“ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি মেটিকুলাস পরিকল্পনার মাধ্যমে হয়েছিল এবং তাতে দেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বিদেশি শক্তি জড়িত ছিল,” বলেন তিনি।
আমাকে নির্যাতন করা হয় ক্যান্টনমেন্ট থানায়: মাহমুদুর রহমান

- আপডেট সময় ০৯:৪৭:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৯ বার পড়া হয়েছে
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যেখানে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্যান্টনমেন্ট থানায় নির্যাতিত হওয়ার কথা বলেছেন।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চে সোমবার দিনের প্রথমার্থে এবং দুই সদস্যের বেঞ্চে দ্বিতীয়ার্ধে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
৪৬তম সাক্ষী হিসেবে তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হন। বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলা দীর্ঘ এ সাক্ষ্য মঙ্গলবারও চলবে। পরে জেরা হবে।
সাক্ষ্যে মাহমুদুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি একটি মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিল এবং সেই প্ল্যানিংয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বিদেশি শক্তি জড়িত ছিল।
এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনীমূলক বই The Coalition Years থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, তিনি (প্রণব মুখার্জী) ২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের সঙ্গে দিল্লিতে তার যে কথোপকথন হয়েছিল, (বইতে) তার বর্ণনা দিয়েছেন। সে সময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মঈন ইউ আহমেদের সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছিল যে, যদি শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়, তাহলে তৎকালীন সেনাপ্রধান চাকরির নিশ্চয়তা পাবেন, আর্থিকভাবে লাভবান হবেন এবং সেফ এক্সিট পাবেন।
মাহমুদুর রহমান বলন, “আমাদের সকলের মনে আছে যে নির্বাচন হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে। তার অর্থ নির্বাচনের ১০ মাস আগেই নির্বাচনের ফল দিল্লিতে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছিল। নির্বাচনে এই ফল হওয়ার পিছনে জেনারেল মঈন এবং ডিজিএফআইয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ে সেই সময় কর্মরত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ। এই ইলেকশন মেকানিজমে ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ, যিনি পরবর্তীতে ডিজিএফআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।”
সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার প্রয়োজন মনে করেন হাসিনা
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা আবশ্যক। কারণ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মোরাল যদি উচ্চ থাকে তাহলে তারা কোনো অবস্থাতেই একটি বিদেশি শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোনো পুতুল সরকারকে মেনে নিবে না।
সেই পরিকল্পনা মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিলো বলে তিনি মনে করেন।
এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ধানমন্ডির এমপি শেখ ফজলে নুর তাপস সরাসরি জড়িত ছিলেনি এবং ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে থেকেই বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ তাপস এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি তৈরি করেন বলে মাহমুদুর রহমানের ভাষ্য।
‘প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি একধরনের ঘৃণা ছিল’ মন্তব্য করে তিনি আরেকটি বইয়ের কথা তুলে ধরেন।
বইটি লিখেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন। বইটির নাম ‘The Jamdani Revolution’. বইতে তিনি ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
সেই সময় শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া।
ওই বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “ভারতীয় হাই কমিশনার বিদায়ী সাক্ষাৎকার করতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে, সেটা ভারত যেন অস্বীকার করে। ভারতের সরকার থেকে যেন বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্যে একমাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়ী। তারা গোষ্ঠী স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের উপরে অত্যাচার চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, ভারত যেন বলে, তারা শান্তিবাহিনীকে ভারতে কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা অন্য কোনো সহায়তা দিচ্ছে না।”
মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতীয় হাই কমিশনার বাংলাদেশের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার এই জাতীয় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যে হতবাক হয়ে যান। তিনি শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারত এই জাতীয় কথা বললে আন্তর্জাতিক মহল কি বিশ্বাস করবে? শেখ হাসিনা আবার হাই কমিশনারকে একই কথা বলেন।
বাকশালের পতনের শেখ হাসিনার সেনাবাহিনী বিদ্বেষ শুরু হয়
“প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার এই যে সেনাবাহিনী বিদ্বেষ বাকশালের পতনের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। সেই সময় সেনাবাহিনীর একাংশ, যারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের বিদ্রোহে এক দলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাকশাল শাসন ছিল সর্বপ্রথম Authoritarian Regime.”
“শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনা বিদ্বেষ ছিল,” মন্তব্য করে তিনি আরেকটি বইয়ের রেফারেন্স দেন। বইটির নাম The Legacy of Blood. লেখক এন্থনি মাসকারেনহাস।
তিনি বলেন, এই সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী সৃষ্টি করতে চান না। সেনাবাহিনীর বিকল্পরূপে তিনি রক্ষী বাহিনী তৈরি করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই রক্ষী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। জেনারেল উবান ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন। এই পারিবারিক সেনা বিদ্বেষের কারণে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও মোরাল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যাক।
“বিডিআর হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ১৫ বছরের ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে হীনবল করবার পরিকল্পনায় অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্যে শেখ হাসিনা সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোনিবেশ করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপিড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হলে আমি এর প্রতিবাদে ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি। আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে সতর্ক করা। আমি লিখেছিলাম, বিচার বিভাগ স্বাধীন না থাকলে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র কিছুই থাকবে না। এই লেখার জন্যে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দেওয়া হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।”
‘শেখ হাসিনা জনগণকে সন্ত্রস্ত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন’
কীভাবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে ধাবিত হয়েছেন, সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। তিনি এবং তার সরকার বিচারবহিঃর্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছেন, গুম করেছেন, হেফাযতে নির্যাতন করেছেন এবং আয়নাঘর বানিয়েছেন।
“২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে র্যাব-১ এর আয়নাঘর, যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে আমাকে প্রথমে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর আইন বহিঃর্ভূতভাবে আদালতের কোনো নির্দেশ ছাড়াই ডিবি থেকে আমাকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আয়নাঘরে নিয়ে আমার চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। তারপর অন্ধকার সেলে নিয়ে আমাকে গারদের শিকের সাথে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। টিএফআই সেলে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমি পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের এক একজনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার সেলে ফেলে রাখা হতো। সেখানে অধিকাংশই আলেম শ্রেণির মানুষ ছিলেন। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হয়তো মানসিক টর্চার করবার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্য আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়েছিল। আমি সেখানে টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পেয়েছিলাম। যেমন ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত এবং নখ তোলার জন্য প্লায়ার্স দেয়ালে টাংগানো ছিল। এখানে আমাকে এক দিন রাখা হয়েছিল।
“আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখানে রাত ১টার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে দিয়ে ৫-৬ জন আততায়ী আমার সেলে প্রবেশ করে আমাকে বিবস্ত্র করে। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে আমার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার উপরে টর্চার শুরু করলে খুব দ্রুত আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখতে পাই আমাকে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের রুমে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সমস্ত শরীর পানিতে ভেজা ছিল। ধারণা করতে পারি, আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য আমার শরীরে পানি ঢালা হয়েছে।”
তিনি জানান, ২০১৩ সালে আমি দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হলে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফায় তিনি ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলেন। দ্বিতীয় দফার রিমান্ডের সময় তার সঙ্গে তৎকালীন ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সাক্ষাত হয়। এর আগে তিনি দেলোয়ার হোসেনকে চিনতেন না। দুই দিন তার সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন ডিবির একই গারদে ছিলেন।
“সেই সময় আমি দেলোয়ারের উপর ভয়াবহ টর্চার দেখতে পেয়েছি। তাকে সন্ধ্যার পরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সেল থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। মধ্য রাতে ২/৩ জন পুলিশ তাকে বহন করে আবার গারদে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। টেনে নিয়ে আসার পর সে শুধু যন্ত্রনায় কাতরাতো, কথা বলতে পারতো না, উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি থাকতো না। দুই দিন পর ডিবি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে, আমার সঙ্গে দেলোয়ারকে রাখলে ভবিষ্যতে আমি তার ওপর নির্যাতনের সব কাহিনী প্রকাশ করব। সেজন্য তাকে আমার গারদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।”
মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান – বিশেষ প্রতিনিধি : বিডিপলিটিক্স টোয়েন্টিফোর ডটকম