেছিলেন মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। কারণে অকারণে অনেক কিছুর মত এই শব্দটাও ভাইরাল হয়ে যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শত্রুরা যারা নিজেরা ষড়যন্ত্র করে বিনা নির্বাচনে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকতে অভ্যস্ত তারা এই নিষ্পাপ শব্দটার মধ্যেও একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেতে শুরু করে। এ তাদের স্বভাব, তাই নানা কথার গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।

আসলে কিন্তু এটি ছিলো আহ্লাদিত হওয়ার ব্যাপার। যে বিরাট সংখ্যক ছাত্রজনতা এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন ও যারা জীবন পর্যন্ত দান করেছেন তারা কিন্তু এ মেটিকুলাস ডিজাইন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। যে আন্দোলনে এমন দুর্দান্ত মেটিকুলাস ডিজাইন থাকে যা এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেটিকুলাস ডিজাইনের দেশে গর্বের সঙ্গে বলা যায় এবং এভাবে তার সবচেয়ে মেটিকুলাসলি ডিজাইনড প্রেসিডেন্টকেও চমকে দেয়া যায়–তাতে এত সংখ্যক মানুষের আত্মাহুতি বেখাপ্পাই ঠেকে। মেটিকুলাস ডিজাইন শব্দগুচ্ছটিও মেটিকুলাসলি ডিজাইনড কিনা সে সন্দেহ দেখা দেয়।

আমাদের বাঙ্গালের কানে মেটিকুলাস ডিজাইন শব্দটি ফ্যাশনের, গাড়িবাড়ি নির্মাণের বা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের নকশার সঙ্গে বেশি খাপ খায়। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, স্বৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডই বরং মেটিকুলাসলি ডিজাইনড, না হলে বছরের পর বছর বিনা ভোটে অন্তত সংগ্রামী বাংলায় ক্ষমতায় বসে থাকা সম্ভব না। হয়তো প্রধান উপদেষ্টা বাংলায় গোছানো, পরিকল্পিত ইত্যাদি বললে কোনো সমস্যাই হতো না। কিন্তু ক্লিনটনের উর্বর মস্তিষ্কে ঢুকানোর জন্য তিনি উর্বর ইংরেজিতে বলতে বাধ্য ছিলেন। তাই এর মর্মার্থ আমাদের অনুর্বর মস্তিষ্কে কিছুতেই ঢুকছিল না। আর কেউ এ শব্দগুচ্ছটির যুতসই বাংলা ব্যবহারের প্রয়োজনও অনুভব করলেন না।

গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং বিল ক্লিনটনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মূল কারিগরদের একজন বলে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন। ছবি: পিআইডিগত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং বিল ক্লিনটনের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মূল কারিগরদের একজন বলে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন। ছবি: পিআইডি

 

অবশেষে এই অসাঞ্জস্য থেকে মুক্তি দিতে আন্দোলনের মূল কারিগর বলে পরিচিত উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকেই বিতর্কে নামতে হলো। তিনি প্রশ্ন করলেন, “মেটিকুলাস ডিজাইনে সমস্যা কোথায়?” বললেন, “পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মেটিকুলাস ডিজাইন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আর ৭১-এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন ও বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা সঠিক হইতে পারলে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান মেটিকুলাস ডিজাইন হইলে সমস্যা কোথায়?”

আমরাও তখন পরিষ্কার বুঝলাম যে, যদি তাই হয়, তবে আর সমস্যা কি? সব গোলমাল তো মিটে গেল। আবার আরেকটা রহস্যও তিনি মীমাংসা করলেন এই বলে যে, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের দুটি অংশ। ৫ জুন থেকে ১৮ জুলাই। এ অংশে অভ্যুত্থানের প্রক্ষাপট এবং নেতৃত্ব তৈরি হয়েছিল। আর ১৯ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত সকল স্তরের ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে এবং আত্মদানে অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। পরের অংশের কৃতিত্ব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার।”

তার কথায় এতক্ষণে বোঝা গেল, যে দ্বিতীয় অংশে আন্দোলন সফল হয়ে এটি এক সফল গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়েছে সেটি মেটিকুলাসলি ডিজাইনড নয়, হতেও পারে না। সে হচ্ছে এক নির্যাতিত জনতার ঐতিহাসিক-কাব্যিক উত্থান যার পেছনে স্বপ্ন থাকে, তবে মেটিকুলাস ডিজাইন হয় না। বরং স্বৈরাচারী সরকারেরই মেটিকুলাস ডিজাইন ছিল এ আন্দোলনটিকে নস্যাৎ করার যা ব্যর্থ হয়ে গেছে বিরাট সংখ্যক ছাত্রজনতার আনমেটিকুলাসের উত্থানে। স্বৈরাচারের মেটিকুলাস ডিজাইনের ক্ষুদ্র ফ্রেমে তা ধরা যায়নি বলেই তাকে পালাতে হয়েছে। লক্ষণীয় ক্লিনটনের সহধর্মিণী হিলারি ক্লিনটনের মেটিকুলাসলি ডিজাইনড নির্বাচনি প্রচারাভিযান আনমেটিকুলাস ডনাল্ড ট্রাম্পের ততোধিক আনমেটিকুলাস ক্যাম্পেইনের কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। এটা যে ঘটতে পারে মেটিকুলাস ক্লিনটন ক্যাম্প তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। পালানোর আগের দিন পর্যন্ত টের পাননি আমাদের মেটিকুলাস লৌহমানবীও। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ মেটিকুলাসলি লিখিত বক্তব্যের পাঠ নয়, খানিকটা আনেমেটিকুলাস— তাই এত জীবন্ত, কাব্যিক ও ইতিহাসের এমন এক চূড়া যে উচ্চতায় না বঙ্গবন্ধু নিজে না আর কোনো বাঙালি আর কখনো আরোহণ করতে পেরেছেন।

গণঅভ্যুত্থানের সফল পরিণতির পর দেশজুড়ে ছাত্রজনতা গ্রাফিতিতে যেমন একটি দেশের আকাঙ্ক্ষা চিত্রিত করেছিল, তা-ও কিন্তু মেটিকুলাসলি ডিজাইনড নয় এবং তারা সেই দেশটি এখনও পায়নি। পাবে বলে আর আশা না করতে পারায় তাদের বেশির ভাগই এখন হতাশ। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই দেয়ালে আঁকা বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় গ্রাফিতির ছবি-সংবলিত একটি আর্ট বুকও প্রকাশ হয় সরকারের তরফে। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশ সফরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কিংবা দেশে আসা বিদেশি অতিথিকে সেই আর্ট বুক উপহার দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন হয়তো। ওই সফরে ক্লিনটনকে যে দিয়েছিলেন, সেটার ছবি তো আমরা দেখেছি তখনই। দেয়ালের লিখন মিথ্যে হতে চলেছে কী?

তবু মেটিকুলাস ডিজাইন কথাটা আমাদের মনে ধরেছিল, অনেকের মনে আশার আলো সঞ্চার করেছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এমন মেটিকুলাস ডিজাইন যাদের হাতে থাকতে পারে, এই দেশ তাদের হাতে উন্নতি না করেই পারে না। যখন আমূল সংস্কারের কথা বলা হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু তখন সবচেয়ে বড় যার আবির্ভাব ঘটল তা এক আশ্চর্য পদার্থ— মব জাস্টিস। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষাক্ষেত্রে বাগাড়ম্বর ভিন্ন কোথাও এক ফোঁটা পরিবর্তন ছাড়াই শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের প্যাঁদানো শুরু হলো। ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে ও প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মিলে বেচারা জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেওয়ার ম্যাজিক ল্যাম্প দেখানো হলো।

মানুষ এক চেতনার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে না বাঁচতেই আরেক নতুন চেতনার খপ্পরে পড়ল। দেশজুড়ে আনমেটিকুলাস ডিজাইনের এমন সব মেটিকুলাস রূপ চারদিকে দেখা দিতে শুরু করল যে, প্রধান উপদেষ্টাকেই কয়েকবার হতাশ হয়ে বলতে হয়েছে, তিনি দায়িত্বে থাকতে চান না। দেশের মানুষ যারা ভেবেছিলেন এই নতুন সরকার দেশ পরিচালনার একটা অনবদ্য মেটিকুলাস ডিজাইন ব্যাকপকেটে ভরে রেখেছেন তারাও হতাশ হলেন ও প্রতিদিন হচ্ছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের সময় শেষ হয়েছে মন্তব্য করে এখন এক্সিট পলিসি নির্ধারণের পরামর্শ দিতে শুরু করেছেন সুধীজন। যারা ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের ফসল এ অন্তর্বর্তী সরকারকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন তারাও অনেকে এখন হতাশাগ্রস্ত। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, লুটপাট বন্ধ করা, চাঁদাবজি দমন, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন ব্যবস্থা কোনো ক্ষেত্রেই কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান কিংবা ভবিষ্যতে সম্পাদনেরও মেটিকুলাস দূরে থাক, কোনো ডিজাইনই দেখা যাচ্ছে না।

বরং হঠাৎ সাদা পাথরের ম্যাজিকে আমজনতার চোখ ধাঁধায়ে গেল। সাংবাদিক আমীন আল রশীদের সাম্প্রতিক একটি ফেইসবুক পোস্ট থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করা যাক: “এনজিও চালানো আর দেশ চালানো যে এক কথা নয়, সেটা সিলেটের অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ধ্বংসের পরেও কি আমাদের মহান উপদেষ্টাগণ বুঝতে পারছেন? চেয়ারে বসে থাকবেন, গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়াবেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন অথচ কাজ করবেন না, করতে পারবেন না, রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষারোপ করবেন এবং সুশীলমার্কা বক্তব্য দিবেন, তা হবে না। সুশীলর্মাকা বক্তব্য দেয়ার জন্য আমরা আছি। এক বছরে যথেষ্ট সংস্কার করেছেন! আপনাদের সংস্কারে মানুষ বিরক্ত!”

এ পোস্টে যে পরিমাণ প্রতিক্রিয়া ও কমেন্ট পড়েছে তাতে এটি যে এখন অনেকেরই মনের কথা তা আঁচ করা যায়। অবশ্য মনের কথা এখন বলা যায়, সেটাই বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমল থেকে এখনকার আমলের একটা পার্থক্য। কিন্তু বাকি সব যে মেটিকুলাসলি আনমেটিকুলাস! দেশটা পরিচালনার একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা যদি ওনাদের হাতে থাকতো তবেই যে আমরা আমজনতা একেবারে বর্তে যেতাম! সেইটা পেলাম কই?

 

 

আলমগীর খান : সাংবাদিক , কলামিস্ট