ডাকসুর পর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নিয়ন্ত্রণ নিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, যারা এর আগে কখনো জাকসুতে কোনো পদ পায়নি।
৫৩ বছর আগের স্মৃতি ফেরানো জাকসুতে শিবিরের জয়জয়কার

- আপডেট সময় ১২:৫২:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৯ বার পড়া হয়েছে
তেত্রিশ বছর পর অনেক বিতর্ক সঙ্গী করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ-জাকসুর ঘটনাবহুল যে নির্বাচন হল, তাতে ভিপি বাদে জিএসসহ অধিকাংশ পদে জয়ী হলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা।
ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, ভিপি পদে স্বতন্ত্র আব্দুর রশিদ জিতু ৩৩৩৪ ভোট এবং জিএস পদে শিবিরের মো. মাজহারুল ইসলাম ৩৯৩০ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর শনিবার বিকাল ৫টা থেকে সিনেট ভবনে জাকসু ও ২১টি হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা শুরু করা হয়।
জাকসুর ফলাফল ঘোষণার আগে ২১টি হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। পরে কেন্দ্রীয় সংসদের ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম।
ফলাফল ঘোষণার আগে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে শহীদ এবং সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌসের আত্মার মাগফেরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ডাকসুর পর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নিয়ন্ত্রণ নিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, যারা এর আগে কখনো জাকসুতে কোনো পদ পায়নি।
ডাকসু নির্বাচনের দুই দিনের মাথায় ঢাকার অদূরে সাভারের এই ক্যাম্পাসের ভোটগ্রহণ নিয়ে সারা দেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে বৃহস্পতিবার দিনভর ভোট শেষে প্রায় ৬৮ শতাংশ ভোট পড়ে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
ভোটগ্রহণে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার অভিযোগের পর অধিকাংশ প্যানেলের বর্জন, দীর্ঘ সময় ধরে ভোটগণনার কাজের মধ্যে নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা এক শিক্ষকের মৃত্যুর মত ঘটনা লেখা থাকবে এ নির্বাচনের আমলনামায়।
তবে মূল বিপত্তি ঘটে অভিযোগ থেকে মুখ রক্ষার জন্য ওএমআর মেশিনের বদলে হাতে ভোট গুনতে গিয়ে।
জামায়াত সংশ্লিষ্ট এক কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনার অভিযোগ উঠলে নির্বাচন কমিশন ভোট গণনার কাজটি মেশিনের বদলে হাতে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তা করতে গিয়েই লেজেগোবরে দশা হয়।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া জাকসু নির্বাচনের এবারের দশম আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ ছিল শুরু থেকে। ছাত্র সংগঠনগুলোও ভোটের দাবিতে সোচ্চার ছিল।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন পরিস্থিতিতে কয়েক দফা পেছানোর পর জাকসু নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাগাছাস, বাম-প্রগতিশীল, স্বতন্ত্রদের অন্তত সাতটি প্যানেলসহ অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
জাকসুর প্রথম নির্বাচন হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক পর পরই ১৯৭২ সালে। সেবার স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মোর্শেদ ভিপি পদে জয় পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে জিএস হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাসদ ছাত্রলীগের রোকন উদ্দিন।
এরপর আরও আটটি নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনেই ভিপি ও জিএস পদে কোনো না কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রার্থী জয় পেয়েছেন। সেই হিসেবে এবারের জাকসু নির্বাচন ভিপি পদের ক্ষেত্রে ৫৩ বছর আগের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। অর্থাৎ প্রথম ও শেষ দশম জাকসুতে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
এবার জাকসুর ২৫টি পদে ১৭৮ জন এবং ২১টি হল সংসদের প্রতিটিতে ১৫টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৪৪৭ জন। নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল তুলনামূলক কম। নির্বাচনের হিসাব অনুযায়ী, ভোটে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী এবং পুরুষরা ৭৫ শতাংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
নবম জাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯২ সালের ৬ জুলাই। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুদ হাসান তালুকদার, জিএস হন শামসুল তাবরীজ। তারা দুজনই ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। সেই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেনি বিএনপির ছাত্র সংগঠনটি।
ছাত্রদলের মাসুদ হাসান তালকুদারের উত্তরসূরী হিসেবে এবার তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের আব্দুর রশিদ জিতু জাকসুতে যাচ্ছেন।
জিতুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আরিফুল্লাহ আদিব। তিনি পেয়েছেন ২৩৮৯ ভোট। জিতু ৯৪৫ ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। সেখানে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী শেখ সাদি হাসান পেয়েছেন ৬৪৮ ভোট।
জিএস পদে ছাত্রদলের শামসুল তাবরীজ স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাজহারুল ইসলাম। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) আবু তৌহিদ মো. সিয়াম। তিনি পেয়েছেন ১২৩৮ ভোট। মাজহারুল ২৬৯২ ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। সেই জায়গায় ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী পেয়েছেন ৯৪১ ভোট।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের (এজিএস) দুটি পদে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান (পুরুষ) ২৩৫৮ ভোট এবং আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা (নারী) ৩৪০২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
১৯টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ১৫টি জিতেছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। বাকি চারটি পদের মধ্যে ভিপিসহ তিনটি পদে স্বতন্ত্র এবং একটিতে বাগছাস প্রার্থী জয় পেয়েছেন।
কার্যকরী সদস্যের ছয় পদের পাঁচটি জিতেছেন শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা, একটিতে বাগছাসের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
সব মিলিয়ে ২৫টি পদের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির ২০টি, স্বতন্ত্ররা তিনটি এবং বাগছাস দুটি পদে জয় পেয়েছে।
অন্যান্য পদে জয়ী যারা
শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক- আবু ওবায়দা ওসামা (শিবির প্যানেল), ২৪২৮ ভোট
পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক- মো. শাফায়েত মীর (শিবির প্যানেল), ২৮১১ ভোট
সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক- মো. জাহিদুল ইসলাম বাপ্পী (শিবির প্যানেল), ১৯০৭ ভোট
সাংস্কৃতিক সম্পাদক- মহিবুল্লাহ শেখ জিসান (স্বতন্ত্র), ২০১৮ ভোট
সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক- মো. রায়হান উদ্দীন (শিবির প্যানেল), ১৯৮৬ ভোট
নাট্য সম্পাদক- মো. রুহুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), ১৯২৯ ভোট
ক্রীড়া সম্পাদক- মাহমুদুল হাসান কিরণ (স্বতন্ত্র), ৫৭৭৮ ভোট
সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (নারী)- ফারহানা আক্তার লুবনা (শিবির প্যানেল), ১৯৭৬ ভোট
সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (পুরুষ)- মো. মাহাদী হাসান (শিবির প্যানেল), ২১০৫ ভোট
তথ্যপ্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক- মো. রাশেদুল ইসলাম লিখন (শিবির প্যানেল), ২৪৩৬ ভোট
সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক- আহসাব লাবিব (গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-বাগছাস), ১৬৯০ ভোট
সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (নারী)- নিগার সুলতানা (শিবির প্যানেল), ২৯৬৬ ভোট
সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (পুরুষ)- মো. তৌহিদ হাসান (শিবির প্যানেল), ২৪৪২ ভোট
স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক- হুসনী মোবারক (শিবির প্যানেল), ২৬৫৩ ভোট
পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক- মো. তানভীর রহমান (শিবির প্যানেল), ২৫৫৯ ভোট।
কার্যকরী সদস্য
মো. তরিকুল ইসলাম (পুরুষ, শিবির প্যানেল), ১৭৪৬ ভোট
মো. আবু তালহা (পুরুষ, শিবির প্যানেল), ১৮৫৪ ভোট
মোহাম্মদ আলী চিশতি (পুরুষ, বাগছাস), ২৪১৪ ভোট
নাবিলা বিনতে হারুণ (নারী, শিবির প্যানেল), ২৭৫০ ভোট
ফাবলিহা জাহান নাজিয়া (নারী, শিবির প্যানেল), ২৪৭৫ ভোট
নুসরাত জাহান ইমা (নারী, শিবির প্যানেল), ৩০১৪ ভোট।
ফিরে দেখা: সাবেক ভিপি-জিএস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ-জাকসুর দশম নির্বাচনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে এবার। সর্বশেষ ১৯৯২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল ছাত্রদলের প্যানেল।
নির্বাচন |
ভিপি | জিএস |
১৯৭২ | গোলাম মোর্শেদ | রোকন উদ্দিন |
১৯৭৩ | রফিক উল্লাহ | মোজাম্মেল হক |
১৯৭৪ | এম এ জলিল | দোলোয়ার হোসেন |
১৯৮০ | আজাদ রহমান | আতাউর রহমান |
১৯৮১ | মোতাহার হোসেন | সামসুদ্দিন মাসুদ |
১৯৮৯ | এ কে এম এনামুল হক শামীম | আজিজুল হাসান চৌধুরী |
১৯৯০ | আশরাফ উদ্দিন খান | মো. আজগর হোসেন |
১৯৯১ | মো. মনিরুজ্জামান মনির | কে এম রাশেদুল হাসান |
১৯৯২ | মাসুদ হাসান তালুকদার |
শামসুল তাবরীজ |
ভোটের দিনের বিতর্ক
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ঢিমেতালে ভোটগ্রহণ শুরু হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। পরে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। তাতে হলে থাকা শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে কোনো সমস্যা না হলেও অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির মধ্যে পড়েন।
তবে দুপুরের পর থেকে ভোটার উপস্থিতি বেশ বাড়তে থাকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল, শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ হলসহ কয়েকটি কেন্দ্রে বিকালে ভোটারদের দীর্ঘ কিউ দেখা যায়। লাইনে থাকা ভোটারদের ভোটগ্রহণ শেষ করতে করতে রাত সাড়ে ৭টা বেজে যায়।
সকালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারে ভুল ছিল। ভোটাররা বলছেন, কার্যকরী সদস্য পদে তিনজন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা থাকলেও ব্যালটে দেওয়া নির্দেশনায় একজনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়। পরে সেই ব্যালট সংশোধন করা হয়। এই কেন্দ্রে সকালের দিকে ভোটারদের অমোচনীয় কালি না দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে।
নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ আসার পর জটিলতা তৈরি হলে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা হল কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ প্রায় সোয়া ঘণ্টা বন্ধ ছিল। একই কারণে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ হলে ভোটগ্রহণ আধা ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
নারী ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনকি নারী সাংবাদিকরাও সেসব কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর সকাল থেকেই বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা নানা অসংগতি ও অনিয়মের কথা বলছিলেন। কিন্তু ভোট কারচুপির সরাসরি অভিযোগ তখন কারও ছিল না।
তারা কেন্দ্রে ভোটের চেয়ে ব্যালট বেশি যাওয়া, প্রতিপক্ষের আচরণবিধি ভঙ্গ করা, জামায়াত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনা, পোলিং এজেন্টের অনুমতি থাকলেও তাদের প্রবেশে বাধা দেওয়া, ডোপটেস্টের ফলাফল না আসা, নির্বাচনকে ‘ম্যানিপুলেট’ করার নানা অভিযোগ করেন।
এ অবস্থার মধ্যে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে প্রথম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী। এ সময় তার পাশে প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী শেখ সাদি হাসানও ছিলেন।
এর পর জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানায় ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) সমর্থিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল। ক্যাম্পাসের মুরাদ চত্বরে এ ঘোষণা দেন প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী শরণ এহসান।
পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ প্যানেল। পরে একই পথে হাঁটে ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আংশিক প্যানেলের প্রার্থীরা। তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ঘোষণা দেন ভোট বর্জনের।
এ ছাড়া নির্বাচনি দায়িত্ব থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক। তারা হলেন, গণিত বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম ও অধ্যাপক শামিমা সুলতানা।
ধৈর্যের পরীক্ষা, মৃত্যু শোক
জামায়াত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনার অভিযোগে ছাত্রদল নির্বাচন বাতিলের দাবি তুললে নির্বাচন কমিশন মেশিন বাদ দিয়ে হাতে ভোট গোনার সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহস্পতিবার বিকালে ২১টি হল কেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে।
সব প্রস্তুতি সেরে গণনা শুরু করতে রাত ১০টা বেজে যায়। বলা হয়, প্রথমে গণনা করা হবে হল সংসদের ভোট। তারপর কেন্দ্রীয় সংসদের ব্যালটে হাত দেওয়া হবে।
সারারাত ধরে গণনার পর ২১টি হলের মধ্যে ১০টির গোনা শেষ হওয়ার খবর আসে সকালে।
সকালে আসে মর্মান্তিক এক সংবাদ। ভোট গণনার দায়িত্ব পালন করতে এসে অসুস্থ হয়ে মারা যান চারুকলা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস।
বৃহস্পতিবার তিনি প্রীতিলতা হলের পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভোট গণনার গতি বাড়াতে শুক্রবার সকালে তাকে গার্ড পাঠিয়ে বাসা থেকে ডেকে আনা হয়। সিনেট ভবনের ঢোকার সময়ই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
এরপর ভোট গণনা কক্ষে নেমে আসে শোকের ছায়া, কয়েকজন সহকর্মী অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি।
দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে হয় জানাজা। ফুল আর আশ্রুতে জান্নাতুল ফেরদৌসকে বিদায় জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, “যদি মেশিনের মাধ্যমে ভোট গণনা করা হতো তাহলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকত না বলে আমরা মনে করি। মেশিনে ভোট গণনা হলে হয়তো ম্যামকেও হারাতে হতো না “
আর নবাব ফয়জুন্নেসা হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক সুলতানা আক্তার বলেন, “নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনার জন্যই আমার সহকর্মীর জান্নাতুল ফেরদৌসীর মৃত্যু হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমি এই ঘটনার সঠিক বিচার চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তার ক্ষতিপূরণ দাবি করছি। এই মৃত্যুর দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিতে হবে।”
এই শিক্ষক বলেন, “তিনি (জান্নাতুল) সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে চাপ নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। চাপের কারণে তিনি হয়তো ঘুমাতে পারেননি। সকালে অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি। গার্ড পাঠিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
“আসার পর তিনি তিনতলায় উঠতে গিয়ে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু হয়; হাসপাতালে নেওয়ার আগেই। কাল যদি ভোট কাউন্ট করে, ফল দিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে হয়ত তার মৃত্যু হতো না। যে পদ্ধতিতে ভোট গণনা হয়েছে, গণনা হচ্ছে, তাতে করে তিন দিনেও ফল দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা এ পদ্ধতির পরিবর্তন চাই।”
জুমার নামাজ, জান্নাতুল ফেরদৌসের জানাজা ও খাবারের বিরতির জন্য ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এরপর ফের গণনা শুরু হয়। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান সিনেট ভবনে এসে পোলিং অফিসার ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এরপর গুঞ্জন ওঠে যে, ভোট গণনা আপাতত স্থগিত আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষোভ দেখায়, শিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’। তারা রাতের মধ্যেই ভোটের ফলাফল প্রকাশে সময়সীমা বেঁধে দেয়।
নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হচ্ছে, এমন অভিযোগও তোলেন এ প্যানেলের প্রার্থীরা। নির্বাচনে অব্যবস্থাপনা ও ভোট গণনায় বিলম্বের প্রতিবাদে সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকার একাধিক স্থানে বিক্ষোভ করে ইসলামী ছাত্রশিবির।
রাত ৮টার কিছু আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, হলের ভোট গণনা শেষ। এরপর শুরু হয় জাকসু নির্বাচনের ভোট গণনা। শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের ‘বিভ্রান্ত না হওয়ার’ আহ্বান জানায় নির্বাচন কমিশন।
ফল প্রকাশের বিলম্বের কারণ হিসেবে কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যু, তার জানাজা এবং জুমা ও দুপুরের খাবারের বিরতির কথা তুলে ধরা হয়।
ছাত্র সংসদের ভোট গণনা চলার মধ্যে এদিন রাত ৯টার দিকে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার।
ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বিএনপিপন্থি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।
তার সরে দাঁড়ানোর প্রতিক্রিয়া জানাতে রাত পৌনে ১০টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে আসে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। এই প্যানেলের এজিএস পদপ্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান বলেন, “শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচন কমিশনারের ‘লেজ গুটিয়ে’ পালানো এক ধরনের প্রতারণা।
“আমরা মনে করি, নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র ছিল। ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়ন না করতে পারার কারণেই তার এই পদত্যাগ।“
দিনভর এসব ঘটনাক্রমের মধ্যে রাতে একটি বিবৃতি আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের কাছ থেকে।
বিবৃতিতে জাকসু নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে ফের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান ফোরামের শিক্ষকরা।
রাতে একজন পোলিং অফিসার বলেন, “ম্যানুয়ালি ভোট গুনতে গিয়ে আমাদের অবস্থা নাজেহাল। আমাদের ভেতরে দমবন্ধ লাগছে। খাবারও দেওয়া হয়নি রাতে। আমার হাজব্যান্ড বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে দিয়েছে।”
এর আগে পুলিশের একজন সদস্যও সন্ধ্যার পর পর একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “আমাদের ইউনিট থেকে খাবার দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কিছু খেতে দেয়নি। আমাদের এটাও বলা হয়নি যে, নিজের মতো খেয়ে নিতে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “আশা করি, আজকে রাতের মধ্যেই আমরা ভোট গণনা সম্পন্ন করে ফলাফল ঘোষণার ব্যবস্থা করতে পারব।”
কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। শনিবার সকালেও সিনেট ভবনে ভোট গণনার কাজ চলতে দেখ যায়।
বেলা ১১টার আগে আগে নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, কেন্দ্রীয় সংসদের ২১টি হল কেন্দ্রের মধ্যে ১৫টির ভোট গণনা তখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে। দুপুর দেড়টা বা ২টায় ফল প্রকাশ করা যাবে বলে আশা করছেন তারা।
আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বেলা ১২টার দিকে বলেন, ওই সময় পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ ব্যালট পেপার গোনার কাজ শেষ হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে ফল ঘোষণা করা যাবে বলে তারা আশা করছেন।
শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ দুপুর সোয়া ২টার দিকে ভোট গণনা শেষ হওয়ার খবর দেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম