০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
“সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে; আর যদি আত্মহত্যা করে, সেটা সামিরার কারণে,” বলেন মা নীলা চৌধুরী।

২৭ ছবির সালমান শাহ ,মৃত্যু নিয়ে এখনো মতদ্বৈধ

বিনোদন ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • আপডেট সময় ০১:১০:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ৩৩ বার পড়া হয়েছে

 

একটি-দুটি করে পার হয়েছে ২৯টি বছর; এখনো ঢাকাই সিনেমার নায়ক সালমান শাহের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও তা মানতে নারাজ পরিবার ও ভক্তরা। তাদের ভাষ্য, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে।

তুমুল জনপ্রিয় এ চিত্রনায়কের মা নীলা চৌধুরী বলছেন, “সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। আর যদি সে আত্মহত্যাও করে- সেটা তো সামিরার কারণে। তার কারণে আমি আমার ছেলেটাকে হারিয়েছি।”

এই মামলা যদি না চলে, নতুন করে হত্যা মামলা করবেন বলে জানালেন তিনি।

 

সিনেমায় আসার আগেই সামিরা হককে বিয়ে করেছিলেন সালমান। ১৯৯৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর ইস্কাটনে সালমান শাহর বাসা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরিবারের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়েছে, সালমানকে খুন করা হয়েছে।

দুই যুগ ধরে আদালতে ঝুলে থাকা মামলার প্রথমে তদন্তভার আসে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের হাতে (সিআইডি)। এরপর ২০১৬ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এই হত্যা মামলা তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। প্রতিবারই আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়নি, আত্মহত্যা করেছেন এ নায়ক।

পিবিআইয়ের তদন্ত শেষে সংস্থার পরিদর্শক সিরাজুল ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে বলা হয়- সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। ঢাকার তৎকালীন মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর পিবিআইর দেওয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন।

এরপর সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী রিভিশন আবেদন করেন, যা ২০২২ সালের ১২ জুন গ্রহণ করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ। তবে সালমান শাহর মা দেশের বাইরে থাকায় রিভিশন শুনানি হচ্ছে না। সবশেষ গত ২৬ অগাস্ট মামলাটির শুনানির তারিখ ছিল। ওইদিন রিভিশনকারী আদালতে হাজির না হওয়ায় শুনানি পিছিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর দিনে ঠিক করেছেন মহানগর দায়রা জজ জাকির হোসেন।

যোগাযোগ করা হলে লন্ডনে অবস্থানরত নীলা চৌধুরী বলেন, “দেশের যে অবস্থা, আগে সব ঠিক হোক, স্ট্যাবল হোক। এখন গিয়ে কার কাছে বিচার চাইব। দেশের পরিবর্তন হোক।

“২০১৮ সালে আমাকে জানানো হলো, মা সরে যান, না হলে গুম হয়ে যাবেন। আমাকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করতে দিত না এস আলম, শফিকুল ইসলাম হীরা সিন্ডিকেট। আমাকে শেষ করতে পারলে তো মামলা শেষ হয়ে যাবে।”

 

নীলা চৌধুরী বলেন, “আমার ছেলে খুন হয়েছে, লাশ মর্গে পড়ে আছে। আমাদের দুই লাইন লেখার শক্তি ছিল না। সেখানে হত্যাকাণ্ডকে এতো বড় একটা অপমৃত্যুর এজাহার করলো। পুলিশ এতো দয়াবান! সালমান শাহ হত্যার সাথে ফিল্মের লোক জড়িত।

“আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা মিলে আমার ছেলেটাকে খুন করেছে। মরে গিয়ে আমার ছেলেটা দোজখ থেকে, এফডিসি থেকে, সামিরার কাছ থেকে রেহাই পেয়েছে। সামিরা তো আমার ছেলেটাকে জোর করে গ্রহণ করে সংসার করেছে।

“এখন ডলি জহুর, সামিরা, ডন একই ভাষায় কথা বলছে যে- সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে। ইমন (সালমান শাহ) যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে তো তোর (সামিরার) কারণে করেছে। আর রুবি তো হত্যার কথা সব বলে দিচ্ছিল, তাকে বাধা দেওয়া হলো কেন? আল্লাহ আছেন।”

সালমান শাহর মা বলেন, “ইমন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। আমার হাতে গড়া বাচ্চা। প্রত্যেকটা জিনিস আমি ওকে হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছি। এমনকি সিনেমায় ভালোবাসার অভিনয় কেমনে করতে হয়, তাও শিখিয়েছি। ওরা সবাই মিলে আমার ছেলেটা খুন করলো। স্বামী মারা গেলে দুঃখবোধ থাকে। সামিরার মধ্যে এটা ছিলো না। বারবার নতুন নতুন সংসার করছে।

“মেয়েটা কেমনে নিজেকে খুন করলো, নিজেকে জীবন্ত খুন করেছে। আমাকেও খুন করার চেষ্টা করছে। আমি মারা গেলে আমার মৃত্যুর জন্য সামিরা দায়ী থাকবে। রোষানল থেকে, মামলা থেকে বাঁচতে সে হয়তো আমাকেও খুন করবে। আমি দেশে চলে আসব। এই মামলা যদি না চলে, তাহলে নতুন করে হত্যা মামলা করব। সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।”

সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম বলেন, “২৯ বছর হয়ে গেল, সালমান শাহ হত্যার বিচার হলো না। অপেক্ষা করেন, ইনশাআল্লাহ এবার ভালো কিছু হবে।”

ভালো কিছু কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “তা বলব কেন? মামলার স্বার্থে এখন কিছুই বলব না।”

 

খেদ প্রকাশ করে আলমগীর কুমকুম বলেন, “সাংবাদিকরা সারা বছর খোঁজ নেয় না, ৬ সেপ্টেম্বর আসলে ফোন করে খবর নেয়। আমাদের যখন দুঃখের সময়, আপনাদের (সাংবাদিকদের) তখন নিউজের সময়।”

সালমান শাহর বিষয়ে সাংবাদিকরা সামিরার সাক্ষাৎকার নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, “সালমান শাহ হত্যা মামলার কিছু ডকুমেন্ট চেয়ে আমরা রিভিশন করেছি। এ রিভিশন করেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ লন্ডনে রয়েছেন। অসুস্থ থাকায় দেশে আসতে পারছেন না।

“নীলা চৌধুরী তার ভাই আলমগীর কুমকুম রিভিশনকারী হিসেবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর রিভিশনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।”

তিনি বলেন, “এ সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা; মামলাটা সুনজরে দেখবেন, সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে তদন্ত করবেন। প্রকৃত আসামিরা যেন আইনের আওতায় আসে।

“এ হত্যার বিচার যেন সালমান শাহর মা দেখে যেতে পারেন, সেই প্রত্যাশা করি।”

 

সালমান শাহর জন্য রাজপথে ভক্তরাসালমান শাহর জন্য রাজপথে ভক্তরা

 

সালমান শাহর অসংখ্য ভক্তের একজন সোহেল বলেন, “সালমান শাহকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা পরিকল্পিতভাবে সালমান শাহকে হত্যা করেছে। এর অনেক প্রমাণও আছে। রুবি নামে একজন লাইভে এসেও বলেছে, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও পিবিআই এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চায়।

তিনি বলেন, “অনেক বছর হয়ে গেছে। এমন একজন স্টার আর বাংলাদেশে আসবে না। তার মৃত্যুর সঠিক কারণটা উদঘাটিত হোক।

“নতুন প্রজন্ম জানুক কীভাবে, কারা তাকে হত্যা করেছে। এই সরকারের কাছে অনুরোধ, মামলার সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরবেন।”

 

ইমন থেকে সালমান শাহ

বলা হয়, মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের চলচ্চিত্র-জীবনে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সালমান শাহ ঢাকাই সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকে যারা বয়সে ছিলেন কিশোর-তরুণ, তাদের অনেকের হৃদয়েই সালমান শাহ বাংলাদেশের ‘সেরা রোমান্টিক অভিনেতা’ হয়ে থাকবেন।

রূপালি পর্দার সালমান শাহর আনুষ্ঠানিক সাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সিলেটের জকিগঞ্জে নানাবাড়িতে ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। কমর উদ্দিন চৌধুরী ও নীলা চৌধুরীর বড় ছেলে ছিলেন তিনি।

আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ড. মালেকা সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ইমন ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন সাবেক ক্রিকেটার শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরাকে; তখন তার বয়স ২২ বছর। সামিরার মায়ের ছিল বিউটি পার্লারের ব্যবসা।

 

বিনোদনজগতে সালমানের যাত্রা শুরু হয় বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে। গানও গাইতেন, ছায়ানটের পল্লীগীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন এ নায়ক।

মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘পাথর সময়’ এর একটি চরিত্র দিয়ে ইমনের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু। ১৯৯৩ সালে তিনি রূপালি পর্দায় আবির্ভূত হন সালমান শাহ নামে।

সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় সালমান শাহর পাশাপাশি মৌসুমীরও অভিষেক হয়। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত করেন তারা।

শহুরে আধুনিক শিক্ষিত তরুণের ইমেজ দিয়ে দর্শকদের মন জিতে নেওয়া সালমানের অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসা সফল হওয়ায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার চাহিদা ছিল তুঙ্গে।

‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিচার হবে’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘আশা ভালোবাসা’সহ সালমান অভিনীত সিনেমাগুলো মধ্যবিত্ত দর্শককে হলে ফেরায়।

মৌসুমীর পাশাপাশি শাবনাজ, লিমা, শিল্পী, বৃষ্টির বিপরীতে বিভিন্ন সিনেমায় দেখা গেছে সালমান শাহকে, তবে শাবনূরের সঙ্গেই তার রসায়ন সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয় হয়। এই জুটির ১৪টি সিনেমাই বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পায়।

 

মামলার পূর্বাপর

ছেলের মৃত্যুর পর প্রথমে একটি অপমৃত্যু মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। কিন্তু পরে ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে- এমন অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই অভিযোগটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করার আবেদন জানান তিনি।

তখন অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেয় আদালত। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, সালমান শাহ ‘আত্মহত্যা’ করেন।

সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন চৌধুরী রিভিশন মামলা দায়ের করেন। পরে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত।

 

দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট সেই প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক। তাতেও হত্যার অভিযোগ নাকচ করা হয়।

সালমান শাহের বাবার মৃত্যুর পর তার মা নীলা চৌধুরী মামলটি চালিয়ে যান। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে ‘নারাজি’ দেন। তিনি ১১ জনের নাম উল্লেখ করে দাবি করেন, এরা তার ছেলেকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

মামলাটি এরপর তদন্ত করে র‌্যাব। তখন রাষ্ট্রপক্ষ আপত্তি তুললে ২০১৬ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েশ র‌্যাবকে মামলাটি আর তদন্ত না করার আদেশ দেন।

তখন তদন্তের দায়িত্বে আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চার বছর তদন্তের পর ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

সেখানেও বলা হয়, ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ৫৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে, জব্দ করা আলামত পর্যালোচনা করে হত্যার অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি।

 

পিবিআই তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলে, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পারিবারিক কলহ আর স্ত্রী সামিরা হকের কারণে মা নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে ছেড়ে থাকার মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেই অভিমানী সালমান শাহ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

ওই প্রতিবেদনেও সন্তুষ্ট নন সালমানের মা নীলা চৌধুরী। ছেলের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তা জানতে তিনি আরও তদন্ত চান।

ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর পিবিআইয়ের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন।

এরপর সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী কয়েকটি বিষয় নিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন।

 

 

বিনোদন ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম

নিউজটি শেয়ার করুন

“সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে; আর যদি আত্মহত্যা করে, সেটা সামিরার কারণে,” বলেন মা নীলা চৌধুরী।

২৭ ছবির সালমান শাহ ,মৃত্যু নিয়ে এখনো মতদ্বৈধ

আপডেট সময় ০১:১০:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

 

একটি-দুটি করে পার হয়েছে ২৯টি বছর; এখনো ঢাকাই সিনেমার নায়ক সালমান শাহের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও তা মানতে নারাজ পরিবার ও ভক্তরা। তাদের ভাষ্য, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে।

তুমুল জনপ্রিয় এ চিত্রনায়কের মা নীলা চৌধুরী বলছেন, “সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। আর যদি সে আত্মহত্যাও করে- সেটা তো সামিরার কারণে। তার কারণে আমি আমার ছেলেটাকে হারিয়েছি।”

এই মামলা যদি না চলে, নতুন করে হত্যা মামলা করবেন বলে জানালেন তিনি।

 

সিনেমায় আসার আগেই সামিরা হককে বিয়ে করেছিলেন সালমান। ১৯৯৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর ইস্কাটনে সালমান শাহর বাসা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরিবারের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়েছে, সালমানকে খুন করা হয়েছে।

দুই যুগ ধরে আদালতে ঝুলে থাকা মামলার প্রথমে তদন্তভার আসে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের হাতে (সিআইডি)। এরপর ২০১৬ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এই হত্যা মামলা তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। প্রতিবারই আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়নি, আত্মহত্যা করেছেন এ নায়ক।

পিবিআইয়ের তদন্ত শেষে সংস্থার পরিদর্শক সিরাজুল ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে বলা হয়- সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। ঢাকার তৎকালীন মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর পিবিআইর দেওয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন।

এরপর সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী রিভিশন আবেদন করেন, যা ২০২২ সালের ১২ জুন গ্রহণ করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ। তবে সালমান শাহর মা দেশের বাইরে থাকায় রিভিশন শুনানি হচ্ছে না। সবশেষ গত ২৬ অগাস্ট মামলাটির শুনানির তারিখ ছিল। ওইদিন রিভিশনকারী আদালতে হাজির না হওয়ায় শুনানি পিছিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর দিনে ঠিক করেছেন মহানগর দায়রা জজ জাকির হোসেন।

যোগাযোগ করা হলে লন্ডনে অবস্থানরত নীলা চৌধুরী বলেন, “দেশের যে অবস্থা, আগে সব ঠিক হোক, স্ট্যাবল হোক। এখন গিয়ে কার কাছে বিচার চাইব। দেশের পরিবর্তন হোক।

“২০১৮ সালে আমাকে জানানো হলো, মা সরে যান, না হলে গুম হয়ে যাবেন। আমাকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করতে দিত না এস আলম, শফিকুল ইসলাম হীরা সিন্ডিকেট। আমাকে শেষ করতে পারলে তো মামলা শেষ হয়ে যাবে।”

 

নীলা চৌধুরী বলেন, “আমার ছেলে খুন হয়েছে, লাশ মর্গে পড়ে আছে। আমাদের দুই লাইন লেখার শক্তি ছিল না। সেখানে হত্যাকাণ্ডকে এতো বড় একটা অপমৃত্যুর এজাহার করলো। পুলিশ এতো দয়াবান! সালমান শাহ হত্যার সাথে ফিল্মের লোক জড়িত।

“আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা মিলে আমার ছেলেটাকে খুন করেছে। মরে গিয়ে আমার ছেলেটা দোজখ থেকে, এফডিসি থেকে, সামিরার কাছ থেকে রেহাই পেয়েছে। সামিরা তো আমার ছেলেটাকে জোর করে গ্রহণ করে সংসার করেছে।

“এখন ডলি জহুর, সামিরা, ডন একই ভাষায় কথা বলছে যে- সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে। ইমন (সালমান শাহ) যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে তো তোর (সামিরার) কারণে করেছে। আর রুবি তো হত্যার কথা সব বলে দিচ্ছিল, তাকে বাধা দেওয়া হলো কেন? আল্লাহ আছেন।”

সালমান শাহর মা বলেন, “ইমন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। আমার হাতে গড়া বাচ্চা। প্রত্যেকটা জিনিস আমি ওকে হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছি। এমনকি সিনেমায় ভালোবাসার অভিনয় কেমনে করতে হয়, তাও শিখিয়েছি। ওরা সবাই মিলে আমার ছেলেটা খুন করলো। স্বামী মারা গেলে দুঃখবোধ থাকে। সামিরার মধ্যে এটা ছিলো না। বারবার নতুন নতুন সংসার করছে।

“মেয়েটা কেমনে নিজেকে খুন করলো, নিজেকে জীবন্ত খুন করেছে। আমাকেও খুন করার চেষ্টা করছে। আমি মারা গেলে আমার মৃত্যুর জন্য সামিরা দায়ী থাকবে। রোষানল থেকে, মামলা থেকে বাঁচতে সে হয়তো আমাকেও খুন করবে। আমি দেশে চলে আসব। এই মামলা যদি না চলে, তাহলে নতুন করে হত্যা মামলা করব। সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।”

সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম বলেন, “২৯ বছর হয়ে গেল, সালমান শাহ হত্যার বিচার হলো না। অপেক্ষা করেন, ইনশাআল্লাহ এবার ভালো কিছু হবে।”

ভালো কিছু কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “তা বলব কেন? মামলার স্বার্থে এখন কিছুই বলব না।”

 

খেদ প্রকাশ করে আলমগীর কুমকুম বলেন, “সাংবাদিকরা সারা বছর খোঁজ নেয় না, ৬ সেপ্টেম্বর আসলে ফোন করে খবর নেয়। আমাদের যখন দুঃখের সময়, আপনাদের (সাংবাদিকদের) তখন নিউজের সময়।”

সালমান শাহর বিষয়ে সাংবাদিকরা সামিরার সাক্ষাৎকার নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, “সালমান শাহ হত্যা মামলার কিছু ডকুমেন্ট চেয়ে আমরা রিভিশন করেছি। এ রিভিশন করেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ লন্ডনে রয়েছেন। অসুস্থ থাকায় দেশে আসতে পারছেন না।

“নীলা চৌধুরী তার ভাই আলমগীর কুমকুম রিভিশনকারী হিসেবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর রিভিশনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।”

তিনি বলেন, “এ সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা; মামলাটা সুনজরে দেখবেন, সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে তদন্ত করবেন। প্রকৃত আসামিরা যেন আইনের আওতায় আসে।

“এ হত্যার বিচার যেন সালমান শাহর মা দেখে যেতে পারেন, সেই প্রত্যাশা করি।”

 

সালমান শাহর জন্য রাজপথে ভক্তরাসালমান শাহর জন্য রাজপথে ভক্তরা

 

সালমান শাহর অসংখ্য ভক্তের একজন সোহেল বলেন, “সালমান শাহকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা পরিকল্পিতভাবে সালমান শাহকে হত্যা করেছে। এর অনেক প্রমাণও আছে। রুবি নামে একজন লাইভে এসেও বলেছে, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও পিবিআই এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চায়।

তিনি বলেন, “অনেক বছর হয়ে গেছে। এমন একজন স্টার আর বাংলাদেশে আসবে না। তার মৃত্যুর সঠিক কারণটা উদঘাটিত হোক।

“নতুন প্রজন্ম জানুক কীভাবে, কারা তাকে হত্যা করেছে। এই সরকারের কাছে অনুরোধ, মামলার সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরবেন।”

 

ইমন থেকে সালমান শাহ

বলা হয়, মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের চলচ্চিত্র-জীবনে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সালমান শাহ ঢাকাই সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকে যারা বয়সে ছিলেন কিশোর-তরুণ, তাদের অনেকের হৃদয়েই সালমান শাহ বাংলাদেশের ‘সেরা রোমান্টিক অভিনেতা’ হয়ে থাকবেন।

রূপালি পর্দার সালমান শাহর আনুষ্ঠানিক সাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সিলেটের জকিগঞ্জে নানাবাড়িতে ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। কমর উদ্দিন চৌধুরী ও নীলা চৌধুরীর বড় ছেলে ছিলেন তিনি।

আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ড. মালেকা সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ইমন ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন সাবেক ক্রিকেটার শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরাকে; তখন তার বয়স ২২ বছর। সামিরার মায়ের ছিল বিউটি পার্লারের ব্যবসা।

 

বিনোদনজগতে সালমানের যাত্রা শুরু হয় বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে। গানও গাইতেন, ছায়ানটের পল্লীগীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন এ নায়ক।

মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘পাথর সময়’ এর একটি চরিত্র দিয়ে ইমনের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু। ১৯৯৩ সালে তিনি রূপালি পর্দায় আবির্ভূত হন সালমান শাহ নামে।

সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় সালমান শাহর পাশাপাশি মৌসুমীরও অভিষেক হয়। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত করেন তারা।

শহুরে আধুনিক শিক্ষিত তরুণের ইমেজ দিয়ে দর্শকদের মন জিতে নেওয়া সালমানের অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসা সফল হওয়ায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার চাহিদা ছিল তুঙ্গে।

‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিচার হবে’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘আশা ভালোবাসা’সহ সালমান অভিনীত সিনেমাগুলো মধ্যবিত্ত দর্শককে হলে ফেরায়।

মৌসুমীর পাশাপাশি শাবনাজ, লিমা, শিল্পী, বৃষ্টির বিপরীতে বিভিন্ন সিনেমায় দেখা গেছে সালমান শাহকে, তবে শাবনূরের সঙ্গেই তার রসায়ন সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয় হয়। এই জুটির ১৪টি সিনেমাই বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পায়।

 

মামলার পূর্বাপর

ছেলের মৃত্যুর পর প্রথমে একটি অপমৃত্যু মামলা করেন সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। কিন্তু পরে ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে- এমন অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই অভিযোগটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করার আবেদন জানান তিনি।

তখন অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেয় আদালত। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, সালমান শাহ ‘আত্মহত্যা’ করেন।

সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন চৌধুরী রিভিশন মামলা দায়ের করেন। পরে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত।

 

দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট সেই প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক। তাতেও হত্যার অভিযোগ নাকচ করা হয়।

সালমান শাহের বাবার মৃত্যুর পর তার মা নীলা চৌধুরী মামলটি চালিয়ে যান। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে ‘নারাজি’ দেন। তিনি ১১ জনের নাম উল্লেখ করে দাবি করেন, এরা তার ছেলেকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

মামলাটি এরপর তদন্ত করে র‌্যাব। তখন রাষ্ট্রপক্ষ আপত্তি তুললে ২০১৬ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েশ র‌্যাবকে মামলাটি আর তদন্ত না করার আদেশ দেন।

তখন তদন্তের দায়িত্বে আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চার বছর তদন্তের পর ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

সেখানেও বলা হয়, ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ৫৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে, জব্দ করা আলামত পর্যালোচনা করে হত্যার অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি।

 

পিবিআই তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলে, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পারিবারিক কলহ আর স্ত্রী সামিরা হকের কারণে মা নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে ছেড়ে থাকার মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেই অভিমানী সালমান শাহ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

ওই প্রতিবেদনেও সন্তুষ্ট নন সালমানের মা নীলা চৌধুরী। ছেলের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তা জানতে তিনি আরও তদন্ত চান।

ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর পিবিআইয়ের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন।

এরপর সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী কয়েকটি বিষয় নিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন।

 

 

বিনোদন ডেস্ক : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম