“মূলত পরিবারের ওপর মানসিক চাপ দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে সমন্বয়কদের আটক করা হয়,” বলেন সাবেক এ আইজিপি।
আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত: রাজসাক্ষী মামুন

- আপডেট সময় ০১:৪৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৩১ বার পড়া হয়েছে
জুলাই আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয় বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশের সে সময়ের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
ওই সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগে করা এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও আসামি।
এ মামলায় মঙ্গলবার ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন মামুন, যিনি এ মামলার রাজসাক্ষী।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মামুনের সাক্ষ্য নেন।
সাক্ষ্যে মামুন বলেন, আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনকারীদের নজরদারি করে তাদের অবস্থান নির্ণয় এবং গুলি করার সিদ্ধান্ত হয়। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে।
“এর পরামর্শ দিয়েছিলেন র্যাবের তখনকার ডিজি হারুন অর রশিদ। পরবর্তী সময়ে আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল উইপন বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে ব্লক রেইড করার সিদ্ধান্ত হয়।”
সাবেক আইজিপি বলেন, “তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে ফোন করে জানান, শেখ হাসিনা আন্দোলন দমন করতে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক ১৮ জুলাই থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে ওয়ারলেসে তার অধীনস্থদের নির্দেশ দেন। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়। মূলত হাবিবুর রহমান ও ডিবির হারুন লেথাল উইপন ব্যবহারে বেশি উৎসাহী ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমাতে হবে।”
আর এ বিষয়ে তখনকার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, তথ্য প্রতিমন্ত্রী এ আরাফাত, আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্ররোচিত করেন বলে দাবি করেন এ রাজসাক্ষী।

চৌধুরী মামুন বলেন, ১৯ জুলাই থেকে প্রতিরাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক হতো। আন্দোলন দমাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো। তিনিসহ বৈঠকে তখনকার স্বরাষ্ট সচিব জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান, রেজা মোস্তফা, র্যাবের মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ, ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান, বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসারের ডিজি এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসি’র ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রধানরা থাকতেন।
“কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের সিদ্ধান্ত হয় এবং ডিজিএফআই এ প্রস্তাব দেয়। তবে আমি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে রাজি হই। ডিবির প্রধান হারুনকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামালের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও হারুন তাদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে। মূলত সমন্বয়ক ও তাদের পরিবারের ওপর মানসিক চাপ দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে তাদের আটক করা হয় এবং টেলিভিশনের সামনে তাদের বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডিবির হারুনকে ‘জিন’ বলে ডাকতেন। কারণ সে সরকারি নির্দেশনা পালনে পারদর্শী ছিল।”
‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকানোর পরিকল্পনা হয় গণভবনে’
মামুন জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের ৪ অগাস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিজিএফআই-এনএসআই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন অংশ নেন।
ওই বৈঠকে নিজের উপস্থিত থাকার তথ্য দিয়ে মামুন বলেন, “সেখানে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর মধ্যেই চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠক মুলতবি করা হয়।
“ওই রাতেই আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আনিসুল, কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাব ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন।”
শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন; আর বাইরে ডিজিএফআই ও এসবি প্রধান অপেক্ষমান ছিলেন বলে জানান মামুন।
তিনি বলেন, ওই বেঠকে ৫ অগাস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
“এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েন করে কাঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা চলে আসি।”
মামুন আরও বলেন, “৫ অগাস্ট সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা আমরা জানতাম না। এরপর বিকালে আর্মির হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন।”
পরে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান তিনি।
এরপর ৬ অগাস্ট আইজিপি হিসেবে তার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয় এবং ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালে ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, বলেন মামুন।

আন্দোলনের দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মামুন বলেন, “২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখান ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল।
“ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন যে, গুলি করি, একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।”
এই ভিডিও এরপর সারাদেশে ভাইরাল হয়ে যায়।
‘অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় রাজসাক্ষী’
রাজসাক্ষী মামুন বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের আদেশে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার জন্য আমি অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে আমি ট্রাইব্যুনালে স্বজন হারানোদের কান্না, আকুতি ও আহাজারি দেখেছি। ভিডিওতে নৃশংসতা দেখে অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত আমি যৌক্তিক মনে করছি। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের পর আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মত বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।”
তিনি বলেন, “আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে আমার দায়িত্বশীল সময়ে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
“আমি প্রত্যেক নিহতদের পরিবার, আহত ব্যাক্তি, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকি জীবনে কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।”
মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান – বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম